২১ মার্চ ২০২৩, মঙ্গলবার, ৫:০৪

তিন মাসে ৯ বনে আগুন

পুড়ে যাওয়া গাছের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা জানাতে পারেনি বন বিভাগ

সম্প্রতি দেশের বেশ কয়েকটি বনে দফায় দফায় আগুনের ঘটনা ঘটেছে। গত তিন মাসের তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, জাতীয় উদ্যানসহ ছয় জেলার ৯টি বনে আগুনে বহু গাছ পুড়ে গেছে। তবে পুড়ে যাওয়া গাছের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা জানাতে পারেনি বন বিভাগ।

দুর্বৃত্তরা এসব বনাঞ্চলে আগুন দিয়ে গাছ পুড়িয়ে পরে তা কেটে ফেলে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট বনজীবী ও এলাকাবাসীর। এতে কয়েক শ একর বনভূমির গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং আশ্রয়স্থল ও প্রাণ হারিয়েছে অনেক বন্য প্রাণী।
বনজীবী ও এলাকাবাসীর তথ্য মতে, গত ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত আড়াই মাসের বেশি সময়ে সিলেট অঞ্চলের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে অন্তত চারটি সংরক্ষিত বনে আগুন দেওয়া হয়েছে। আগুনে এসব বনের কমপক্ষে ১৫০ একর এলাকায় কয়েক হাজার গাছ ও বাঁশঝাড় উজাড় হয়েছে।

এর মধ্যে সবচেয়ে বড় আগুনের ঘটনা ঘটে হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের রেমা-কালেঙ্গা বনের পাশের হাতিমারা চা-বাগানে। সেখানে গির্জাঘর এলাকাটি পুড়েছে টানা তিন মাস ধরে। চা-বাগান সম্প্রসারণের জন্য পরিকল্পিতভাবে আগুন দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

বন বিভাগ জানিয়েছে, অনুমতি ছাড়াই চা-বাগান কর্তৃপক্ষ গাছপালা কেটেছে। এ ঘটনায় বন বিভাগ হাতিমারা চা-বাগানের ব্যবস্থাপকের বিরুদ্ধে একটি মামলা করে। এর পরও বন্ধ হচ্ছে না আগুন। অন্তত তিন দফায় কয়েকটি টিলাসহ গির্জাঘর এলাকার ১৫-১৬ একর জায়গায় আগুন লাগানো হয়েছে।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের বাঘমারা এলাকায় আগুন লাগে গত ১৮ মার্চ সন্ধ্যায়। আগুনে বনের ওই অঞ্চলের স্টুডেন্ট ডরমিটরি লেক ও হিড-বাংলাদেশের পাশের কমপক্ষে এক একর এলাকা পুড়ে যায়। খবর পেয়ে বন বিভাগের লাউয়াছড়া বিট ও রেঞ্জ কর্মকর্তারা বনরক্ষী ও বনজীবীদের নিয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নেভান।

মৌলভীবাজারের আরেক উপজেলা কুলাউড়ার বন বিভাগের সমনভাগ বিটের মাখালজোড়া, আলমবাড়ী ও ধলছড়ার বনভূমিতে এ মাসের প্রথম সপ্তাহে আগুন লাগে। এলাকাটি পাথারিয়া হিল রিজার্ভ ফরেস্টের অধীন। আগুনে বনের ছোট-বড় ১২টি টিলাসহ প্রায় ১০০ একর বনভূমির কয়েক হাজার গাছ, বাঁশঝাড় ও লতাগুল্ম পুড়ে যায়। ওই সময় প্রাণভয়ে বনে থাকা কয়েকটি বন্য হাতি ভারত সীমান্তের গভীর জঙ্গলের দিকে পালিয়ে যায় বলে জানিয়েছে স্থানীয় লোকজন।

এ বিষয়ে বড়লেখা সমনভাগ বিট কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. নুরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘উপকারভোগীদের মাধ্যমে ২০ হেক্টর জায়গায় একটি আগর বাগান করা হবে। সে জন্য বন কেটে পরিষ্কার করা হচ্ছে। আগুন লাগার ব্যাপারটি এখানে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। হয়তো কেউ বিড়ি খেয়ে এখানে ফেলে দিয়েছে আর সেখান থেকে আগুন লেগে বনের চার-পাঁচ হেক্টর ভূমি পুড়ে গেছে।’

বড়লেখা রেঞ্জ কর্মকর্তা শেখর রঞ্জন দাস বলেন, ‘বিষয়টি তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিভাবে আগুন লেগেছে, তা খতিয়ে দেখা হবে।’

গত ১৮ ও ১৯ মার্চ টানা দুই দিন মৌলভীবাজারের জুড়ীর লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনের দিলকুশ ও শুকনাছড়ার প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা আগুনে পুড়েছে। এতে বনের ওই অংশের ছোট গাছপালা, লতাগুল্মের পাশাপাশি পুড়ে যায় বিভিন্ন প্রজাতির সরীসৃপ ও কীটপতঙ্গ।

স্থানীয়দের অভিযোগ, এ আগুন পরিকল্পিত। তা ছাড়া আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে বন কর্মকর্তার গাফিলতি ছিল।

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, আইন ও বিধি-বিধান অমান্য করে চা-বাগান কর্তৃপক্ষের টানা তিন মাস ধরে দফায় দফায় একই স্থানে আগুন দেওয়ার ঘটনা খুবই দুঃখজনক।

তবে বনে আগুন দেওয়ার ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের ও সাধারণ ডায়েরি করা থেকে শুরু করে সব ধরনের আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও দাবি করেন এই বন কর্মকর্তা।

গত ৪ মার্চ গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার সিমলাপাড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলে আগুন লাগে। বনবিট অফিসের ১০০ গজের মধ্যে এ আগুন লাগলেও নেভাতে সময় লাগে দুই দিন। শাল ও গজারি বন দখলের উদ্দেশ্যে এই আগুন লাগানো হয় বলে সে সময় অভিযোগ ওঠে।

এ ছাড়া গাজীপুরের কালিয়াকৈরে চন্দ্রা বিট অফিসের ২০০ গজের মধ্যে সংরক্ষিত শাল-গজারি বনে আগুন লাগে ১০ মার্চ। আগুনে কয়েক একর বনভূমি পুড়ে যায়। এমনিতেই এ অঞ্চলের বনগুলো দখলের কারণে ছোট হয়ে এসেছে বলে জানায় স্থানীয় লোকজন।

দিনাজপুর সদরের বীরগাঁও জাতীয় উদ্যানের শালবনে আগুন লাগে গত ১৩ মার্চ। আগুনে শতবর্ষী গাছও পুড়ে গেছে জানিয়ে পরিবেশকর্মী রবি কস্তা বলেন, জায়গাটিতে মায়া হরিণ, হনুমান, বুনো শূকর, বানরসহ নানা প্রজাতির বন্য প্রাণী থাকত। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলায় এরা আবাসস্থল হারিয়েছে। বেশ কয়েকটি প্রাণী ও শত শত পাখি মারা গেছে। রবি কস্তা জানান, পুড়িয়ে বন উজাড়ের ঘটনাটি তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে জানানোয় তাঁকে হুমকি দিচ্ছে একটি মহল।

ময়মনসিংহের ভালুকার হবিরবাড়ী রেঞ্জের রাধুরভিটা বনে দুর্বৃত্তরা আগুন দেয় গত ১৩ মার্চ সন্ধ্যায়। বনের প্রায় এক একর এলাকায় এ আগুন লাগানো হয়। বন বিভাগের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ওই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে মাইনউদ্দিন নামের এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়।

এ ছাড়া টাঙ্গাইলের সখীপুরের শাল-গজারি ও সামাজিক বনায়নে গত ৭ মার্চ আগুন লাগে। এলাকাবাসী জানায়, আগুনে সখীপুরের বল্লাচালা, দেওয়ানপুর, হিঁদুরচালা, সাপিয়াচালা, হানুরচালাসহ বিভিন্ন স্থানে গাছপালা, কীটপতঙ্গ ও লতাগুল্ম পুড়ে যায়। মূলত বনের জমি দখলের উদ্দেশ্যে প্রভাবশালীদের পক্ষের দুর্বৃত্তরা এ আগুন লাগায় বলে অভিযোগ ওঠে।

পরিবেশকর্মী ও স্থানীয়রা জানায়, আগে রাতে চুরি করে বনের গাছ কেটে নিয়ে যেত দুর্বৃত্তরা। সাম্প্রতিক সময়ে কৌশল পাল্টে গাছচোর চক্র বনে আগুন দিয়ে পরে সুবিধামতো সময়ে গাছ নিয়ে যায়।

পরিবেশকর্মীরা বলছেন, বনে আগুন লাগার ঘটনাগুলো রহস্যজনক। আগুন লাগার অনেক পরে আগুন নেভাতে উদ্যোগী হন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। আগুন লাগলেই দায়সারা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়; এমনকি কমিটির প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখছে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঘনবসতির এই ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে বন ও বন্য প্রাণী ধ্বংসের কারণে ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয় হবে। এর ফলে বাংলাদেশে যে মানবিক বিপর্যয় নেমে আসবে, তার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিবেচনা করে সবাইকে বন রক্ষায় সচেতন হওয়া উচিত।’

 

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/03/21/1263208