২২ মার্চ ২০২৩, বুধবার, ৮:০৯

ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের নিরাপত্তার নিরীক্ষা হয়নি

দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক নির্মাণের আগে ও পরে নিরাপত্তার বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য কোনো নিরীক্ষা হয়নি। মানা হয়নি ২০০৫ সালে তৈরি করা নিরাপত্তা মডিউলও।

এজাতীয় বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে নকশা তৈরির আগে প্রাক-নিরাপত্তা নিরীক্ষা করার কথা। প্রকল্পের নির্মাণ শেষে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার আগে আবার নিরাপত্তা নিরীক্ষা জরুরি। কিন্তু এই প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে ও পরে কখনোই তা করা হয়নি। ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত এই এক্সপ্রেসওয়ে ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ।

গত রবিবার মাদারীপুরের শিবচরে ইমাদ পরিবহনের একটি বাস সড়ক থেকে আট ফুট নিচে পড়ে যায়। এতে ১৯ জনের মৃত্যু হয়। পদ্মা সেতু থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে দুর্ঘটনাটি ঘটে। সেখানে নিরাপত্তাবেষ্টনী না থাকায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দেন। আলোচনায় আসে এক্সপ্রেসওয়ের নিরাপত্তাঝুঁকির বিষয়।

বর্তমানে দেশে নিরাপত্তা নিরীক্ষার কাজ করে থাকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)। এআরআই সূত্র বলছে, ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের কোথাও কখনো নিরাপত্তা নিরীক্ষা করা হয়নি।

এক্সপ্রেসওয়েটি বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) এবং সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর নির্মাণ করেছে। মহাসড়কের পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তের দেড় কিলোমিটার এবং জাজিরা প্রান্তের ১০ কিলোমিটার নির্মাণ করেছে সেতু কর্তৃপক্ষ। সড়কের বাকি কাজ করেছে সওজ অধিদপ্তর।

শিবচরের দুর্ঘটনাটি ঘটেছে বিবিএর অধীনে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প এলাকায়। নিরাপত্তা নিরীক্ষা করা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে বিবিএর সচিব মো. মনজুর হোসেন বলেন, ‘ফাইল দেখে বলতে হবে।’

তবে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্র বলছে, পদ্মা সেতুকে ঘিরে পুরো প্রকল্পে আগামী ১০০ বছরের একটা পরিকল্পনা আছে। ত্রুটি ধরা পড়লে নিরাপত্তা নিরীক্ষাসহ অন্য আরো অনেক কিছুই করা যেতে পারে।

পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সেফটি অডিট (নিরাপত্তা নিরীক্ষা) কখন করতে হয়, এটা আমার জানা নেই।’ প্রকল্পে নিরাপত্তা নিরীক্ষা হয়েছিল কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মনে পড়ছে না।’

নিরাপত্তা নিরীক্ষা কতটা জরুরি : সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রকল্পের নিরাপত্তা নিরীক্ষা করা থাকলে ত্রুটিগুলো খুঁজে পেতে সুবিধা হয় এবং সেগুলো সংশোধন করা যায়। আর সঠিক সময়ে ভুল শুধরে নেওয়া অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জানমালের নিরাপত্তার চেয়ে বড় কিছু হতে পারে না।

মহাসড়ক রক্ষণাবেক্ষণ নীতিমালা ২০২১-এর খসড়ায় বলা আছে, রক্ষণাবেক্ষণকাজের প্রয়োজনীয়তা যথাযথভাবে চিহ্নিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট নীতিমালা ও ম্যানুয়ালের যথাযথ অনুসরণ এবং যথার্থ কার্য-সম্পাদন নিশ্চিত করতে হবে। মাঠ পর্যায়ের প্রকৌশলীদের নিয়মিত পরিদর্শন অপরিহার্য বলে গণ্য হবে।

বুয়েটের এআরআইয়ের সাবেক পরিচালক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এত বড় প্রকল্পের শুরুতেই প্রাক-নিরাপত্তা নিরীক্ষা করা উচিত ছিল। দ্রুতগতিতে চলার জন্য বিপুল বিনিয়োগ করে সড়ক নির্মাণ করা হলো, অথচ তা কতটা নিরাপদ, সেটাই পরীক্ষা করে দেখা হলো না।’

নিরাপত্তা নিরীক্ষা করার জন্য বুয়েটের এআরআই ছাড়া আর কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। নিরাপত্তা নিরীক্ষা করার জন্য সাধারণ প্রকৌশলবিদ্যা, ট্রাফিক প্রকৌশল, সড়ক প্রকৌশল, গণিত ও হিসাব—সব কিছুর সমন্বয় দরকার।

এক্সপ্রেসওয়েতে এখন নিরাপত্তা নিরীক্ষা করে সমস্যা পাওয়া গেলে তা সমাধান করা যাবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে শামছুল হক বলেন, অবশ্যই করা যাবে। এটাকে বলা হয় রোড ফার্নিচার। নির্মাণের পরও নতুন করে অনেক কিছু সাজানো-গোছানো সম্ভব।
‘ডাব্লিউ বিন’ নিরাপত্তা বেষ্টনী : গত রবিবারের দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ার পেছনে সড়কের নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, বাঁধের মতো সড়কটি মাটি থেকে প্রায় আট ফুট উঁচুতে। নিয়ম অনুযায়ী, এমন সড়কে নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকা বাধ্যতামূলক। যদি নিরাপত্তাবেষ্টনী থাকত, তাহলে দুর্ঘটনা ঘটলেও ক্ষতি কম হতো।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, “এমন সড়কে ঝুঁকি বিবেচনায় অবশ্যই টানা ‘ডাব্লিউ বিন’ (নিরাপত্তা বেষ্টনী) দিতে হবে। যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেখানে কিন্তু কোনো টানা রেলিং ছিল না। সড়কে দুর্ঘটনা ঘটলেও এত ওপর থেকে গাড়ি নিচে পড়তে দেব কেন?”

‘ডাব্লিউ বিন’ হচ্ছে এক ধরনের ঢেউ তোলা টিনের পাত। তবে এতে দুটি ঢেউ থাকে বলে দেখতে ইংরেজি ডাব্লিউ বর্ণের মতো দেখায়। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত, মহাসড়কে এজাতীয় নিরাপত্তাবেষ্টনী বেশি কার্যকর।

এক্সপ্রেসওয়ের মতো সোজা পথ দুর্ঘটনার জন্য বেশি বিপজ্জনক—এমন তথ্য উঠে এসেছে এআরআইয়ের এক গবেষণায়। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনার ৮৪ শতাংশ ঘটে অতিরিক্ত গতির কারণে। আর বাঁকের চেয়ে সোজা পথে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। সোজা পথে দুর্ঘটনা ঘটে ৬৭ শতাংশ।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/03/22/1263508