২১ মার্চ ২০২৩, মঙ্গলবার, ৫:০৬

তহবিলে টাকা জমছে মিলছে না ক্ষতিপূরণ

সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের জন্য সরকারি তহবিল থাকলেও তা থেকে আজ পর্যন্ত কেউ ক্ষতিপূরণ পাননি। শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনে পাস হওয়া সড়ক পরিবহন আইনের ৫৩(১) ধারা অনুযায়ী, দুর্ঘটনায় হতাহতরা ক্ষতিপূরণ পাবেন আর্থিক সহায়তা তহবিল থেকে। গত ২৭ ডিসেম্বর কার্যকর সড়ক বিধিমালা অনুযায়ী, প্রতিটি যানবাহনের কাছ থেকে বার্ষিক চাঁদা নেওয়া হচ্ছে এই তহবিলে।

চলতি বছরে এ তহবিলে শুধু মোটরসাইকেলের নিবন্ধন থেকে এককালীন ৬ কোটি ১০ লাখ টাকা চাঁদা এসেছে। সরকারি হিসাবেই বছরে ১০ হাজারের বেশি দুর্ঘটনায় হতাহত হলেও তহবিল পরিচালনায় ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের পর প্রচার না থাকায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে এ পর্যন্ত আবেদন জমা পড়েছে মাত্র ছয়টি।

গত রোববার মাদারীপুরের শিবচরে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ইমাদ পরিবহনের বাসের ২০ যাত্রী নিহত হয়েছেন। গতকাল সোমবারও সারাদেশে অন্তত ১৩ জনের প্রাণ গেছে দুর্ঘটনায়। দুর্ঘটনায় কর্মক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু বা পঙ্গুত্বে তাঁর পরিবার পথে বসে। কিন্তু আদালতে মামলা করে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার নজির বিরল।

তাই ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর কার্যকর হওয়া সড়ক পরিবহন আইনে হতাহতের সহায়তায় তহবিলের ব্যবস্থা রাখা হয়। এর ৫৪(১) ধারায় বলা হয়েছে, তহবিল পরিচালনায় থাকবে ১২ সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ড। সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান পদাধিকার বলে এ বোর্ডের চেয়ারম্যান। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মনোনীত প্রতিনিধিদের জন্য সদস্যপদ রয়েছে আটটি। সরকার মনোনীত মালিক সংগঠনের একজন, শ্রমিক সংগঠনের একজন এবং একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হবেন ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য।

কিন্তু আইন কার্যকরের তিন বছর পার হলেও এই তিন সদস্য মনোনয়ন দেয়নি সরকার। ৫৪(৪) ধারায় ট্রাস্টি বোর্ডকে স্বশাসিত সংস্থা বলা হয়েছে। কিন্তু এর কার্যালয় নেই। নেই কার্যক্রমও। কারণ, আইনে নিজস্ব জনবলের কথা বলা হলেও তা নিয়োগ হয়নি। বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার সমকালকে বলেন, অর্গানোগ্রাম (জনবল কাঠামো) প্রণয়ন করা হচ্ছে। এরপর নিয়োগ শুরু হবে।

আইনে বলা হয়েছে, সরকারি অনুদান, যানবাহনের কাছ থেকে পাওয়া চাঁদা এবং এই আইনের অধীনে আদায় করা জরিমানার টাকা জমা হবে তহবিলে। সড়ক পরিবহন বিধিমালার ১৪৯ ধারায় বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ নিহত হলে তাঁর পরিবার অন্যূন ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবে। অঙ্গহানি এবং পঙ্গুত্বের জন্য ৩ লাখ এবং চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সম্ভাবনা থাকলে ১ লাখ সহায়তা পাবেন দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তি। সরকারের অনুমোদনে সহায়তার পরিমাণ কমবেশি করতে পারবে ট্রাস্টি বোর্ড।

বিধিমালার ১৪৩ ধারায় বলা হয়েছে, প্রতিটি বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, প্রাইমমুভারের জন্য মালিককে বছরে ১ হাজার ৫০০ টাকা চাঁদা দিতে হবে।

নতুন নিবন্ধন এবং প্রতিবছর গাড়ির কাগজ হালনাগাদের সময় এই চাঁদা নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে ১ জানুয়ারি থেকে তা আদায় শুরু করেছে বিআরটিএ। মিনিবাস, মিনিট্রাক, পিকআপের বার্ষিক চাঁদা ৭৫০ টাকা। কার, জিপ, মাইক্রোবাসের চাঁদা ৫০০ টাকা। তিন চাকার গাড়ি এবং অন্যান্য যানবাহনের চাঁদা ৩০০ টাকা। তবে বছর বছর মোটরসাইকেলের ট্যাপ টোকেন এবং ফিটনেস হালনাগাদ করতে না হওয়ায় এই দ্বিচক্রযান থেকে বছরে এককালীন ১ হাজার টাকা চাঁদা নেওয়া হচ্ছে।

বিআরটিএর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারাদেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৫৬ লাখ ৬১ হাজার ৪১৮। এর মধ্যে মোটরসাইকেল ৪০ লাখ ৬৮ হাজার ৮১৯টি। চলতি বছরে নিবন্ধিত ৬১ হাজার ২টি মোটরসাইকেলের কাছ থেকে ৬ কোটি ১০ লাখ ২ হাজার টাকা চাঁদা এসেছে তহবিলে।

বছরে ৫ লাখ নতুন মোটরসাইকেল নিবন্ধন করা হয়। এই হিসাবে মোটরসাইকেল থেকে বছরে ৫০ কোটি টাকা চাঁদা আসবে। বর্তমানে যেসব ট্রাক, বাস, কাভার্ডভ্যান ও প্রাইমমুভার রয়েছে, তা থেকে চাঁদা আসবে ৪৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। তিন চাকার ও অন্যান্য শ্রেণির গাড়ি থেকে সাড়ে ১৩ কোটি। প্রাইভেটকার থেকে বছরে মিলবে ২০ কোটি। তবে সব গাড়ি প্রতিবছর কাগজ হালনাগাদ করে না। অনেক গাড়ি বিকল হয়ে গেছে, তার হিসাব বিআরটিএর কাছে নেই। তার পরও অন্তত বছরে ১৫০ কোটি আসবে তহবিলে।

বিআরটিএর চেয়ারম্যান বলেছেন, যত সময় যাবে, তহবিলের আকার তত বাড়বে। তবে প্রাথমিকভাবে সরকারের কাছে ১০০ কোটি টাকা অনুদান চাওয়া হয়েছিল। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় ৫০ কোটি টাকা ছাড় করতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছে। তা এখনও পাওয়া যায়নি। তবে বিআরটিএ যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে।

নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেছেন, বিধিমালা অনুযায়ী ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের ৩০ দিনের মধ্যে সভা হয়েছে। অর্থাৎ বোর্ড গঠিত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ছয়টি ক্ষতিপূরণের আবেদন এসেছে, যেগুলো তদন্ত করতে দেওয়া হয়েছে। হতাহতের ঘটনা সত্য হলে সহায়তা পাবেন ক্ষতিগ্রস্তরা। তবে এখনও কেউ পাননি। গত বছর ত্রিশালে ট্রাকের চাপায় নিহত মায়ের পেট ফেটে সড়কে জন্ম নেওয়া শিশুকে সরকারের বিশেষ নির্দেশে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।

বিধিমালায় বলা হয়েছে, দুর্ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে আবেদন করতে হবে। আবেদন পাওয়ার ১০ দিনের মধ্যে অনুসন্ধানে কমিটি গঠন করা হবে। ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে অনুসন্ধান কমিটি। সহায়তার আবেদনকারী আপিলও করতে পারবেন। ট্রাস্টি বোর্ডের জনবল নেই, কে করবে অনুসন্ধান– প্রশ্নে নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেছেন, যে এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটবে, আপাতত সেখানকার বিআরটিএ কর্মকর্তারা অনুসন্ধান করবেন।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেছেন, সহায়তা তহবিল খুবই জরুরি। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন ক্ষয়ক্ষতির সঠিক অনুসন্ধান।

সড়ক দুর্ঘটনার সরকারি ও বেসরকারি পরিসংখ্যানে বিরাট তারতম্য রয়েছে। পুলিশের বরাতে বিআরটিএ জানিয়েছে, ২০২২ সালে ৫ হাজার ২০০ দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৬৩৮ জন নিহত হয়েছেন। আবার যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালে সড়কে ৬ হাজার ৭৪৯ দুর্ঘটনায় ৯ হাজার ৯৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য, ৭ হাজার ৭১৩ জনের প্রাণ গেছে। বেসরকারি সংস্থাগুলোর অভিযোগ, সব দুর্ঘটনা ও মৃত্যু পুলিশের খাতায় উঠছে না।

দুর্ঘটনার তথ্য নথিবদ্ধ না হলে কীভাবে ক্ষতিপূরণ পাবেন– হতাহতরা এ প্রশ্ন তুলেছেন। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেছেন, বিআরটিএর নিজেরই জনবল সংকট রয়েছে। নির্ধারিত কাজই তারা করতে পারছে না। ক্ষতিপূরণ দিতে দুর্ঘটনার অনুসন্ধান করবে কখন? এর সঙ্গে দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করা উচিত।
দুর্ঘটনা রোধে সড়ক পরিবহন আইনে ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গের জরিমানা ও সাজা অনেক গুণ বেড়েছে। কিন্তু সড়কে আইনটি কার্যকর হচ্ছে না। নিবন্ধনবিহীন বা নিবন্ধন স্থগিত হওয়া গাড়ি চালানোর সাজা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা ছয় মাস জেল। গত রোববার ইমাদ পরিবহনের যে বাসটি (ঢাকা মেট্রো-ব-১৫-৩৩৪৮) দুর্ঘটনায় পড়ে, সেটির নিবন্ধন এবং চলাচলের অনুমতি (রুট পারমিট) স্থগিত ছিল। ফিটনেসের মেয়াদও ছিল না। আইনে কড়া বিধান থাকলেও চার মাস আগেও দুর্ঘটনা ঘটানো বাসটি আদালত থেকে জামিন নিয়ে দিব্যি চলছিল। পুলিশ বা নিয়ন্ত্রণকারী কোনো সংস্থাই ধরেনি। এমন লাখো গাড়ি চলছে সড়কে। আইনের ব্যত্যয় হচ্ছে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে।


https://samakal.com/bangladesh/article/2303163344