১৬ মে ২০২৩, মঙ্গলবার, ১১:১৩

করোনাকালে মারাত্মক শিখন ঘাটতি ছিল

মহামারি করোনার সময় দেড় বছর বন্ধ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা। প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি এতে সর্বাধিক। গবেষণায় দেখা যায়, করোনাকালে গোটা দেশের প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের মাঝে মারাত্মক শিখন ঘাটতি ছিল। সব থেকে বেশি পিছিয়ে ছিল সিলেট বিভাগের শিক্ষার্থীরা। বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা।

‘করোনায় শিখন ঘাটতি ও তার প্রতিকার’ সংক্রান্ত জাতীয় পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষাক্রমের (এনসিটিবি) এক গবেষণায় এমন চিত্র উঠে এসেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সহযোগিতায় এ গবেষণাটি পরিচালিত হয়। এতে দেশের ১০টি উপজেলা/থানার তিনটি করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মোট ১৮ হাজার ৮৩৮ জন শিক্ষার্থীর ওপর নিরীক্ষা করে। মঙ্গলবার রাজধানীর একটি হোটেলে গবেষণার তথ্য প্রকাশ করা হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাকালে বিদ্যালয় বন্ধের কারণে সব শ্রেণি-বিষয়ের শিক্ষার্থীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বোচ্চ পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিষয়ভিত্তিক পর্যালোচনায় সব থেকে বেশি পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বিষয়ে (-১৬.৪৩ শতাংশ), তৃতীয় শ্রেণির বাংলায় (-১৫.২৩ শতাংশ) এবং পঞ্চম শ্রেণির ইংরেজিতে (-১২.৪৯ শতাংশ) ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০২২ ও ২০১৯ সালে শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রাপ্ত নম্বরের একটি অসমতা লক্ষ্য করা গেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনাকালীন সময়ে দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বাংলা বিষয়ে দক্ষতা উল্লেখযোগ্যভাবে শিখন ঘাটতির (-৭.০৫ শতাংশ) সম্মুখীন হয়। শিক্ষার্থীদের বৃদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতার ক্ষেত্রে অসমতার মাত্রা খুবই বেশি ও প্রয়োগ দক্ষতার ক্ষেত্রে তা সর্বোচ্চ। জ্ঞানমূলক ক্ষেত্রে এই অসমতার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম, বিশেষ করে বাংলায়। এই শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বড় অংশ সব বিষয়ে (বাংলা, গণিত এবং ইংরেজি) বর্তমান ও পূর্ববর্তী শ্রেণির শিক্ষাক্রমে যথাক্রমে চরম এবং মধ্যম মাত্রার শিখন ঘাটতিতে ভুগছে। দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীর সংখ্যায় বাংলায় ৩৫.৫৯ শতাংশ, ইংরেজিতে ৩১.০৯ শতাংশ এবং গণিতে ৭৮.২৭ শতাংশ শিখন ঘাটতি। চরম মাত্রায় শিখন ঘাটতির কবলে বাংলায় ৪২.৭২ শতাংশ, গণিতে ৪১.৬১ শতাংশ এবং ইংরেজিতে ৩১.৮২ শতাংশ।

তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে প্রয়োগ দক্ষতার শিখন ঘাটতি সর্বাধিক। তাছাড়া বাংলা (-১৮.৩৭ শতাংশ), গণিত (-১৮.২৬ শতাংশ) এবং ইংরেজি (-১৪.৪১ শতাংশ) বিষয়ে অনুধাবন দক্ষতা হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় এবং ইংরেজি বিষয়ে জ্ঞান এবং অনুধাবনের গড় দক্ষতা বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের দক্ষতার ক্ষেত্রে উচ্চ মাত্রায় অসমতা উঠে এসেছে। বিশেষ করে গণিতের ক্ষেত্রে তবে উল্টো চিত্র ছিল বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচিতি বিষয়ে। দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীর চরম মাত্রায় শিখন ঘাটতি রয়েছে এমন তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাংলায় ৩৮.৯৪ শতাংশ, ইংরেজিতে ৩৫.২৮ শতাংশ, গণিতে ৩৯.৭১ শতাংশ, বিজ্ঞানে ৪৮.৮৪ শতাংশ এবং বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে ৩৪.৯৮ শতাংশ। তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষাক্রমে চরম মাত্রায় শিখন ঘাটতি বাংলায় ৪৯.৬৯ শতাংশ, ইংরেজিতে ৪৫.২০ শতাংশ, গণিতে ৪৫.৪৮ শতাংশ, বিজ্ঞানে ৪১.৬৪ শতাংশ এবং বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে ৪০.০৯ শতাংশ।

চতুর্থ শ্রেণিতে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষাক্রমে চরমমাত্রায় শিখন ঘাটতি রয়েছে এবং চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী বাংলায় ৪৯.১৯ শতাংশ, ইংরেজিতে ৩৬.৮১ শতাংশ, গণিতে ৪৩.৬৯ শতাংশ, বিজ্ঞানে ৪১.৬৮ শতাংশ এবং বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে ৩৫.২০ শতাংশ। চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষাক্রমে চরমমাত্রায় শিখন ঘাটতি রয়েছে বাংলায় ৪৩.৭৩ শতাংশ, ইংরেজিতে ৪৮.৫৬ শতাংশ, গণিতে ৩৮.৭৮ শতাংশ, বিজ্ঞানে ৩৬.৩৪ শতাংশ এবং বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে ৪৩.১৪ শতাংশ।

পঞ্চম শ্রেণির ক্ষেত্রে দেখা যায়, এই শিক্ষার্থীদের সব বিষয়ে উচ্চতর দক্ষতা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে গণিত ও ইংরেজিতে অনুধাবনের দক্ষতায় তুলনামূলকভাবে কম শিখন ক্ষতি পরিলক্ষিত হয়েছে। এই শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতায় উচ্চ মাত্রায় অসমতা পাওয়া যায়। ইংরেজি বিষয়ে অনুধাবন দক্ষতার ক্ষেত্রে এই অসমতা সর্বোচ্চ, যদিও প্রয়োগ দক্ষতার ক্ষমতা কম। চতুর্থ শ্রেণিতে চরমমাত্রায় শিখন ঘাটতি রয়েছে এমন পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪০.৯৯ শতাংশ, ইংরেজিতে ৩৯.৩৮ শতাংশ, গণিতে ৩৯.৩৮ শতাংশ, বিজ্ঞানে ৩২.৮০ শতাংশ এবং বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে ৩৫.৭২ শতাংশ। পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষাক্রমে চরমমাত্রায় শিখন ঘাটতি রয়েছে বাংলায় ৩৩.৩৫ শতাংশ, ইংরেজিতে ৪৭.৬৮ শতাংশ, গণিতে ৪২.৯২ শতাংশ, বিজ্ঞানে ৩৩.৯২ শতাংশ এবং বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বিষয়ে ৩৯.৭০ শতাংশ।

গবেষণায় ভৌগোলিক দিক বিবেচনায় বলা হয়, বরিশাল বিভাগে শিক্ষার্থীরা ভালো অবস্থানে। পিছিয়ে রয়েছে সিলেট বিভাগের শিক্ষার্থীরা। সব বিভাগের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলা, গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য বিদ্যমান। সমতলের এলাকার শিক্ষার্থীরা এগিয়ে আছে পাহাড়ি ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার শিক্ষার্থীদের তুলনায়।

করোনাকালীন সময়ে মাত্র ৪.৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর বাড়িতে ছিল ল্যাপটপ বা কম্পিউটার এবং রেডিও ছিল ৬.৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর বাসায়। আর ৪৭.৮ শতাংশ শিক্ষার্থীর বাসায় ছিল ইন্টারনেট সংযোগসহ স্মার্টফোন। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শতকরা ৭০.২ শতাংশ শিক্ষার্থী কখনোই টেলিভিশনে সম্প্রচারিত দূরশিখন কার্যক্রমে অংশ নেয়নি। এ ছাড়া ৭৬.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী মোবাইল এবং ৮৪.২ শতাংশ শিক্ষার্থী রেডিওর মাধ্যমে দূরশিখন কার্যক্রমে অংশ নেয়নি। যারা রেডিও এবং টেলিভিশনে ক্লাসে অংশ নিয়েছে তাদের ফল যারা নেয়নি তাদের তুলনায় ভালো। এই ঘাটতি পূরণে চারটি সুপারিশ করা হয়।

https://mzamin.com/news.php?news=55660