২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৬:৫৯

বিশ্ব জলাভূমি দিবস আজ

৩ দশকে হাওরে জলাভূমি কমেছে ৮৭ ভাগ

ঢাকার পূর্বাঞ্চল খ্যাত খিলগাঁওয়ের নাসিরাবাদ। প্রায় পাঁচ বছর আগে এটি ছিল একটি ইউনিয়ন। এক যুগ আগেও এই ইউনিয়নের প্রায় পুরো এলাকা ছিল জলাভূমি। সারা বছরই পানি থাকত। রামপুরা থেকে মেরাদিয়া হয়ে ডেমরার দিকে বড় উঁচু রাস্তা হওয়ার পর ওই এলাকায় উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে। নাসিরাবাদের বিভিন্ন এলাকায় বাড়িঘর নির্মিত হলেও নাগরিক সেবা ছিল না। নৌকা কিংবা বাঁশের সাঁকো ফেলে রাস্তা থেকে বাড়িতে যাতায়াত করতেন এলাকাবাসী। ২০১৭ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাথে যুক্ত হয় নাসিরাবাদ ইউনিয়ন। নাগরিক সেবা নিশ্চিত না হলেও এলাকার অবকাঠামোগত পরির্বতন এসেছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। একাধিক আবাসন প্রকল্পের বদৌলতে জলাভূমি ভরাট করে গড়ে উঠেছে আকাশচুম্বী ভবন। এমনকি খালগুলোও ভরাট হয়ে সরু ড্রেনে রূপ নিয়েছে। গত এক থেকে দুই যুগে ঢাকার চারপাশে নাসিরাবাদের মতো বহু এলাকার জলাভূমি সংশ্লিষ্টদের চোখের সামনেই ভরাট হয়ে গড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকা। এখনো হচ্ছে প্রতিনিয়ত। গড়ে উঠছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়িঘর। প্রশাসনের নাকের ডগায় এভাবে জলাভূমি ভরাট হলেও দেখার যেন কেউ নেই।

জানা যায়, ঢাকায় জলাভূমি রক্ষার দায়িত্ব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সিটি করপোরেশন, পরিবেশ মন্ত্রণালয়সহ আরো কয়েকটি সংস্থার। অন্য দিকে ঢাকার বাইরে জলাভূমি রক্ষার দায়িত্ব হাওর ও জলাভূমি অধিদফতর এবং সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং অ্যাসিল্যান্ড অফিসের। কিন্তু, জলাশয় রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা নেই সংশ্লিষ্টদের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব সরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় জলাশয় ভরাটের অভিযোগ আসছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে আজ বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব জলাভূমি দিবস। ১৯৯৭ সাল থেকে ২ ফেব্রুয়ারি আইইউসিএন, ইউনেস্কোসহ পরিবেশবাদী সংগঠনের উদ্যোগে বিভিন্ন দেশে বিশ্ব জলাভূমি দিবস পালিত হচ্ছে। এসব কর্মসূচি পালনের মূল লক্ষ্য পরিবেশ রক্ষায় জলাভূমি সংরক্ষণ করা।

গত বছরের জুন মাসে হাওরের ভূমি ব্যবহারবিষয়ক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক শিক্ষার্থী ও পরিকল্পনাবিদ ইনজামামউল হক রিফাত ও মারিয়া মেহরিন এ গবেষণা করেন। এতে বলা হয়, হাওর এলাকায় গত তিন দশকে ৮৭ শতাংশ জলাভূমি কমেছে। যে কারণে হাওরাঞ্চলে বন্যার ব্যাপকতা বাড়ছে বলে ওই সভায় মত দেন বিশেষজ্ঞরা। বুয়েটের দুই শিক্ষার্থীর গবেষণার তথ্যানুযায়ী, দেশের ৩৭৩ হাওরে শুষ্ক মৌসুমে জলাভূমির পরিমাণ ১৯৮৮ সালে ছিল ৩০ হাজার ৩৫০ বর্গকিলোমিটার। ৩২ বছরে তা কমে ২০২০ সালে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০৭ বর্গকিলোমিটারে। এ সময়ে হাওরাঞ্চলে সড়কসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো প্রায় পৌনে চার গুণ বেড়ে ১০৩২ থেকে ৩৮৭২ বর্গকিলোমিটার হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, হাওর এলাকায় নির্মিত এলাকা (বিল্ট আপ এরিয়া) ২০০৬ সালে ২ দশমিক ২ গুণ এবং ২০২০ সালে ৩ দশমিক ৮ গুণ বেড়েছে। পাশাপাশি পতিত জমি, কৃষিজমি ও বনজ এলাকাও কমেছে আশঙ্কাজনকভাবে। হাওরের বিভিন্ন জেলার মধ্যে ১৯৮৮ সালের তুলনায় ২০২০ সালে শুষ্ক মৌসুমে জলাভূমির পরিমাণ সিলেটে ৭৫ ভাগ, সুনামগঞ্জে প্রায় ৮০ ভাগ, নেত্রকোনায় প্রায় ৯০ ভাগ, কিশোরগঞ্জে প্রায় ৮৫ ভাগ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রায় ৭০ ভাগ, হবিগঞ্জে প্রায় ৯০ ভাগ এবং মৌলভীবাজারে প্রায় ৭০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে বলে গবেষণার তথ্যে উঠে এসেছে।

শুধু হাওরাঞ্চল নয়, দেশের সবচেয়ে বড় বিল চলনবিলের বড় অংশই ভরাট হয়ে গেছে। বর্তমানে পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটোরের ৯ উপজেলার অংশ বিশেষ নিয়ে চলনবিলের বিস্তৃতি হলেও এক সময় এটি এই তিন জেলাসহ পার্শ্ববর্তী বগুড়া ও নওগাঁ জেলাও এর অংশি ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে চলনবিল ছোট হয়ে আসছে। বছরের প্রায় ৫-৬ মাস এই চলনবিলে পানি থাকলেও জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রভাবে সর্বশেষ বছরে এই চলনবিলে ভরা বর্ষাতেও পানিশূন্যতা দেখা দেয়।

২০২০ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) গবেষণা প্রতিবেদনে ঢাকা ও আশপাশের এলাকার স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করে জলাশয় ভরাটের চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, ২০১০ সালে যখন ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) করা হয়, তখন মূল ঢাকা শহরে জলাভূমি ছিল ৯ হাজার ৫৫৬ একর। ২০১৯ সালে এটি কমে হয়েছে ছয় হাজার ৭৩ একর। ৯ বছরে ভরাট হয়েছে মোট জলাভূমির ৩৬ শতাংশ। এই সময়ে সাভারে মোট জলাভূমির ১৫ শতাংশ, গাজীপুরে ১৭ শতাংশ, রূপগঞ্জে ৪১ শতাংশ ও কেরানীগঞ্জে ২১ শতাংশ ভরাট হয়েছে। এই হিসাবে ড্যাপ বা ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় নির্ধারিত এক লাখ ৯৩৭ একর জলাভূমির মধ্যে ২০১৯ সাল নাগাদ ভরাট হয়েছে ২২ হাজার ৫১৬ একর, যা মোট জলাভূমির প্রায় ২২ শতাংশ। ছয়টি এলাকায় মোট ৪১ শতাংশ জলাধার ভরাট হয়ে গেছে।

প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, সারা দেশে প্রতি বছর ৪২ হাজার একর কৃষিজমি ও জলাশয় ভরাট হচ্ছে। ভরাটের মাত্রাও দিন দিন বাড়ছে। অন্য দিকে, ১৯৯৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে পাঁচ হাজার ৭৫৭ একর জলাভূমি ভরাট হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এতে প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও নগরের ভারসাম্য ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি শহরের বৃষ্টির পানি সুষ্ঠু নির্গমনের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, আদর্শ একটি শহরের ১০-১৫ শতাংশ এলাকা জলাশয় থাকা প্রয়োজন; কিন্তু ঢাকা শহরে জলাভূমির পরিমাণ প্রায় ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ, যা ২০ বছর আগে ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ ছিল বলে বিআইপির গবেষণায় বলা হয়েছে। ২০১০ সালের ড্যাপে রাজউকের আওতাধীন ৩৭ লাখ ৭ হাজার ৫৭৭ একর জায়গার মধ্যে বন্যাপ্রবাহ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত ছিল ৭৪ হাজার ৫৭১ একর। এর ১০ বছর পর রাজউকেরই এক জরিপ বলছে, ড্যাপ নির্ধারিত বন্যাপ্রবাহ এলাকায় ৭২ হাজার ১৮১টি ছোট-বড় স্থাপনা রয়েছে। এর ৯৯ দশমিক ৯৮ শতাংশই অবৈধ। ১৯৮৫ সালে মৎস্য বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ঢাকায় পুকুর ছিল দুই হাজারের মতো। তবে রাজধানীর সীমানা বাড়লেও বর্তমানে মাত্র ২৪১টি পুকুর আছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনের ফাঁকফোকর ও উদাসীনতায় রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে কমছে প্রকৃতির আধার জলাভূমি। কমছে পানির স্তর। ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে পরিবেশ। গত বছর প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা দেশে প্রতি বছর ৪২ হাজার একর জলাশয় ও কৃষিভূমি ভরাট হচ্ছে। প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০-এ বলা হয়েছে, নদী, খাল-বিল, হাওর, দীঘি, ঝরনা, বন্যাপ্রবাহ এলাকা, বৃষ্টির পানি ধারণ করে এমন সব এলাকা প্রাকৃতিক জলাধার, জলাশয় বা জলাভূমি হিসেবে পরিগণিত হবে। গত বছরের ২২ অক্টোবর ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুরকেও প্রাকৃতিক জলাধারের সংজ্ঞাভুক্ত করে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, এই জলাধার কোনোভাবেই ভরাট করা যাবে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলাভূমি সংরক্ষণে সচেতনতার বড়ই অভাব রয়েছে। বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে সারা দেশে প্রশাসনের সামনেই পুকুরসহ জলাভূমি ভরাট করে ঘরবাড়ি-কলকারখানাসহ নানা অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে। কোথাও কোথাও জলাশয় ভরাট করে সরকারি অবকাঠামোও গড়ে উঠেছে।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত ‘জলাভূমি রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের’ শীর্ষক এক লেখায় উল্লেখ করেন ‘ঢাকা শহরের পূর্ব, পশ্চিম কিংবা দক্ষিণ দিকেও বিস্তীর্ণ এলাকা জলাভূমি ছিল। এগুলো ভরাট করে আমরা আবাসস্থল বানিয়েছি। ঢাকা শহরের পূর্ব দিকে গেলে এখনো বিস্তীর্ণ জলাভূমি দেখা যাবে। কিন্তু ভয় হচ্ছে, এখন থেকে ১০-১৫ বছরের মধ্যেই এগুলো ভরাট করে নাগরিক আবাসন বানানো হবে।’ এই পরিবেশ বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, ‘আমাদের দেশে এখনো যেসব জলাভূমি টিকে রয়েছে, সেগুলো রক্ষায় আর দেরি করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রের দায়িত্ব জলাভূমি রক্ষা করা। ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে যে ১৮(ক) ধারা সংযোজন করা হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে- রাষ্ট্র এখন থেকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকাগুলো, বনভূমি, জলাভূমি ইত্যাদি রক্ষা করবে।’


https://www.dailynayadiganta.com/last-page/724835