২৫ জানুয়ারি ২০২৩, বুধবার, ৬:৪৫

জমির নিবন্ধন ও নামজারিতে হয়রানি-দুর্ভোগ বেড়েছে

জমির কেনাবেচা নিয়ে লাল ফিতার নতুন দৌরাত্ম্য শুরু হয়েছে। জমির নিবন্ধন ও নামজারিতে জেলা প্রশাসকের অনুমতি নেওয়ার নতুন বিজ্ঞপ্তিতে তৈরি হয়েছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। এতে একদিকে জমি কেনাবেচায় হয়রানি-দুর্ভোগ বাড়ছে, তেমনি নিবন্ধন বা রেজিস্ট্রেশন কমে যাওয়ায় রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। জমি

কিনতে গিয়ে জটিলতায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে কম্পানিগুলো। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারকে দুর্বল করতে নেওয়া হয়েছে এ পরিকল্পনা।
শিল্পায়নে আগ্রহী হচ্ছে কম্পানিগুলো, বাড়ছে এ খাতে বিনিয়োগ। সারা দেশে কর্মসংস্থান করতে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে কম্পানিগুলো। কিন্তু জমি কিনতে গিয়ে বাধছে বিপত্তি। ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি যদি কম্পানি কিনতে যায়, তাহলে জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হবে। এরপর এ জমি নিবন্ধন করে নামজারি করতে গেলে আবারও অনুমতি লাগবে। আগে নামজারি করতে শুধু সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে আবেদন করলেই হতো। এখন অনুমোদনের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে। অনুমতি মিললে এরপর শুরু হচ্ছে খারিজের মূল কার্যক্রম। অনুমতি নিয়ে তারপর সহকারী কমিশনারের কাছে আবেদন করতে হচ্ছে। এতে তৈরি হচ্ছে দীর্ঘসূত্রতা। আবেদন করে ৪৫ দিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে। দুই দফা অনুমতির গ্যাঁড়াকলে দুর্ভোগে পড়ছে মানুষ। অনুমতি নিতে গিয়ে কম্পানি এ পর্যন্ত কী পরিমাণ জমি কিনেছে, তার নথি জমা দিতে হচ্ছে। ফাইলের স্তূপ কমাতে সরকার অনলাইন নামজারির প্রক্রিয়া শুরু করেছে। কিন্তু নতুন এই বিজ্ঞপ্তিতে ভেস্তে যাচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে অনলাইন নামজারির প্রক্রিয়া।

কম্পানিসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, জমি কেনার জন্য পূর্বানুমতি নিলে খারিজের জন্য কেন আবার অনুমতি নিতে হবে। যাদের প্রকল্প অনুমোদন নেওয়া ছিল, তাদেরও এখন জমি খারিজের জন্য অনুমতি নিতে হচ্ছে। এমনকি খারিজের এই আবেদনের কোনো ফরমও তারা তৈরি করেনি। জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদনের পর তাঁরা পাঠাবেন সহকারী কমিশনারের কাছে। সেখান থেকে জরিপ করে প্রতিবেদন পাঠানো হবে জেলা প্রশাসকের কাছে। তাঁরা আবেদন দেখে আবার সহকারী কমিশনারের কাছে পাঠালে তবেই খারিজের প্রক্রিয়া শুরু হবে।

গত বছরের ১৪ নভেম্বর ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. শিবলী সাদিক স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কম্পানির নামে নামজারি করার ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হবে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘কম্পানির নামজারির ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের অনুমতি গ্রহণ করা হচ্ছে না। অথচ ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল ১৯৯০-এর ৩২৭ নং অনুচ্ছেদে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে সমবায় বা হাউজিং কোম্পানি জমি কিনলে প্রথমে তা সমিতি বা কোম্পানির নামে নামজারি হতে হবে। কোম্পানি বা সমিতি জমি কেনার পর সেটার নামজারি করার জন্য নির্দেশ দিতে হবে। নামজারির আবেদন পাওয়ার পর নামজারি কর্তৃপক্ষ জমি মালিকানার প্রচলিত ঊর্ধ্বসীমা অতিক্রম করেছে কি না বা কৃষিজমি কেনার ক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন গ্রহণ করেছে কি না, তা নিরীক্ষা করবেন।

মালিকানার উচ্চসীমা অতিক্রম করা হয়ে থাকলে বা কেনার পূর্বানুমোদন না থাকলে সহকারী কমিশনার আইনবহির্ভূত কাজের জন্য জমি বাজেয়াপ্তের মামলা করবেন এবং কালেক্টরকে জানাবেন। কালেক্টরের অনুমোদনক্রমে বাজেয়াপ্ত কার্যক্রম গ্রহণ করবেন। কালেক্টরের সুস্পষ্ট নির্দেশ ছাড়া কোম্পানি বা সমবায় সমিতির নামে নামজারি করা হবে না। কোম্পানির নামে নামজারি করার ক্ষেত্রে অবশ্যই ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়ালের ৩২৭ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জেলা প্রশাসকের অনুমতি নেওয়ার জন্য বলা হলো। নইলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

জানা যায়, এই বিজ্ঞপ্তি জারির পর থেকে কমে গেছে জমি নিবন্ধনের পরিমাণ। অনুমতির অপেক্ষায় জমে আছে ফাইলের স্তূপ। দুই দফা অনুমতি নিয়ে জমি নিবন্ধন করতে আগ্রহ হারাচ্ছে মানুষ, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকার।

যমুনা বিল্ডার্স লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. আবদুল কাদের বলেন, ‘কম্পানিগুলোর জমি কিনতে গেলে অনুমতি নিতে হচ্ছে। অনুমতি ছাড়া কেনার প্রক্রিয়া শুরু করা যাচ্ছে না। অনুমতির জন্য যাবতীয় সব নথি দাখিল করতে হচ্ছে। ভোগান্তির তো একটা সীমা আছে। জমি কেনার হয়রানি কয়েক গুণ বেড়েছে। জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে কেনার অনুমতি নিলে আবার খারিজ করতে কেন অনুমতি লাগবে? এসব হয়রানির কারণে জমি কেনায় আগ্রহ হারাচ্ছে মানুষ, রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। শিল্প খাতে বিনিয়োগে ঝামেলা বাড়ায় বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারাবে।’

ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. শিবলী সাদিক বলেন, ‘আসলে জটিলতার কিছু নেই। আমরা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে কাজটা করে যাচ্ছি। ভূমি অফিসে যখন প্রতিবেদনটা জানাচ্ছি তখন তাদের কাজও কমে যাচ্ছে। আমাদের অনুমোদন হয়ে গেলে তারা আরো দ্রুত অনুমতি দিতে পারবে। সময়টা একই লাগছে। দেরি হবে না।’

শিবলী সাদিক জানান, সাধারণ একজন মানুষ যদি কম্পানির কাছ থেকে ছোট জায়গা কেনে, তাহলে তাকে জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হবে না। কম্পানি যখন নিজের নামে জায়গা কিনবে তখন তাকে জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হবে। বিক্রির ক্ষেত্রে লাগবে না। তবে কম্পানি কোনো মানুষের কাছ থেকে জমি কিনতে গেলে কম্পানিকে অনুমতি নিতে হবে। যিনি কম্পানির কাছে বিক্রি করবেন, তার অনুমতি নিতে হবে না। তিনি বলেন, বারবার যেতে যদি সমস্যা হয়, তবে একসঙ্গে আবেদন করতে পারেন।

১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনে এক পরিবার ৩৭৫ বিঘা বা পরিবারের সদস্যপ্রতি ১০ বিঘা জমি রাখতে পারবে। পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ভূমি সংস্কারের ওপর বিভিন্ন আদেশ, অধ্যাদেশ ও সংশোধনীর মাধ্যমে ভূমি আইনের ব্যাপক সংস্কার করা হয়। ১৯৭২ সালের জারীকৃত রাষ্ট্রপতি আদেশ ৯৮ ও ১৩৫ নামে পরিচিত অধ্যাদেশে দেশের স্বাধীনতার আগে পরিবারভিত্তিক ভূমির সিলিং ৩৭৫ বিঘা ছিল, যা কমিয়ে ১০০ বিঘায় নির্ধারণ করা হয়। ২৫ বিঘা কিংবা তার চেয়ে কম ভূমির মালিকের জন্য ভূমি উন্নয়ন কর মওকুফ করা হয়। ২৫ বিঘার ওপরে ১ শতাংশ হলেও সম্পূর্ণ ভূমি বা ২৫ বিঘা ১ শতাংশ ভূমির খাজনা পরিশোধ করতে হয়।

১৯৮৪ সালের ভূমি সংস্কার আইনে জমি রাখার সর্বোচ্চ সীমা বা সিলিং ১০০ বিঘা থেকে কমিয়ে ৬০ বিঘা করা হয়। কম্পানির ক্ষেত্রে সিলিং ১০০ বিঘা করা হয়। তবে এই ১০০ বিঘা শিল্প-কারখানার জন্য অনেক সময় কম হয়ে যায়। তাই জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে এর বাইরে জমি কিনতে পারে কম্পানিগুলো। কিন্তু একবার অনুমতি নিয়ে জমি কেনার পরে খারিজ করতে আবারও ধরনা দিতে হচ্ছে জেলা প্রশাসকের দুয়ারে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনেক প্রতিষ্ঠান জমি খারিজের জটিলতায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে জমি কেনাবেচা এবং এওয়াজ বদল দলিল সম্পন্ন করতে পারছে না। এ ছাড়া প্রয়োজনে ব্যাংকঋণের আবেদনও করতে পারছে না তারা। আগের পদ্ধতিতে খারিজ চলমান থাকলে এ সমস্যায় পড়তে হতো না প্রতিষ্ঠানগুলোকে।

ইউনাইটেড গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক (জমি ক্রয়) মো. মহসিন আলী বলেন, ‘ডিজিটাইজেশনের পরিবর্তে জমির খারিজ প্রক্রিয়া জটিল হয়েছে। নতুন নিয়ম পরিস্থিতি আরো খারাপ করেছে এবং ভোগান্তি দ্বিগুণ করেছে। জেলা প্রশাসকের অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতায় জমি কেনাবেচা, রেজিস্ট্রেশন ও খারিজের কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমি এক মাস আগে টেস্ট কেস হিসেবে জমি খারিজের অনুমতি চেয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কাছে দুটি আবেদন জমা দিয়েছিলাম। আবেদনপত্র জমা হয়েছে। কিন্তু এসি ল্যান্ড এখনো ডিসি অফিস থেকে আবেদনপত্র পাননি। জমির রেজিস্ট্রি খরচ খুব বেড়েছে। বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।’

ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে একটা সার্কুলার জারি করা হয়েছে। এটি শুধু ঢাকার জন্য জারি করা। তিনি বলেন, ‘আসলে হঠাৎ করে এই আইন বাস্তবায়ন করতে গেলে সমস্যা হবে। কারণ এখানে অনেক ইস্যু আছে, অনেক ঝামেলা আছে। আমি ঢাকা জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা তাদের ডেকেছি। এর সঠিক ব্যবস্থা দরকার। খুব দ্রুত একটা সমাধান দিয়ে দেব।’


 

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/01/25/1235948