২০ মার্চ ২০২৩, সোমবার, ৪:৩৩

নকশায়ও নিরাপত্তাবেষ্টনী নেই

ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে নিরাপত্তাবেষ্টনী আছে। কিন্তু পদ্মা সেতু প্রকল্পের অধীন সড়কটির সাড়ে ১১ কিলোমিটার অংশে কোনো নিরাপত্তাবেষ্টনী নেই। গতকাল রবিবার মাদারীপুরের শিবচরে সড়ক থেকে একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আট ফুট নিচে পড়ে যায়। এতে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে আরো ২৫ জন। দুর্ঘটনাটি ঘটেছে সেতু থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে, নিরাপত্তাবেষ্টনীহীন এলাকায়।

জানতে চাইলে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটা ডিজাইনে (নকশায়) ছিল না। যে ডিজাইন দেওয়া হয়েছে সে ডিজাইন অনুযায়ী আমরা কাজ করেছি। এখন এই ডিজাইনে নিরাপত্তাবেষ্টনী যুক্ত করতে হলে বিশেষজ্ঞ মতামত লাগবে। সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমার কাজ ডিজাইন অনুসরণ করা। আমি সেটা করেছি।’
প্রাথমিক পর্যবেক্ষণের পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, দুর্ঘটনার কারণ যাই হোক, সড়কে নিরাপত্তাবেষ্টনী না থাকায় হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি হয়েছে। বাঁধের মতো সড়কটি মাটি থেকে প্রায় আট ফুট উঁচুতে। নিয়ম অনুযায়ী, এমন সড়কে নিরাপত্তাবেষ্টনী থাকা বাধ্যতামূলক। যদি নিরাপত্তাবেষ্টনী থাকত তাহলে দুর্ঘটনা ঘটলেও ক্ষতি কম হতো। বাস উল্টে খাদে না পড়লে এত মানুষের মৃত্যু হতো না।

পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়ের শিবচর উপজেলার কুতুবপুর এলাকায় গতকাল ইমাদ পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসটির দুর্ঘটনার কারণ খুঁজে বের করতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আলাদা দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। একটি কমিটির নেতৃত্ব দেবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), অন্যটির বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)।

পদ্মা সেতুর দুই পাশে ৫৫ কিলোমিটার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। এটি দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে। এই সড়কের পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তের দেড় কিলোমিটার ও জাজিরা প্রান্তের ১০ কিলোমিটার নির্মাণ করেছে পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ। প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাকি সড়কের কাজ করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর।

দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক শামছুল হক। তিনি বলেন, খুলনা করিডরে অবকাঠামোতে এক ধরনের ত্রুটি আছে। নিয়ম বলছে, কোনো সড়ক বাঁধ যদি মাটি থেকে আট ফুট ওপরে হয়, তাহলে ঝুঁকি বিবেচনায় অবশ্যই টানা ‘ডাব্লিউ বিন’ (নিরাপত্তাবেষ্টনী) দিতে হবে। যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেখানে কিন্তু কোনো টানা রেলিং ছিল না।

অধ্যাপক শামছুল হক বলেন, যেকোনো কারণেই হোক না কেন, দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। কিন্তু এত ওপর থেকে গাড়ি নিচে পড়তে দেব কেন? এখানে সমান্তরাল নিরাপত্তাবেষ্টনী কেন দেওয়া হলো না? এখানে অবকাঠামো উন্নয়ন নিরাপদ কি না সে নিরীক্ষাটাও করা দরকার।

বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে বলা হচ্ছে। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কের বাইরে পড়ে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়কে। নিরাপদ সড়ক চাই সংগঠনের ২০২২ সালের সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মোট সাত হাজার ২৪টি দুর্ঘটনার মধ্যে শুধু মহাসড়কে দুই হাজার ৩১৩টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর সড়কের বাইরে বা খাদে পড়ে এবং উল্টে ৮৪৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে।

গতকালের দুর্ঘটনাটি ঘটেছে সোজা পথে, তেমন বাঁক ছিল না। বুয়েটের এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সড়ক দুর্ঘটনার ৮৪ শতাংশ ঘটে অতিরিক্ত গতির কারণে। আর বাঁকের চেয়ে সোজা পথে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। সোজা পথে দুর্ঘটনা ঘটে ৬৭ শতাংশ। বাকিটা সড়কের বাঁকে।

বাসটির ফিটনেস নেই, আগেই দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে : শিবচরের দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিআরটিএর রোড সেফটি শাখার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, একটি গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারানোর অন্যতম কারণ থাকে ফিটনেস না থাকা। যে গাড়িটি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে সেটিরও ফিটনেস ছিল না।
২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে একই গাড়ি গোপালগঞ্জে একটি দুর্ঘটনা ঘটায়। তখন চারজন মারা যায়। এতে সাময়িকভাবে বাসটির চলাচলের অনুমতি বাতিল করা হয়।

তবে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই ফিটনেসবিহীন বাসটি সড়কে চলছিল। এমন ফিটনেসবিহীন বাসের সংখ্যা অনেক, যারা সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। যাদের দেখার দায়িত্ব তারা দেখেও দেখে না।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন বাসটির সব ধরনের অনুমতি চূড়ান্তভাবে বাতিল করা হবে। এর কোনো কাগজের বৈধতা থাকবে না। অনুমতি না থাকার পরও যদি সড়কে চলে, সেটা বাস্তবিক অর্থে বিআরটিএর দেখার সুযোগ নেই। সেটা সড়কে পুলিশ দেখবে। আমরা শুধু তখন বুঝতে পারব যদি বাসটি ফিটনেস রিনিউ করতে আসে। এ ছাড়া সম্ভব নয়। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে বাসটি ফিটনেসের জন্য আসেনি।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/03/20/1262862