২২ মার্চ ২০২৩, বুধবার, ৭:৫০

৭৮ শতাংশ ব্যবসায়ীকে ঘুস দিতে হয়

বাংলাদেশে বড় সমস্যা দুর্নীতি। এটি কমলে বিনিয়োগ বাড়বে -মার্কিন রাষ্ট্রদূত

ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (এসএমই) খাতে ব্যবসা পরিচালনায় ৭৭ দশমিক ৯ শতাংশ ব্যবসায়ীকে নানা সময় ঘুস দিতে হয়। ব্যবসায়ীদের ৬০ দশমিক ১ শতাংশ রাজনৈতিক প্রভাব এবং ৪৬ দশমিক ৩ শতাংশ চাঁদাবাজির শিকার। এসএমই খাতের দুর্নীতি নিয়ে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) এক রিপোর্টে এসব বিষয় উঠে আসে। মঙ্গলবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি। আর এই দুর্নীতি কমলে এখানে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে।

অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ, সিজিএস চেয়ারম্যান ড. মঞ্জুর এ চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও টিআইবির মহাসচিব আলী ইমাম মজুমদার, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ আব্দুল মজিদ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ডা. ফাহমিদা খাতুন এবং সিজিএস-এর নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সালেহ জহুর।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, বৈশ্বিকভাবে যেসব কর্মকর্তা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাদের জবাবদিহি নিশ্চিতের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র অঙ্গীকারবদ্ধ। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত মানবাধিকারবিষয়ক প্রতিবেদনেও আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের শক্ত অবস্থানের কথা জানিয়েছি। আর বাংলাদেশে দুর্নীতি কমানো গেলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাশে আছে যুক্তরাষ্ট্র। এ দেশ থেকে অর্থ পাচার ও অর্থনৈতিক অপরাধের মতো বিষয়ে দুই দেশের সরকার একসঙ্গে কাজ করছে। পিটার হাস বলেন, দুর্নীতি চিহ্নিত করে তা দমন করতে পারলে অর্থনীতির অগ্রগতি হবে। তার মতে, বাংলাদেশে দুর্নীতির লাগাম টানা হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হবেন। এতে বাড়বে বিদেশি বিনিয়োগ।

তিনি বলেন, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম ভূমিকা রাখতে পারে। সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। অর্থনৈতিক অপরাধ ও অর্থ পাচারের মতো বিষয় অনুসন্ধানে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র কাজ করছে। এ দেশের জনগণ ও সরকারকে দুর্নীতি প্রতিরোধে সহায়তা করতে আমরা প্রস্তুত। পিটার হাস আরও বলেন, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় নয় বরং কীভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করা যায়, তা নিয়ে নীতিনির্ধারকদের কাজ করা দরকার। ব্যবসা-বাণিজ্য, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মতো খাতে ভালো করতে দুর্নীতির লাগাম টানতে হবে। প্রয়োজনে দেশের গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদেরও সহযোগিতা নেওয়ার পরামর্শ দেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।

মূল প্রবন্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সালেহ জহুর বলেন, এসএমই খাতের ব্যবসা পরিচালনায় অবকাঠামোগত সমস্যা আছে। এ খাতে ঋণের প্রবাহ ঠিক নেই। এসব ব্যবসায়ীর অনেকের প্রযুক্তিজ্ঞানও সীমাবদ্ধ। তাছাড়া প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ৭৭ দশমিক ৯ শতাংশ ব্যবসায়ীকে নানা সময় ঘুস দিতে হয়। ৬০ দশমিক ১ শতাংশ রাজনৈতিক প্রভাব এবং ৪৬ দশমিক ৩ শতাংশ ব্যবসায়ী চাঁদাবাজির শিকার হন। পুরো ব্যবস্থায় গলদের কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ৪৩ দশমিক ৯ শতাংশ ব্যবসায়ী স্বজনপ্রীতি এবং ৪৩ দশমিক ১ শতাংশকে অনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার আশ্রয় নিতে হয় বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। গবেষণার তথ্য বলছে, দেশের এসএমই উদ্যোক্তাদের ১০ জনের মধ্যে ৯ জন মনে করেন এই খাতে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার রয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৬২ দশমিক ৪ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, পুরো ব্যবস্থার মধ্যে দুর্নীতি আছে। ৭১ দশমিক ৩ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, দুর্নীতিকে সঙ্গে নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে। দুর্নীতির প্রকোপে ৬১ শতাংশ ব্যবসায়ী চান সরকারের নিয়মনীতিকে পাশ কাটিয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে ব্যবসা চালিয়ে যেতে।

ড. আলী রীয়াজ বলেন, দেশের অর্থনীতিতে সম্ভাবনাময় খাত হচ্ছে এসএমই। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে এসএমই খাতের ওপর জোর দিতে হবে। তবে দুর্নীতি এসএমই উদ্যোক্তাদের উদ্যোগকে সীমিত করে দেয়। আলী ইমাম মজুমদার বলেন, সামাজিক আন্দোলন ছাড়া দুর্নীতি দূর করা সম্ভব নয়। আশা করি, দুর্নীতি রোধে সিজিএস যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ডা. ফাহমিদা খাতুন বলেন, দুর্নীতি রোধে প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী হতে হবে। তিনি মনে করেন, প্রতিষ্ঠানগুলোকে পেছন থেকে অদৃশ্য হাত দিয়ে পরিচালনা করা হয়, সেগুলো বন্ধ করতে হবে। সিজিএস চেয়ারম্যান ড. মঞ্জুর এ চৌধুরী বলেন, ‘দুর্নীতি একটা দৈত্যের মতো, সবাইকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হবে।

অনুষ্ঠানে সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজের (সিআইপিই) নির্বাহী পরিচালক অ্যান্ড্র– উইলসন ভিডিও বার্তার মাধ্যমে বেসরকারি খাতের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সিআইপিই-এর লক্ষ্য তুলে ধরেন। তিনি আরও বলেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় সমস্যা দুর্নীতি। এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।

বক্তারা বলেন, অনেক ক্ষেত্রে সরকারি নানা নিয়মনীতি দুর্নীতিকে উসকে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব আছে বলে মনে করেন অনেকে। সরকার আইন করলেও অনেক ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ নেই। দুর্নীতি দমন কমিশন তার ভূমিকা পালন করছে না। এসব কারণে দুর্নীতি কমছে না। তাতে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিশেষত এসএমই খাতের ব্যবসায়ীরা ব্যবসা পরিচালনায় নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। বক্তারা বলেন, তাছাড়া ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোও দুর্নীতি প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে না। দ্রুতই এই পরিস্থিতির অবসানে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয় হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বক্তারা।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/657147