২১ মার্চ ২০২৩, মঙ্গলবার, ৪:৫০

ঋণশৃঙ্খলা নেই ১৭ ব্যাংকে

আমানত এবং ঋণের যে ভারসাম্যপূর্ণ শৃঙ্খলা থাকা দরকার, সেটা ভেঙে গেছে ১৭ ব্যাংকে। আগ্রাসী ঋণ দিয়েছে প্রচলিত ধারা ও শরিয়াহভিত্তিক এসব ব্যাংক। এতে লঙ্ঘিত হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া সীমা। এ কারণে চরম তারল্য সংকটে পড়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আমানতকারীদের জন্য বাড়তি ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে-এমন শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, ব্যাংকের ঋণশৃঙ্খলা ভেঙে যাওয়ার নেপথ্যে রয়েছে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং বেনামি ঋণ। ব্যাংক খাতে সাম্প্রতিক সময়ে বড় অঙ্কের বেনামি

ঋণ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এভাবে চলতে থাকলে খাতটি ঝুঁকিতে পড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, প্রচলিত ধারার ব্যাংক ১০০ টাকার মধ্যে ৮৭ এবং ইসলামিধারার ব্যাংক ৯২ টাকা ঋণ দিতে পারে। এটিকে ব্যাংকিং পরিভাষায় অ্যাডভান্স ডিপোজিট রেশিও (এডিআর) বা ঋণ-আমানত অনুপাত সীমা বলা হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১-২৬ জানুয়ারি প্রচলিত ধারার ন্যাশনাল ব্যাংকের এডিআর দাঁড়িয়েছে ৯৮ দশমিক ২৩ শতাংশ। অপর একটি ব্যাংকের উভয় ধারায় এডিআর দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৯৬ দশমিক ৬৪ ও ১০৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ, রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের ৯১ দশমিক ১৭, ওয়ান ব্যাংকের ৮৯ এবং বিদেশি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের এডিআর ৮৭ দশমিক ৫২ শতাংশ। এসব ব্যাংকে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে। এছাড়া কমিউনিটি ব্যাংকের ৮৮ দশমিক ২৮, অপর একটি ব্যাংকের ৮৮ দশমিক ০৫ এবং আইএফআইসি ব্যাংকের এডিআর ৮৭ দশমিক ৪৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

এছাড়া ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সীমার বাইরে বিনিয়োগের তালিকায় থাকা এক্সিম ব্যাংকের ১০০ দশমিক ২৮, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৯৬ দশমিক ২৮, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ইসলামিক উইন্ডোর ১৫৫ দশমিক ০৯ এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ইসলামিক উইন্ডোর এডিআর ১০৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এর বাইরে আরও পাঁচটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের এডিআর যথাক্রমে ১০৪ দশমিক ৫৪, ১০২ দশমিক ২৭, ১০০ দশমিক ৪১, ৯৬ দশমিক ৮১ এবং ৯৩ দশমিক ০১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘আমানতের বিপরীতে সীমার বাইরে ঋণ দিলে ঋণশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়। এছাড়া ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায়ের চিত্রও এখন খুব একটা সন্তোষজনক নয়। এমতাবস্থায় অতিরিক্ত ঋণ দিয়ে যদি খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যায়, তাহলে ব্যাংকের পাশাপাশি আমানতকারীদেরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ জরুরি।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘আমানতের বিপরীতে কত টাকা ঋণ দিতে পারবে, এর একটি সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। তবে ব্যাংকগুলোর এ অনুপাত বিভিন্ন সময় ওঠানামা করে। কারণ, কোনো ব্যাংকের যদি বড় একটি আমানত আসে, তাহলে সেই ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা বেড়ে যায়। একইভাবে হঠাৎ করে কোনো গ্রাহক আমানত তুলে নিলে তখন ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। তখন ব্যাংক তার এডিআর সীমার বাইরে চলে যায়। এছাড়া ঋণ আদায়ে বিশেষ ছাড় দিলেও এটা হতে পারে। বিষয়টি সাময়িক এবং আপেক্ষিক। তবে দীর্ঘদিন কোনো ব্যাংক এডিআর সীমার বাইরে থাকলে সেই ব্যাংককে অবশ্যই চিঠি দিয়ে সতর্ক করা হবে। অস্বাভাবিক কিছু ঘটলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।’

একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) যুগান্তরকে জানান, ঋণ দেওয়ার যে সীমা বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, তা নিঃসন্দেহে অনেক হিসাবনিকাশ করে দিয়েছে এবং তা যথেষ্ট বৈশ্বিক মানের। সেই সীমা অতিক্রম করা ঠিক নয়। এতে ব্যাংক খাতে ঝুঁকি তৈরি করবে। বিশেষ করে আমানতকারীরা বেশি ঝুঁকিতে থাকবেন। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে কয়েকটি ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না।

ব্যাংকসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলোকে নির্ধারিত আইনে ঋণ বা বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে টানা পাঁচবার এডিআর সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরও অনেক ব্যাংক এটি সমন্বয় করতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে গতিশীলতা আনা, ব্যাংক খাতের সার্বিক তারল্য পরিস্থিতির উন্নয়নে এডিআর ২ শতাংশ বাড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরও কিছু ব্যাংক সীমা লঙ্ঘন করে আমানতকারীদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/656775