২০ মার্চ ২০২৩, সোমবার, ৪:৩১

বাজারে ক্রেতার চাপা কান্না

বাজারের প্রতিটি দোকানে থরে থরে সাজানো ভোগ্যপণ্য। ক্রেতা সমাগমও আছে। তবে নেই কাক্সিক্ষত বেচাকেনা। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে পবিত্র মাহে রমজানের বাকি আর মাত্র দুইদিন। অথচ চট্টগ্রামের হাটবাজারে অন্যবারের মত নেই কোন আমেজ। নজিরবিহীন ভাটা চলছে রোজার পণ্যে চাহিদায়। মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। সাধ থাকলেও কেনার সাধ্য নেই। ছোলা, চিনি, ভোজ্য তেল, ডালসহ রোজার পণ্যের চড়া দামে দিশেহারা সাধারণ মানুষ। স্বল্প ও সীমিত আয়ের ক্রেতার চাপা কান্না এখন বাজারে।

বাজারে রোজায় প্রয়োজনীয় পণ্যসহ ভোগ্যপণ্যের আমদানি সরবরাহ প্রচুর। তবে ক্রেতারা কিনছেন কম। পবিত্র শবে বরাতে ভোগ্যপণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠে। সে ধারায় এখনও চলছে বাজার। ক্রেতারা বলছেন, বাজারে মূল্যকারসাজি চলছে। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে প্রশাসন। এর খেসারত দিচ্ছেন সাধারণ ভোক্তারা। রেকর্ড আমদানির পরও লাগামহীন দ্রব্যমূল্য নাভিশ^াস উঠেছে ক্রেতার।

সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এলসি খোলার বিধি-নিষেধের পাশাপাশি ডলার সঙ্কটে চট্টগ্রাম বন্দরে বিলাসবহুল পণ্য আসা কমলেও ভোগ্যপণ্যের আমদানি বেড়েছে। বিশেষ করে জানুয়ারি মাসে সরকারের দিক নির্দেশনায় বাড়ে ঋণপত্র খোলার হার। তাতে ভোগ্যপণ্যের আমদানি বেড়েছে। বেশকিছু ভোগ্যপণ্য অন্য বছরের তুলনায় বেশি আমদানি হয়েছে। শুধু গত দেড়মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে সাড়ে ১২ লাখ টন ভোগ্যপণ্য নিয়ে ৫০টি জাহাজ ও অয়েল ট্যাঙ্কার ভিড়েছে প্রধান জেটি ও বহির্নোঙরে। এর মধ্যে ৩০টি জাহাজেই ছিল ডাল, গম, চিনি, ভোজ্য তেলসহ রোজার ভোগ্যপণ্য।

ফলে রমজানে ভোগ্যপণ্যের সঙ্কট হবে বলে যে আশঙ্কা করা হয়েছিল তা কেটে গেছে। বিশ^বাজারে বর্তমানে সব ধরনের মূল্য নিম্নগামী। চিনি, সয়াবিন তেলসহ বেশ কয়েকটি পণ্যের ওপর আমদানি শুষ্ককরও প্রত্যাহার করেছে সরকার। কিন্তু এরপরও তার সুফল পাচ্ছে না সাধারণ ভোক্তারা। এজন্য সরকারের দুর্বল তদারকি এবং বাজার ঘিরে মূল্যবৃদ্ধি সিন্ডিকেটকে দায়ী করেন ভোক্তারা। দেশের অন্যতম পাইকারি বাজার চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ ও আছদগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বলছেন, রোজায় প্রয়োজনীয় ছোলা, চিনি, ভোজ্য তেল, চিড়া, ডালজাতীয় পণ্য খেজুর, পেঁয়াজ, গুঁড়ো দুধসহ সব ধরনের পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে।
তবে ডলারের দাম বাড়ায় কিছু পণ্যের দাম বাড়তি। এবার প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকেও বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ, ডাল ও ছোলা আমদানি হয়েছে। ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা, ধীরে ধীরে দাম কমে যাবে। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ভালো মানের ছোলা ৯০-৯৫ টাকা, মাঝারি মানের ৮০-৮৫ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। ৬৫-৭০ টাকায়ও ছোলা মিলছে বাজারে। পাইকারি বাজারে দাম কমতে শুরু করেছে। তবে খুচরা বাজারে এখনও এর কোন প্রভাব নেই। জানুয়ারি থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত আমদানি হয়েছে এক লাখ ৫৭ হাজার টন।

বাজারে সব ধরনের ডালের দাম চড়া। মসুর ডাল মানভেদে (মোটা) ১০০-১১০ এবং দেশি ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চনার ডাল ৮৮-৯০ টাকা। গত আড়াই মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এক লাখ ২১ হাজার মেট্রিক টন মসুর ডাল আমদানি হয়েছে। ভারত থেকেও স্থলবন্দর হয়ে মসুর ডাল আসছে। পাইকারি বাজারে প্রতি মণ চিনি বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার ৯৪০ থেকে তিন হাজার ৯৫০ টাকা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে মণপ্রতি ১০০ টাকারও বেশি এবং কেজিপ্রতি ছয় টাকা করে বেড়েছে। খোলাবাজারে প্রতিকেজি চিনি ১১৫-১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আখের চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়। গত আড়াই মাসে চিনি আমদানি হয়েছে চার লাখ ৪১ হাজার মেট্রিক টন। পরিশোধন করে বাজারে ছাড়া হয়েছে চার লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন।

প্রায় সব ধরনের শুল্ককর প্রত্যাহার করার পরও অস্থির ভোজ্য তেলের বাজার। সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৮০-১৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খোলা সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১৬০-১৭০ টাকায়। আর সরিষার তেল প্রতিকেজি ২৭০-২৮০ টাকা। রমজানে দেশে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন ভোজ্য তেলের চাহিদা থাকে। তিন মাসে আমদানি হয়েছে তিন লাখ ৭০ হাজার ৮২ মেট্রিক টন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভোজ্য তেল আমাদনি, পরিশোধন ও বাজারজাতের সাথে জড়িত হাতে গোনা আট থেকে দশটি কোম্পানি। তারাই যে দাম বেধে দেন সে দামে বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা।

রমজানে খেজুরের চাহিদা বাড়ে। এবার চাহিদার চেয়ে আমদানি কিছুটা কম হওয়ায় দাম বাড়তি। গত আড়াই মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৩৫ হাজার টন খেজুর আমদানি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, খেজুরের আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় দাম বাড়তি। গত বছরের তুলনায় এবার খেজুরের দাম ৪০-৫০ শতাংশ বেড়েছে। তবে ৩৫০-৫০০ টাকার মধ্যে মোটামুটিমানের খেজুর পাওয়া যাচ্ছে।

সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম আরও বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারতের হিলি বন্দর দিয়ে হঠাৎ করে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দাম বেড়েছে। বাজারে প্রতিকেজি ভারতীয় পেঁয়াজ ৩৫-৪০ টাকা, দেশি পেঁয়াজ ১৮-২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রসুনে দামও বাড়তি। চীনা রসুন ১৪৫-১৫০, দেশি ১০০-১০৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আদা ১০৫-১১০ টাকা। চিড়া প্রতিকেজি খোলা ৮০-৮৫ টাকা এবং প্যাকেট ১২০ টাকা। বেসন প্রতি কেজি (প্যাকেট) ১১০ টাকা, খোলা ৯০-১০০ টাকা।

গোশতের দামও এখন আকাশছোঁয়া। গরুর গোশত হাড়সহ ৮০০-৮৫০, হাড় ছাড়া ৯০০-৯৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ব্রয়লার মুরগি ২৪০-২৪৫, সোনালিকা ৩৫০-৩৬০ এবং দেশি মুরগি ৫৫০-৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে সব ধরনের মাছের দাম চড়া। শীতে সবজির দাম কিছুটা নাগালের মধ্যে থাকলেও নাগালের বাইরে বাজারে নতুন আসা গ্রীষ্মকালীন সবজি। গুঁড়ো দুধ প্রতিকেজি ৮৫০-৮৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

https://dailyinqilab.com/national/article/563349