২১ মার্চ ২০২৩, মঙ্গলবার, ৫:০০

খাতুনগঞ্জে বেচাকেনা ৩০% কমেছে

দেশে ভোগ্য পণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে বেচাবিক্রি অন্তত ৩০ শতাংশ কমেছে। অথচ পবিত্র রমজান মাস সামনে রেখে এই বাজার এখন ক্রেতার ভিড়ে জমজমাট থাকার কথা।

বিক্রি কমে যাওয়ার পেছনে তিনটি কারণের কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা। ভোগ্য পণ্যের দাম গত বছরের চেয়ে বেশি থাকায় চাহিদা কমে যাওয়া, খাতুনগঞ্জের বাইরে বিভিন্ন উপজেলা সদরে পাইকারি বাজার ছড়িয়ে পড়া এবং চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কে ওজন স্কেলের কড়াকড়ি।

এই ব্যাপারে খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ছগীর আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আর্থিক সক্ষমতা কমে যাওয়ায় ভোক্তার চাহিদা কমেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এর পরও বেচাকেনা হতো, কিন্তু চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কের ওজন স্কেল চট্টগ্রামভিত্তিক আমদানিকারক, আড়তদার, পাইকারি ব্যবসায়ীদের পথে বসিয়েছে। স্কেল বৈষম্যের কারণে পরিবহন খরচ বাড়তি হওয়ায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে আমদানি পণ্য এখন সড়কপথে কেউ নিতে চায় না। এ কারণে বড় শিল্প গ্রুপগুলো আমদানি পণ্য বন্দরের বহির্নোঙরে নামিয়ে ছোট জাহাজে করে সরাসরি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘আগে পুরো দেশের মোট আমদানির ৪০ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করত এই খাতুনগঞ্জ। এখন সেটি ২০ শতাংশে নেমেছে। এবার সবচেয়ে কম বেচাকেনা হচ্ছে এই বাজারে।’

বেচাকেনা কমে যাওয়ার প্রমাণ মেলে খাতুনগঞ্জের প্রধান সড়ক দেখে। এই সড়কে যত বেশি ট্রাফিক জ্যাম, তত বেশি বেচাকেনা—এমন ধারণা ছিল সব ব্যবসায়ীর। এখন আর সেই জ্যাম নেই।

গত রবিবার সরকারি কর্মদিবসে গিয়ে দেখা গেছে, গাড়ির দীর্ঘ লাইন নেই। শ্রমিকদের ট্রাকে পণ্য ওঠানামার সেই ব্যস্ততাও নেই। কিছু ঠেলাগাড়ি, রিকশাভ্যান ও ছোট পিকআপ থেকে পণ্য মাথায় নিয়ে ট্রাকে বোঝাই করছে। বড় ট্রাক আছে হাতে গোনা কয়েকটি। নেই কোনো জটলা।

অ্যাগ্রো কমোডিটি ইমপোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের কার্যকরী সভাপতি আবসার উদ্দিনও মনে করেন, শবেবরাতের পর বিভিন্ন কারণে খাতুনগঞ্জে জমজমাট বেচাকেনার ধরন পাল্টেছে। দামের ওঠানামার ভয়ে খুচরা ব্যবসায়ীরা এখন একসঙ্গে সব পণ্য কিনে রাখেন না। তেমনি ভোক্তারাও এবার মাসের সব পণ্য একসঙ্গে কিনছে না। কারণ সব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতার আর্থিক সক্ষমতা কমে গেছে।

তিনি বলেন, এবার ঋণপত্র জটিলতা, ডলার সংকটসহ নানা কারণে চাহিদার উদ্বৃত্ত আমদানি হয়নি। ফলে বেচাকেনা জমজমাট হচ্ছে না।

খাতুনগঞ্জের বড় আড়ত তৈয়্যবিয়া স্টোরের মালিক সোলায়মান বাদশা বলছেন, শবেবরাতের পরই মূলত পাইকারি বাজারে বেচাকেনা বেড়ে যেত। পাইকারি বাজার থেকে কিনে রমজানের শুরুতে পণ্য বিক্রি করতেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। এবার তো মনে হচ্ছে, বেচাকেনা ৫০ শতাংশ কমেছে।

তিনি বলেন, আগে জাহাজে আসা পণ্য বন্দরে নামিয়ে সরাসরি চলে আসত খাতুনগঞ্জে। এখন বন্দরে না এনে বহির্নোঙর থেকে নিজেদের জাহাজেই পণ্য সরাসরি নৌপথে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাচ্ছে বড় আমদানিকারকরা। এতে তাদের পরিবহন খরচ কম পড়ছে। সড়কপথে ওজন স্কেল বৈষম্যের কারণে আমাদের পণ্য পরিবহন খরচ বেশি। ফলে চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী সবাই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছেন। এতে বেচাকেনা কমেছে।

আড়তদাররাও স্বীকার করেছেন, খাতুনগঞ্জের একচেটিয়া ব্যবসা এখন আর নেই। বিভিন্ন কারণে সেটি এখন উপজেলা সদরে ছড়িয়ে পড়েছে। হিলি স্থলবন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আমদানি হয়ে সরাসরি চকরিয়া চলে যাচ্ছে, খাতুনগঞ্জ আসছে না। টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে আসা পণ্য চট্টগ্রাম না এসে মাঝপথে কক্সবাজারের বিভিন্ন মোকামে চলে যাচ্ছে।

এ ব্যাপারে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য আমদানিকারক জারিফ ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক মনজুর মোরশেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টেকনাফ দিয়ে আসা পণ্য আমদানিকারকের কাছ থেকে কেনার পর সরাসরি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছে যাচ্ছে। আগের মতো খাতুনগঞ্জ প্রবেশের প্রয়োজনীয়তা থাকছে না। আর কক্সবাজারকেন্দ্রিক বিভিন্ন মোকামেও চলে যাচ্ছে আমদানি পণ্য। এ কারণেও খাতুনগঞ্জে বেচাকেনা কমেছে।

ছোলার ক্রেতার আকাল : রমজানে বিক্রি হওয়া ভোগ্য পণ্যের মধ্যে বরাবরই চাহিদার শীর্ষে থাকে ছোলা। বছরে ছোলার চাহিদা থাকে এক লাখ ২০ হাজার টনের মতো। আর শুধু রমজানেই প্রয়োজন এক লাখ টনের। এর মধ্যে সেই ছোলা ভারত ও অস্ট্রেলিয়া হয়ে বাজারে চলে এসেছে। রমজানের আগে ভারত থেকে হঠাৎ করে অনেক বেশি ছোলা বাজারে আসায় ক্রেতার আকাল পড়েছে। অস্ট্রেলিয়ার ভালো মানের ৯০ টাকার ছোলা এখন বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা কেজি। আর ৮৫ টাকা কেজির ছোলা এখন ৭৪ টাকা।

এ ব্যাপারে আড়তদার আশুতোষ মহাজন বলেন, ভারত থেকে আচমকা বিপুল পরিমাণ ছোলা আসাই দাম কমার মূল কারণ। এখন প্রতিযোগিতা করে দাম কমছে। কেনা দামের কমেই বিক্রি করতে হচ্ছে ছোলা। দাম কমবে বলে শঙ্কায় বেশি করে ছোলা কিনতে বাজারে আসছেন না খুচরা ব্যবসায়ীরা।

চিনির চাহিদাও কমেছে : রমজান মাস সামনে রেখে পাইকারি ও খুচরা বাজার—সবখানেই ক্রেতাকে ভোগাচ্ছে চিনি। ঋণপত্র সংকট, ডলারের বিনিময়মূল্য বেড়ে যাওয়া, ডলার সরবরাহ না থাকা এবং বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়ায় উৎপাদন ও সরবরাহ কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে এবার চিনির বাজার চড়া।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে চিনির মোট চাহিদা থাকে প্রায় ২০ লাখ টন। আখ থেকে চিনির উৎপাদন ৩০ হাজার টন। বাকিটা পরিশোধন ও অপরিশোধিত আকারে আমদানি করেই মেটানো হয়। সারা বছর প্রতি মাসে গড়ে চিনির চাহিদা দেড় লাখ টন থাকলেও রমজানে চিনির চাহিদা বেড়ে দ্বিগুণ হয়। অর্থাৎ তিন লাখ টনে উন্নীত হয়।

সেই পরিমাণ চিনি কি এসেছে? : জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে তিন লাখ ২৮ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি এবং ১৩ হাজার ৯২৫ টন পরিশোধিত চিনি আমদানি করেছে বিভিন্ন আমদানিকারক।

২০২২ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে প্রায় চার লাখ ৮৮ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি এবং আট হাজার ৭৭০ টন পরিশোধিত চিনি আমদানি করা হয়েছিল। সেই হিসাবে এক লাখ ৬০ হাজার টন আমদানি কম হয়েছে; কিন্তু গত দুই মাসে রমজানের চাহিদার সমপরিমাণ চিনি আমদানি করা হয়েছে।

এত চিনি আসার পরও দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার চিনি আমদানির ওপর শুল্কহার কমিয়েছে। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজস্ব বোর্ড প্রতি টন অপরিশোধিত চিনি আমদানির ওপর তিন হাজার টাকা এবং পরিশোধিত চিনির ওপর থেকে ছয় হাজার টাকা শুল্ক প্রত্যাহার করেছে। এ ছাড়া চিনি আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশও করেছে।

শুল্ক বিভাগের হিসাবেই শুল্ক কমানোর পর আমদানি পর্যায়ে অপরিশোধিত চিনির মোট আমদানি ব্যয় প্রতি টনে সাড়ে ছয় হাজার টাকা ও পরিশোধিত চিনির আমদানিতে ব্যয় ৯ হাজার টাকা কম দিতে হবে; কিন্তু এর সুফল তো বাজারে পড়েইনি, উল্টো দাম বেড়েছে।

খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে পরিশোধিত বিভিন্ন কম্পানির চিনির দাম প্রতি মণে বেড়েছে ১৫০ টাকা। সেই হিসাবে পাইকারিতে কেজিতে বেড়েছে চার টাকা। টন হিসাবে বেড়েছে চার হাজার টাকা। অর্থাৎ মণপ্রতি সাড়ে ছয় হাজার টাকা শুল্ক ছাড়ের পরও দাম বেড়েছে।

গতকাল সোমবার প্রতি মণ চিনি (৩৭.৩২ কিলোগ্রাম) চার হাজার ৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল তিন হাজার ৯৫০ টাকা।

অন্যতম চিনি সরবরাহকারী এস আলম গ্রুপের এক শীর্ষ কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমদানি নিয়ে কিন্তু সংকট কেটেছে। প্রয়োজন ছিল শুল্ক ছাড়ের, সেটিও করেছে সরকার। ফলে দাম বাড়ার আর কোনো সুযোগ নেই; কিন্তু শুল্ক ছাড়ের সুবিধা নিয়ে আসা চিনি পরিশোধন হয়ে কারখানা থেকে বাজারে আসতে একটু সময় দিতে হবে। সেই চিনি এলেই বাজারে দাম কমপক্ষে পাঁচ টাকা কমবে।’

তেলের দাম পাইকারিতে কমলেও প্যাকেটে সুফল নেই : আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম ক্রমাগত কমলেও দেশে এর সুফল মেলেনি সেভাবে। অথচ ভোজ্য তেলের দাম কমায় শুল্ক ছাড় দিতে দিতে আর অবশিষ্ট নেই। এর পরও দাম নাগালে আসছে না। তবে পাইকারি বাজারে প্রায় সরকার নির্ধারিত দামের কমেই বিক্রি হচ্ছিল ভোজ্য তেল, কিন্তু খুচরায়, বিশেষ করে প্যাকেটজাত তেলে এর প্রভাব একেবারেই পড়েনি। এর মূল কারণ হচ্ছে, প্যাকেটজাত তেলের সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া এবং খুচরায় বাজার তদারকি না থাকা।

রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে এক লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন সয়াবিন তেল ও দুই লাখ ৭০ হাজার টন পাম তেল আমদানি করা হয়েছে। আগের ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে দুই লাখ ৪৫ হাজার টন সয়াবিন তেল ও দুই লাখ ৭৭ হাজার টন পাম তেল আমদানি করা হয়েছিল। সে হিসাবে আমদানিতে খুব বেশি পার্থক্য হয়নি; কিন্তু পাইকারিতে ক্রেতা কম বলছেন।

এ ব্যাপারে ভোজ্য তেলের বড় আড়তদার আরএম এন্টারপ্রাইজের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পাইকারিতে কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখেই দাম নির্ধারিত হয় এবং হয়ে আসছে। ফলে প্রায় সময়ই আমরা সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে কমে তেল বিক্রি করেছি। সমস্যাটা হচ্ছে খুচরায়। কারণ আমরা যতই কমে বিক্রি করি না কেন, খুচরায় না কমলে তো ভোক্তারা এর সুফল পাবে না।’

দাম বাড়ায় পণ্যের চাহিদা কমেছে : সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির হিসাবে, ২০২২ সালে খুচরায় প্রতি কেজি চিনির বিক্রয়মূল্য ছিল ৭৮ থেকে ৮০ টাকা। এবার গতকাল সোমবার বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকা কেজি দরে। দাম বেড়েছে ৪৮ শতাংশের বেশি। বোতলজাত সয়াবিন তেল ২০২২ সালে কিনতে হতো লিটার ১৭০ টাকায়, এখন কিনতে হচ্ছে ১৮৫ টাকায়। সে হিসাবে দাম বেড়েছে সাড়ে ১০ শতাংশ। এক কেজির ৫৮ টাকার প্যাকেট ময়দা এখন কিনতে হচ্ছে ৭৮ টাকায়। এতে দাম বেড়েছে সাড়ে ৩৫ শতাংশ।

সরকারি ওই প্রতিষ্ঠানের হিসাবেই রমজানের এসব পণ্যের দাম অনেক বেড়েছে। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে ভোক্তা কেনা কমিয়েছে।

চট্টগ্রামের কাজীর দেউড়ী খুচরা ব্যবসায়ী হক ভাণ্ডার স্টোরের মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত বছর এক মাসে একজন ভোক্তা মাসিক সাড়ে তিন হাজার টাকার বাজার করলে এখন সেই একই বাজার কিনতে হচ্ছে পাঁচ হাজার টাকায়। ফলে আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে মানুষ কেনা কমিয়েছে। বেছে বেছে একেবারে জরুরি পণ্যই হিসাব করে কিনছে। এই কম কেনার কারণে আমরা কম বিক্রি করছি। আর পাইকারি থেকে আগের তুলনায় কম পণ্য কিনছি।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/03/21/1263183