সম্প্রতি পশ্চিম বাংলা সরকার কর্তৃক তিস্তা নদীর পানি তাদের বাস্তবায়নাধীন একটি সেচ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে ব্যবহার করার লক্ষ্যে গতিপথ পাল্টিয়ে প্রকল্প এলাকায় প্রবাহিত করার জন্য দুটি খাল খননের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের নিকট তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করার অনুরোধ জানিয়ে একটি পত্র দিয়েছে বলে জানা গেছে। পত্রে তিস্তার পানি প্রত্যাহারের এই সিদ্ধান্তকে একতরফা আখ্যায়িত করে বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টি ভারত সরকারকে অবহিত করা হয় এবং তিস্তার চুক্তি সম্পাদনের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদী এবং আমাদের উত্তরাঞ্চলের প্রায় ১৫টি জেলা তিস্তার পানির উপর নির্ভরশীল। এই জেলাগুলো সেচ চাহিদা পূরণ করার জন্য ইতোমধ্যে বাংলাদেশ তিস্তানির্ভর একটি বৃহৎ সেচ ও পানি নিষ্কাশন প্রকল্পের নির্মাণ কাজও সম্পন্ন করেছে এবং কয়েক দশক ধরে সম অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পানি পাওয়ার চুক্তি সম্পাদনের জন্য ভারত সরকারের ‘অনুকম্পা’ কামনা করে আসছে। ২০১১ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং-এর বাংলাদেশ সফরের সময় এই পানি ভাগাভাগি নিয়ে একটি চুক্তি সম্পাদনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বিরোধিতায় তা আর হয়নি। ঐ সময় অনেকেই ধারণা করেছিলেন যে, বাংলাদেশ তিস্তার পানিচুক্তি সম্পাদিত না হলে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেবে না এবং এ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করবে না। কিন্তু তা হয়নি, বাংলাদেশ ভারতকে তার চাহিদা অনুযায়ী ট্রানজিট, করিডোর, সমুদ্র ও নদীবন্দর, রেলওয়ে সবকিছু ব্যবহারের সুবিধাই শুধু দেয়নি বরং সম্পূর্ণ আঞ্চলিক উৎসসম্পন্ন ফেনী নদীর পানিও ভারতকে দিয়ে দিয়েছে। এর প্রতিবাদ করে ফেসবুকে স্টেটাস দেয়ায় আবরার নামক প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের একজন ছাত্রকে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে এ পর্যন্ত যত চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে অথবা সম্পাদনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে সেগুলোর বিস্তারিত তথ্য আমরা বাংলাদেশের বাসিন্দারা জানি না। এ প্রেক্ষিতে ২০১১ সালে দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকায় খসড়া তিস্তা চুক্তিতে পানি ভাগাভাগির যে তথ্য এসেছে তার কোথাও ৫০:৫০, অথবা কোথাও ৫২:৪৮-এর ভিত্তিতে পানি ভাগাভাগির কথা উল্লেখ ছিল। টাইমস অব ইন্ডিয়া ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মেয়াদে বাংলাদেশকে ৩৩ হাজার এবং ভারতকে ৫০ হাজার কিউসেক পানি দেয়ার কথা উল্লেখ ছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, যে সময়ের কথা এতে উল্লেখ করা হয়েছে সে সময়ে বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবিত পানি অপর্যাপ্ত বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী শুষ্ক মওসুমে আমাদের পর্যাপ্ত পানির নিশ্চয়তা প্রয়োজন। খসড়া চুক্তিতে তা ছিলো না। কিন্তু তথাপি ওয়েস্ট বেঙ্গল পলিওশন কন্ট্রোল বোর্ড কঠোরভাবে এই চুক্তির বিরোধিতা করেছে। বাংলাদেশের অনেকেই জানেন না যে, পশ্চিম বাংলা সরকার ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদনক্রমে একটি বিশাল সেচ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এবং এই উদ্দেশ্যে তিস্তা নদীর গজলডোবা পয়েন্ট ছাড়াও মহানন্দা এবং ডাওক নদীর ওপর তিনটি বাঁধ তৈরি করেছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে তারা ৯.২২ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান ছাড়াও ৬৭.৫০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে এজন্য মোট ব্যয়ের ৯০ শতাংশ অনুদান হিসেবে প্রদান ঘোষণা দেয়া হয়েছে এবং কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রকল্পটিকে জাতীয় প্রকল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং ২০১০ সালে এই উদ্দেশ্যে ২৯৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে ২০১৫ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার সময়সীমাও বেঁধে দেয়া হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী এই সময়ের মধ্যে যদি প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত না হয় তাহলে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক প্রদত্ত অর্থ রাজ্য সরকারকে ঋণ হিসেবেই গ্রহণ করতে হবে বলে সতর্ক করে দেয়া হয়। আরো জানা গেছে যে, এই প্রকল্পের অধীনে সেচ খাল, সেচ নালা ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণের জন্য ১৫০০০ হেক্টর জমির প্রয়োজন। যার মধ্যে ২০১০ সাল যাবৎ রাজ্য সরকার ১০৫০০ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করেছিল। অবশিষ্ট জমি অধিগ্রহণের ব্যাপারে ক্ষমতায় আসার আগে মমতা ব্যানার্জী আপত্তি তুলেছিলেন। ক্ষমতায় আসার পর এই বিষয়টি তার মন্ত্রিসভায় পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করা হয়। এই অবস্থায় তিস্তা প্রকল্পের স্বার্থে শুধু পশ্চিমবঙ্গ সরকার নয়, কেন্দ্রীয় সরকারও বাংলাদেশকে তিস্তার পানির হিস্যা দিতে আদৌ আন্তরিক কিনা সে ব্যাপারে আমি সন্দিহান।
এই চুক্তি নিয়ে ইতোমধ্যে West Bengal Pollution Control Board থেকে অনেকগুলো প্রশ্ন তোলা হয়েছে। তাদের দৃষ্টিতে প্রথমত তিস্তা নদীর মাত্র ১৬ শতাংশ বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে এবং এ দেশটির তিস্তা বিধৌত এলাকার পরিমাণ হচ্ছে ১২৩৬১ বর্গ কিলোমিটার। এই এলাকায় যে বৃষ্টিপাত হয় তার ফলে সৃষ্ট পানির পরিমাণ হচ্ছে ২.১১৭ বিলিয়ন ঘনমিটার। পক্ষান্তরে ভারতীয় এলাকায় বৃষ্টির ফলে প্রাপ্ত পানির পরিমাণ হচ্ছে ১২.২৬ বিলিয়ন ঘনমিটার। Pollution Control Board-এর দেয়া তথ্য অনুযায়ী জুলাই মাসে তিস্তার প্রবাহ হচ্ছে সর্বোচ্চ ৭০,০০০ কিউসেক এবং জুন-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই নদীর পানি প্রবাহ পর্যাপ্ত হলেও শুষ্ক মওসুমে তা ৩৫০০-৪০০০ কিউসেকে নেমে আসে। তারা মনে করেন যে, পানি ভাগাভাগি করতে হলে এই বিষয়গুলোকে অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। এর দুটি অর্থ দাঁড়ায়, একটি হচ্ছে শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশ কোন পানিই পেতে পারে না এবং দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে বাংলাদেশকে যদি পানি দিতেই হয়, তাহলে ঐ সময়ের প্রবাহে ৬-৭ শতাংশের বেশি দেয়া যায় না। এখন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী রাজনীতিকরা সমস্যার গভীরতা অনুধাবন করার চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
এখন আমি আন্তর্জাতিক নদীর পানি বণ্টন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী উজানের যে কোন দেশ ভাটির দেশকে নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা দিতে বাধ্য। যে নদীর প্রবাহ নির্দিষ্ট কোনও দেশের নিজস্ব সীমানা ও ভূখন্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় এবং তা তার সীমানা পেরিয়ে অন্য দেশের ভূখন্ডের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সেই নদীর পানির ওপর উজান ভাটি উভয় দেশের অধিকার সমান। এ প্রেক্ষিতে একক সিদ্ধান্তে কোনও দেশ যেমন তার ওপর দিয়ে প্রবাহিত আন্তর্জাতিক কোনও নদীর পানি প্রত্যাহার করতে পারে না, তেমনি ভাটির দেশে পানি প্রবাহে বাধার সৃষ্টি কিংবা নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কোনও পদক্ষেপও গ্রহণ করতে পারে না। ১৯১১ সালে ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ল-এর উদ্যোগে সম্পাদিত মাদ্রিদ চুক্তিতে পরিষ্কার বলা হয়েছে: “A state is forbidden to stop or divert the flow of a river which runs from its own to a neighboring state but likewise to make such use of the water of the river as either causes danger to the neighboring state or prevent it from making proper use of the flow of the river on its part” আবার একই বিষয়ে হেলসিংকি বিধিমালার (Helsinki Ruls) ৪নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে -
“Each basin state is entitled, within its territory to a reasonable and equitable share in the beneficial uses of the waters of an international drainage basin.”
আন্তর্জাতিক আইন এবং চুক্তিসমূহে বিধৃত এই নীতিমালাগুলো অত্যন্ত পরিষ্কার। এখানে স্বেচ্ছাচার বা অযৌক্তিকভাবে আন্তর্জাতিক নদী ও স্রোতধারাসমূহের পানি সরবরাহ থেকে কোনও দেশকে বঞ্চিত করা যায় না। কাজেই উজানের দেশ কিংবা নদীর উৎসস্থল হিসেবে বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন নদীর পানি থেকে ভারত বাংলাদেশকে বঞ্চিত করার কোনও সুযোগ নেই।
১৯৯৭ সালে এ ব্যাপারে জাতিসংঘের সাধারণ কাউন্সিলে গৃহীত Convention on the Law of non navigational uses of international water courses ও প্রণিধানযোগ্য। এতে সহযোগিতা ও সমবায়ের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক নদীসমূহের পানি ব্যবহারের আইনি কাঠামো প্রদান করা হয়েছে যা অনুসরণ করা সদস্য দেশগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক। এতে নদীর পানির ব্যবহারকে দু’ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। এর একটি হচ্ছে Consumptive use এবং অন্যটি non-consumptive use. consumptive use হচ্ছে পানির ঐসব কাজে ব্যবহার যাতে নদী থেকে পানি প্রত্যাহৃত হয় এবং এর ফলে পানির প্রবাহ ও গভীরতা হ্রাস পায়। নৌচলাচলের কাজে পানির ব্যবহার হচ্ছে non-consumptive use. এর ফলে নদীর পানি হ্রাস পায় না। জাতিসংঘের এই Law convention-এ ১৯৬৬ সালের হেলসিংকি বিধিমালায় বিধৃত আন্তর্জাতিক ওয়াটার কোর্সের সংজ্ঞার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা হয়। হেলসিংকি বিধিতে এই সংজ্ঞায় নিষ্কাশন অববাহিকার ধারণা ব্যবহৃত হয়েছিল। কনভেনশনে এই সংজ্ঞা পাল্টিয়ে একে বলা হয়েছে, “A system of surface waters and ground waters constituting by virtue of their physical relationships a unitary whole and normally flowing into a common terminus... parts of which are situated in different states’ (Article 2(a), (b)। বলা বাহুল্য, এখানে আন্তর্জাতিক নদী বা পানি প্রবাহকে শুধুমাত্র ভূউপরিস্থিত প্রবাহের মধ্যে সীমিত রাখা হয়নি, ভূগর্ভস্থ পানি পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়েছে। জাতিসংঘ কনভেনশন কর্তৃক গৃহীত আন্তর্জাতিক নদী সংক্রান্ত এই আইনগত কাঠামোর বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে :