২২ মার্চ ২০২৩, বুধবার, ৭:০৩

গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও সভায় বাধা অব্যাহত রেখেছে সরকার

যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্ট

বাংলাদেশে সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী স্বৈরতান্ত্রিকভাবে অসংখ্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। সরকার তার আইনশৃঙ্খল বাহিনীর দ্বারা হত্যাকাণ্ডের সঠিক তথ্য প্রকাশ করেনি এবং নিশ্চিত করেনি এগুলোর স্বচ্ছ তদন্ত।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর থেকে গত সোমবার প্রকাশিত বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অংশে এ কথা বলা হয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেন আনুষ্ঠানিকভাবে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। পরে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন ব্যুরো অব ডেমোক্র্যাসি, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড লেবারের ভারপ্রাপ্ত সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এরিন বার্কলে।

মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির এক ভয়বাহ চিত্র উঠে এসেছে। ক্রমাগত মানবাধিকার লঙ্ঘন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জবাবদিহিতার আওতামুক্ত রাখা, গণমাধ্যম দলন, বিরোধী দলের সমাবেশ কর্মসূচিতে বাধা, রাজনৈতিক মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে আটক রাখা, সুশীলসমাজ এবং প্রবাসে থাকা সমালোচকদের ওপর সরকারের ক্রমাগত নিপীড়নসহ নানান বিষয় সবিস্তারে উঠে এসেছে এই প্রতিবেদনে।

২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি প্রসঙ্গে মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের কাছে অবাধ ও সুষ্ঠু বলে বিবেচিত হয়নি। ওই নির্বাচনে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরানো এবং বিরোধী দলের প্রার্থীদের এজেন্ট ও ভোটারদের ভয় দেখানোসহ নানা অনিয়মের ঘটনা ঘটায় পর্যবেক্ষকেরা এ ধারণা পোষণ করেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানে সংসদীয় সরকার পদ্ধতির কথা রয়েছে; যেখানে বেশির ভাগ ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনা ও তার দল পাঁচ বছর মেয়াদে টানা তৃতীয়বারের মতো জয়ী হয়। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকেন।

শান্তিপূর্ণ সমাবেশে সরকারের বাধা দানের কথা উল্লেখ করে মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, আইনে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার অধিকারের কথা থাকলেও সরকার সে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সমাবেশ করার ব্যাপারে বাধা অব্যাহত রেখেছে এবং সমাবেশের অনুমতির জন্য অহেতুক শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। প্রায় সময়ই পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা শক্তি প্রয়োগ করে বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং সংগঠনগুলোর বিক্ষোভ ভণ্ডুল করে দিচ্ছে।

পুলিশের দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার যেসব তদন্ত করা হয় তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। তারা বলছে বাংলাদেশের নাগরিকেরা তাদের মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

মানবাধিকার সংস্থা এবং গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা এখনো গুম, অপহরণ অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশের সরকারকে এসব বন্ধ করা, তদন্ত ও দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনতে খুব কমই পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ১৬ জনকে গুম করা হয়েছে বলে জানিয়েছে একটি মানবাধিকার সংস্থা।

সুশীলসমাজ বলেছে, যাদেরই গুম করা হয়েছে তারা বিরোধী দলের নেতাকর্মী এবং ভিন্ন মতের অধিকারী।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের মে মাসে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব হিউম্যান রাইটসসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এক খোলা চিঠিতে দাবি করে যে ২০২১ সালে র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পরও সরকার গুম অব্যাহত রেখেছে। গুমের শিকার পরিবারের সদস্যরা যেন কোনো কথা না বলে সেজন্য তাদের ভয়-ভীতি দেখানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের র‌্যাব, বিজিবি, গোয়েন্দাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বত্র দায়হীনতা এক ব্যাপক আকার ধারণ করেছে বলে জানিয়েছে সুশীলসমাজ, মানবাধিকার কর্মী ও গণমাধ্যমগুলো। সন্ত্রাস আর দুর্নীতির রাজনীতিকীকরণ, জবাবদিহিতার অনুপস্থিতির কারণে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়মুক্তির ঘটনা ঘটছে। সুশীলসমাজ বলছে, যেখানে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নিয়ে পুলিশের তদন্ত করার কথা তারা তা করছে না। কারণ স্বাধীনভাবে তদন্তের সুযোগ তাদের নেই। আর ভুক্তভোগীরা তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

২০২২ সালের ২৬ জুন পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু নিয়ে একটি যৌথ বিবৃতি দেয় স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো। বিবৃতিতে বলা হয়, ২০১৩ সালের নভেম্বর মাস থেকে ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে ৯০ জনের মৃত্যু হয়েছে। সরকার রাষ্ট্রীয় মদদে মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতন চালাচ্ছে বলে বিবৃতিতে প্রতিবাদ জানায় সংস্থাগুলো।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মামলা প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮ সালে দায়ের করা এক মামলায় বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ১০ বছরের জেল দেয়া হয়। মামলার রায়ে স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে বলে মত দিয়েছে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা। বিরোধী দলের এই নেতাকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে এটা একটা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে তারা উল্লেখ করেছেন। আইন বিশেষজ্ঞরা এও বলেছেন, খালেদা জিয়াকে জামিন দেয়ার ক্ষেত্রে ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করেছেন আদালত।

দেশের বাইরে প্রবাসে থাকা সমালোচকদেরও সরকার নির্যাতন করছে উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের বাইরে যারা থাকে তাদের ভয় দেখানো কিংবা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার কৌশলও অবলম্বন করে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে- বিরোধী দলের কর্মী, সুশীলসমাজের প্রতিনিধি মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক।

এতে বলা হয়, মানবাধিকার কর্মী, সুশীলসমাজের নেতৃবৃন্দ এবং প্রবাসে থাকা সরকারের সমালোচকদের যেসব পরিবারের সদস্য দেশে থাকে তাদের পুলিশ এবং গোয়েন্দা বাহিনীর লোকেরা নিয়মিত হয়রানি করছে এবং নজরদারি অব্যাহত রেখেছে। ২০২২ সালের মার্চ মাসে সাংবাদিক কনক সারওয়ারের বোন নুসরাত শাহরিন রাকাকে ১৬০ দিন জেলে আটক রাখার পর মুক্তি দেয়া হয়। গণমাধ্যমের তথ্য মতে, কনক সারওয়ার বলেছেন, অনলাইনে সরকারের সমালোচনায় তাকে শাস্তি দিতে এ কাজটা করা হয়েছে। তার বোনের কোনো দোষ নেই। রাষ্ট্রের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগ এনে ২০২০ সালে কনক সারওয়ারের ওয়েবসাইট বন্ধ করার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

প্রবাসে থাকা সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী এবং দেশে অবস্থান করা তাদের পরিবারের সদস্যদের ক্ষমতাসীন সরকার কর্তৃক হয়রানির চিত্র তুলে ধরে মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, লন্ডনভিত্তিক সাপ্তাহিক সুরমার সম্পাদক শামসুল আলম লিটন সরকারের সমালোচনা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় এবং ২০২২ সালের ৩০ আগস্ট আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামনে বিক্ষোভের আয়োজন করার প্রতিশোধ হিসেবে বাংলাদেশে তার ভাই নূর আলম চৌধুরীকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ।

দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগ এনে একই বছরের নভেম্বর মাসে ফ্রান্সে অবস্থান করা মানবাধিকার কর্মী পিনাকি ভট্টাচার্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করা সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী মুশফিকুল ফজল আনসারীর বিরুদ্ধে ঢাকায় ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা দায়ের করে পুলিশ।

সরকার কর্তৃক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বিরোধী মতের লোকদের তালিকা তৈরি এবং তা বিভিন্ন দূতাবাসে পাঠিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ককে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের বিষয়টি উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, টার্গেট করা লোকদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে অন্য দেশের সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চেয়েছে সরকার। এর বিশ্বাসযোগ্য তথ্য রয়েছে। গণমাধ্যমের দেয়া খবর অনুসারে, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রমে জড়িতদের একটি তালিকা বানিয়ে পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর উদ্দেশ্য ছিল দূতাবাসগুলো যেন সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে তালিকাভুক্ত লোকদের বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নিতে চাপ সৃষ্টি করে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, অনলাইন কিংবা মুক্তমত দুই ক্ষেত্রেই বড় ধরনের বাধা রয়েছে। হয়রানি ও প্রতিশোধের ভয়ে গণমাধ্যম এবং ব্লগ কর্মীরা সরকারের সমালোচনার ক্ষেত্রে সেল্ফ সেন্সরশিপ নীতি অবলম্বন করছে।

এতে বলা হয়, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টকে সরকার এবং ক্ষমতাসীন দল সাংবাদিক নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/736017