২১ মার্চ ২০২৩, মঙ্গলবার, ৪:৪৯

সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছেই না

পদ্মা সেতু প্রকল্পের অধীন মাদারীপুরের শিবচরে এক্সপ্রেসওয়েতে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনায় সড়কের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। সড়কে প্রায় প্রতিদিনই দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু হলেও এক্সপ্রেসওয়েতে বড় দুর্ঘটনায় আতঙ্ক বেড়েছে। এতবড় দুর্ঘটনা কেন ঘটছে এই নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও চালকের অবহেলার কারণকেই প্রাথমিকভাবে দায়ী করছেন যাত্রী ও পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পরিবহন আইন যথাযথ বাস্তবায়ন হলে য়তো এতগুলো মানুষের প্রাণহানি ঘটতো না। অনেকেই বলছেন-সড়কে মৃত্যুর মিছিল কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না; বরং বেড়েই চলছে।

এক্সপ্রেস ওয়েতে রোববারের দুর্ঘটনার বিষয়ে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণের পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন-দুর্ঘটনার কারণ যাই হোক, পদ্মা সেতুতে ওঠার আগের এই সড়কটিতে নিরাপত্তাবেষ্টনী না থাকায় হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি হয়েছে। বাঁধের মতো সড়কটি মাটি থেকে প্রায় আট ফুট উঁচুতে। নিয়ম অনুযায়ী, এমন সড়কে নিরাপত্তাবেষ্টনী থাকা বাধ্যতামূলক। যদি নিরাপত্তাবেষ্টনী থাকত তাহলে দুর্ঘটনা ঘটলেও ক্ষতি কম হতো। বাস উল্টে খাদে না পড়লে এত মানুষের মৃত্যু হতো না। আর গাড়িটির গতি ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি ছিল বলেও অভিযোগ যাত্রীদের।

পরিবহনবিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক নিরাপদ করার কথা সরকার মুখে যেভাবে বলছে বাস্তবে সেভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের উদ্যোগে উদাসীনতা দেখা যায়। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে এবং নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে কী করণীয়, তা সরকারের অজানা নয়। কিন্তু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থের কারণে প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা বাস্তবায়নে সরকার যথেষ্ট উদ্যোগী নয়। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকাংশই হতদরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৮১ শতাংশ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতরা তাদের পরিবারের প্রধান বা একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ফলে এসব পরিবার আর্থিকভাবেও সংকটে পড়ছে। নতুন ‘সড়ক আইন ২০১৯’ মানুষের মনে আশা জাগিয়েছিল। তবে তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, সড়কে আইন মানছে না কেউ। সড়কে আইন মানতে বাধ্য করা হয় না। ফলে সড়কে নৈরাজ্য থামছে না। যারা সড়কে আইন মানানোর কাজ করেন তারাই আইন মানেন না। নতুন সড়ক আইন পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে পড়ে তা রহিত করতে বাধ্য হয় সরকার। দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত চালকদের বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে আসার ঘটনাও বিরল। দেখা গেছে, প্রায় সব কটি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই চালকরা পার পেয়ে যায়।

এদিকে বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে ৬ হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৯ হাজার ৯৫১ জন। সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির এই সংখ্যা গেলো ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ১২ হাজার ৩৫৬ জন। এছাড়া রেলপথে আরও ৬০৬টি দুর্ঘটনা নিহত হয়েছেন ৫৫০ জন, আহত ২০১ জন এবং নৌ-পথে ২৬২ দুর্ঘটনায় নিহত ৩৫৭, আহত ৩১৮ এবং নিখোঁজ রয়েছেন ৭৪৩ জন। সংস্থাটির দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের বার্ষিক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২১ সালের চেয়ে ২০২২ সালে সড়কে দুর্ঘটনা ১৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ ও প্রাণহানি ২৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেড়েছে। বিগত আট বছরে নিবন্ধিত যানবাহনের পাশাপাশি ছোট যানবাহন বিশেষ করে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের সংখ্যা চারগুণ বাড়ার পাশাপাশি ইজিবাইক, মোটরসাইকেল ও থ্রি-হুইলার সরকারি আদেশ অমান্য করে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে অবাধে চলাচলের কারণে বিগত আট বছরের মধ্যে ২০২২ সালে সড়কে সর্বোচ্চ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে বলে পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। সড়কে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ৩ হাজার ৯০ জন চালক, ১ হাজার ৫০৩ জন পথচারী, ৭৪২ জন পরিবহন শ্রমিক, ৮৮৫ জন শিক্ষার্থী, ১৩২ জন শিক্ষক, ২৮৩ জন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ১ হাজার ১৫০ জন নারী, ৭৯৪ জন শিশু, ৪৪ জন সাংবাদিক, ৩১ জন চিকিৎসক, ১৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা, ৫ জন শিল্পী, ৯ জন আইনজীবী, ২৯ জন প্রকৌশলী এবং ১৬৮ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর পরিচয় মিলেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিগত (২০২১) বছরের চেয়ে গত বছর (২০২২) ছোট যানবাহনের সংখ্যা হঠাৎ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাওয়া এবং এসব যানবাহন জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে অবাধে চলাচলের কারণে আঞ্চলিক মহাসড়কে ১২ দশমিক ৭৩ শতাংশ, জাতীয় মহাসড়কে ৩ দশমিক ৮১ শতাংশ, রেলক্রসিংয়ে ০ দশমিক ১৬ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে। তবে ফিডার রোডে ৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ দুর্ঘটনা কমেছে। ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি সংঘটিত হয়েছে ১৫ জুলাই। এ দিনে ৩৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩ জন নিহত ও ৯৭ জন আহত হয়েছেন। আর সবচেয়ে কম সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে ৬ সেপ্টেম্বর। এ দিন ৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১২ জন নিহত এবং ১৩ জন আহত হয়েছেন। সড়ক দুর্ঘটনায় একদিনে সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছেন ২৯ জুলাই। এ দিন ২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৪ জন নিহত এবং ৮৩ জন আহত হয়েছেন। আর সবচেয়ে বেশি আহত হয়েছে ১১ জুলাই। এই দিনে ২৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৭ জন নিহত ও ১২৪ জন আহত হয়েছেন।

এসব দুর্ঘটনার বেশ কিছু কারণ উঠে এসেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি নামে আরেকটি সংস্থার পর্যবেক্ষণে। সংস্থাটির মতে, বেশিরভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে বেপরোয়া গতি, বিপদজনক অভারটেকিং, রাস্তাঘাটের নির্মাণ ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের অবাধে চলাচল, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চালকের অদক্ষতা ও চালকের বেপরোয়া মনোভাবসহ বিভিন্ন কারণে। সরকারি হিসেবে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ হাজার ৩৬০ জনের মৃত্যু ছাড়াও প্রায় ৮০ হাজার মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করছেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। এছাড়াও কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেড ফোন ব্যবহার, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো, রেলক্রসিং ও মহাসড়কে হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা, রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা ফুটপাত বেদখলে থাকা, ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ ও ট্রাফিক আইন অমান্য করা প্রভৃতি। এসব কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বেপরোয়াভাবে বাড়ছে বলে মনে করছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। আর এসব সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বেশ কিছু সুপারিশও করা হয়েছে সংস্থাটির পক্ষ থেকে। সুপারিশে বলা হয়েছে, সড়ক নিরাপত্তায় বর্তমান সরকারের নির্বাচনি ইশতেহার বাস্তবায়ন করা; আইনের ত্রুটি চিহ্নিত করে সংস্কারপূর্বক ডিজিটাল পদ্ধতিতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ ও বিধিমালা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা; সড়ক নিরাপত্তায় বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো; সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে আলাদা সড়ক নিরাপত্তা ইউনিট গঠন করা এবং সড়ক নিরাপত্তায় ইতোমধ্যে প্রণীত যাবতীয় সুপারিশমালা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এছাড়াও দেশের সড়ক-মহাসড়কে রোড সাইন (ট্রাফিক চিহ্ন) স্থাপন করা; জেব্রা ক্রসিং অঙ্কন করা; গণপরিবহন চালকদের পেশাদার ট্রেনিং ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা; সড়ক পরিবহন সেক্টরে অনিয়ম-দুর্নীতি ও চাদাঁবাজি বন্ধ করাসহ বেশ কিছু সুপারিশ করেছে।

https://dailysangram.com/post/519872