২২ জানুয়ারি ২০২৩, রবিবার, ৩:২০

ইচ্ছামতো টাকা ছাপানোয় অর্থনীতি পড়তে পারে মহাবিপদে

-ড. মো: মিজানুর রহমান

বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সরকারকে সহায়তা করতে ৫০ হাজার কোটি টাকার মতো ছাপিয়েছে। এত টাকা ছাপানোর ঘটনা দেশের ইতিহাসে অতীতে কখনো হয়নি। প্রশ্ন হলো, এত টাকা কেন ও কিভাবে ছাপাল? অর্থনীতিতে এর প্রভাবইবা কী? এ বিষয়ে আলোচনার সাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা ছাপানোর পদ্ধতি নিয়ে কিছুটা আলোচনা করব; ইনশা আল্লাহ।

টাকার পেছনেই সারা দুনিয়ার মানুষ ছুটে চলে। এই টাকার চাহিদার যেমন কোনো শেষ নেই, তেমন অনেকের দুঃখেরও অবসান হয় না এই টাকা ছাড়া। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, টাকা প্রিন্ট করার মেশিন ব্যবহার করে বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা ছাপাতে সমস্যা কোথায়? টাকা ছাপিয়ে তৈরি করতে পারে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা সেতু। নির্দিষ্ট করে বললে, টাকা প্রিন্ট করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের; স্বাধীনতা রয়েছে ইচ্ছামতো টাকা প্রিন্ট করে সরকারকে দেয়ার। তবে কোনো দেশই তা করে না, বরং প্রিন্ট করা হয় সেই দেশের অর্থনৈতিক প্রয়োজনের সাথে ভারসাম্য রেখে।

এখন প্রশ্ন হলো বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে সরকারকে সাপোর্ট দিয়েছে তা সে অর্থনৈতিক প্রয়োজনের সাথে ভারসাম্য রেখে ছাপিয়েছে কি না। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এই অর্থে যে, পুরো ২০২১-২২ অর্থবছর ধরে যখন দেশে সঙ্কট চলছিল, বিশেষ করে যখন থেকে ডলার সঙ্কট চলছিল তখন একপর্যায়ে আমানতকারীরা ব্যাংক থেকে টাকা উঠানো শুরু করেছিল। এমন অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার নিশ্চিত করছিল যে, দেশের তারল্য সঙ্কট নেই, ব্যাংকে তারল্য সঙ্কট নেই ইত্যাদি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক ইচ্ছামতো টাকা ছাপিয়ে সরকারকে সরবরাহ করেছে। তাহলে তারল্য সঙ্কট না থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেন টাকা ছাপল? এই টাকা ছাপানোটা কি ফিজিক্যালি ছাপানো নাকি টাকা ক্রিয়েট করা? হঠাৎ করে এত টাকা ছাপানোতে অর্থনীতিতে কি প্রভাব পড়তে পারে? এ নিয়েই আজকের আলোচনা।

টাকা ছাপানোর নিয়ম
টাকা ছাপানোর পরিমাণের সাথে দেশের মানুষের উপার্জন, অর্থনৈতিক চাহিদা, দেশের সম্পদ ইত্যাদি জড়িত। এর চেয়ে বেশি উৎপাদন করলেই দেশের অর্থনীতি ভারসাম্য হারাতে শুরু করে। ধরুন, একটা দেশে সম্পদ বলতে রয়েছে এক শ’ মণ চাল। আর সেই দেশ বছরে এক হাজার টাকা প্রিন্ট করল। পরিবহন খরচ, খুচরা মূল্য, পাইকারি মূল্য ইত্যাদি জটিলতা বাদ দিয়ে ধরেই নেই, প্রতি মণ চালের দাম পড়ল ২০০ টাকা। তাহলে দেশের মোট সম্পদ আর মোট কারেন্সি ভারসাম্যপূর্ণ হলো। পরের বছর ওই দেশটি সর্বমোট দুই হাজার টাকা প্রিন্ট করল, কিন্তু মোট সম্পদ বলতে একশ’ মণ চালই রইল। যেহেতু দেশে নতুন কোনো সম্পদ নেই, ওই একশ’ মণ চাল কেনার জন্য আগে বরাদ্দ ছিল এক হাজার টাকা আর এখন দুই হাজার টাকা, অর্থাৎ প্রতি মণ চালের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেল। এভাবেই দেশের মোট সম্পদের থেকে অতিরিক্ত টাকা উৎপাদন করলে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়, টাকার দাম বা ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। একেই বলে মুদ্রাস্ফীতি।

দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তাই রীতিমতো গবেষণা করে টাকার চাহিদা নির্ধারণ করে টাকা প্রিন্ট করতে হয়। সাধারণত একটি দেশের জিডিপির ২-৩ শতাংশ টাকা প্রিন্ট করা হয়, তবে উন্নয়নশীল দেশে এই হার আরেকটু বেশি। এ কারণেই আমরা ইচ্ছামতো টাকা তৈরি করে রাতারাতি পদ্মা সেতু বানিয়ে ফেলতে পারি না। কারণ সেই বাড়তি টাকা দেশের সব পেশার মানুষের হাত ধরে প্রবেশ করবে মূলধারার অর্থনীতিতে এবং দেশের অর্থনীতি সঙ্কটে পড়ে। মুদ্রাস্ফীতির কারণে বাড়তি ছাপানো কাটাকাটি হয়ে যায়, ফলে দেশের অর্থনীতিটা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। কারণ এতে সঞ্চয়ের মূল্য কমে যাবে; টাকার মূল্য কমে যাবে।

আমরা জানি পণ্য বিনিময় থেকে বার্টারকে রিপ্রেজেন্ট করার জন্য একটা জটিল প্রক্রিয়া পাড়ি দিয়ে টাকা এসেছে। নতুন টাকা ছাপতে হলে টাকার পেছনে তো সম্পদ থাকতে হয়। তা হলে ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাপানোর পেছনের সম্পদ আসল কোথা থেকে? উল্লেখ্য, ইদানীং ফিয়াট কারেন্সি ছাপাতে সম্পদ থাকার বাধ্যবাধকতা বিবেচনা করা হয় না। অধিকন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা ছাপানো বা নতুন টাকা ইনজেক্ট করার মতো অ্যাসেট তো দেশের আছেই। কিন্তু অ্যাসেট থাকলেই তো টাকা ছাপানো যায় না। ছাপানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা ক্যালকুলেশন অনুসরণ করতে হয়। অন্যথায় ইনফ্লেশন নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। যেমন এক বছর আগে এক ডলার ছিল ৮৫ টাকা, এখন ১০৫ টাকা। এখন যদি বাজারে আরো টাকা সরবরাহ করে, তাহলে সঙ্কট দেখা দেবে। অর্থনীতির এই সঙ্কটে সরকার টাকা ছাপিয়ে প্রয়োজন মিটাচ্ছে।

দেশে হঠাৎ করে টাকার ঘাটতি হলো কেন?
সরকার বলছে, দেশে তারল্য সঙ্কট নেই, তাহলে ছাপানো টাকাটা গেল কোথায়? এই টাকা দেশে ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেম থেকে বের হয়ে আছে; হয়তো দুর্নীতির কারণে। দেশের অনেক ব্যাংক সরাসরি দুর্নীতির সাথে জড়িত হওয়ার ফলে ওই সব ব্যাংক বসে যাওয়ার উপক্রম। মাত্র কয় বছর পূর্বে চতুর্থ প্রজন্মের একটি ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হলে সরকারকে ওই ব্যাংক রক্ষায় অর্থের জোগান দিতে হয়েছিল। ইদানীং বেশ কয়েকটা ইসলামিক ব্যাংককেও সরকারের টাকার জোগান দিতে হচ্ছে, মূলত একটি গ্রুপের নিয়মবহির্ভূতভাবে ঋণ নেয়ার জন্য, অথচ ওই ব্যাংকগুলোর পারফরম্যান্স বেশ ভালো ছিল। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক দেশের সবচেয়ে বড় এবং শ্রেষ্ঠ ব্যাংক, যার ফাইন্যান্সিয়াল হেলথ্ দেশের অন্য যেকোনো ব্যাংকের চেয়ে ভালো ছিল। অথচ সেই ব্যাংক এখন ধার করছে। কারণ বিভিন্ন মিডিয়া বলছে, তাদের হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে চলে গেছে। বাংলাদেশী টাকা তো আর ইংল্যান্ড, কানাডা বা দুবাইতে নিয়ে যায়নি, কারণ সেখানে এই টাকা চলে না। নিশ্চয়ই ডলারে কনভার্ট হয়ে ডলার বিদেশে চলে গেছে এবং টাকা ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেম থেকে বের হয়ে গেছে, অর্থাৎ মানি মার্কেটে নেই। যে কারণে এখন ডলারের ক্রাইসিস হচ্ছে দেশে; অর্থাৎ ডলার ক্রাইসিসের সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে।

এ ছাড়াও দেশে যত দুর্নীতি হচ্ছে তত ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেম থেকে টাকা বের হয়ে যাচ্ছে। সেই টাকাটা কেউ ঋণ নিয়েছে, এই ঋণ ডিফল্ট হয়েছে, একসময় অফেরতযোগ্য হয়ে যায়; এভাবেই হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতিবাজরা নিয়ে যায়। সে টাকাটা যদি রিকভার করে সিস্টেমে আনা যায় তাহলে ক্রাইসিস থাকে না। কিন্তু যেহেতু রিকভার করা যাচ্ছে না, সেহেতু টাকাটা সিস্টেমে থাকছে না। যে কারণেই হয়তো বর্তমান ডিফল্ট ঋণ এক লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে।

টাকা যে সিস্টেমে নেই তার আরো একটা উদাহরণ হলো, যখন ইসলামী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনা যখন মিডিয়ায় প্রচার হতে শুরু করল তখন অনেক গ্রাহক হুমড়ি খেয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা উঠিয়ে নিলো। এর ফলে ইসলামী ব্যাংক এতটাই লিকুইডিটি ক্রাইসিসে পড়ল যে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডিপোজিটের বিপরীতে ধার করে রেগুলার ক্যাশ রিকোয়ারমেন্ট মেইনটেইন করতে হচ্ছে। তো বাংলাদেশ ব্যাংকের এত বড় ব্যাংককে ধার দেয়ার টাকা কোথা থেকে আসবে? এগুলোই হচ্ছে ক্রাইসিস।

এর পাশাপাশি অনেক ব্যাংকে অনেক বড় দুর্নীতি হয়েছে। তবে আগেই বলেছি, টাকা দেশেই আছে, কারণ আমরা দেখছি যে, কারেন্সি আউটসাইড ব্যাংকের গ্রোথ ২১ শতাংশ। মানে সিস্টেমে আমাদের যে টাকা আছে তার ২১ শতাংশ মানুষের পকেটে আছে, সিস্টেমে নেই। মানুষ সাধারণত যখন অনিশ্চয়তায় ভোগে, ক্রাইসিস দেখে এবং ব্যাংককে ট্রাস্ট করে না তখন টাকা হাতে রাখে। একই সাথে যখন অনেক দুর্নীতি হয় তখন দুর্নীতির টাকাটা মানুষ ব্যাংকে না রেখে সেটা আলমারিতে রাখে, পকেটে রাখে।

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থাকলে এবং নির্বাচন কাছাকাছি এলে মানুষ বিভিন্ন ধরনের অনিশ্চয়তা এবং যাচাই-বাছাইর ভয়ে টাকা বাইরে রাখে; দেশে এখন তাই হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, এমন অবস্থায় সরকারের প্রয়োজন, সিস্টেমের বাইরের টাকা খুঁজে সিস্টেমে আনা, ব্যাড লেন্ডিংটাকে রিকভার করা। অথচ সরকার সেটা না করে টাকা ছাপিয়ে তারল্য সঙ্কট মোকাবেলার উদ্যোগ নিয়েছে, যা অর্থনীতিকে আরো সঙ্কটে ফেলে দেবে।

টাকা ছাপানোই কি সঠিক সিদ্ধান্ত?
টাকা ছাপানোই সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত কিনা সেটা ঠিক এক কথায় পরিষ্কারভাবে বলা যাবে না। কারণ বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সময় ইউরোপ-আমেরিকার বহু উন্নত দেশো টাকা ছাপিয়েছিল। তবে তখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল; তখন বাজারে ডিমান্ড ছিল না, মানুষের হাতে টাকা ছিল না, কিন্তু ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিগুলোর প্রোডাকশন ক্যাপাসিটি অব্যবহৃত ছিল। প্রোডাকশন ক্যাপাসিটি ছিল অথচ মানুষের ডিমান্ড না থাকায় ওই শিল্পকারখানায় টাকা ইঞ্জেক্ট করতে হয়েছে। মানুষের ক্রয় করার ক্ষমতা ছিল না, এক্সাক্টলি ক্যাপাসিটিটা ইউটিলাইজ হয়েছে। ওই সময় যখন টাকা ইঞ্জেক্ট করা হয়েছে তখন কিন্তু সেটা প্রাইস প্রেশার তৈরি করেনি। মানুষ ক্রয়ক্ষমতা তখন বাড়িয়েছে।

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সময়ের মতো নয়। দেশে এখন ডিমান্ড আছে। আমরা দেখি, বড় বড় শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনীতিবিদরা দুই হাতে টাকা খরচ করছে। টুরিস্ট প্লেসগুলোতে এখনো সব হোটেলের ভাড়া অনেক বেশি; রুম ফাঁকা থাকে না। তার মানে, মানুষ খরচ করছে। নন ফুড ইনফ্লেশন এখন প্রায় দুই অঙ্কে। মানুষ দামি জিনিস কিনছে, ব্যবহার করছে। এর অর্থ মানুষের কাছে টাকা আছে, চাহিদা আছে এবং আমাদের প্রোডাকশন ক্যাপাসিটিও ইউটিলাইজ হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন নয় যে, কোম্পানির প্রোডাক্টশন ক্যাপাসিটি আছে কিন্তু সে প্রোডাকশনে যাচ্ছে না। তবে হ্যাঁ, প্রোডাকশন কিছুটা কমেছে এবং ওই সিচুয়েশনে কিছু মানুষ বরং উল্টো ডিমান্ড সাপোর্ট করার চেষ্টা করছে মূলত মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। এই অবস্থা থেকে বুঝা যায় যে, ডিমান্ড-সাপ্লাই আসলে সমস্যা নয়। সমস্যা আসলে সিস্টেম থেকে টাকা বের হয়ে গেছে দুর্নীতির কারণে এবং ডিফল্ট লোনের কারণে, প্যানিকের কারণে। টাকা ছাপানোর ভালো মন্দ বিবেচনা করার সুযোগ সরকারের নেই। কারণ মনে হয় যে, সরকারের কাছে এটিই একমাত্র উপায় ছিল।

টাকা ছাপানোর আরো একটা কারণ হলো ‘ইকোনমিক মিস ম্যাচ’। অর্থাৎ সেন্ট্রাল ব্যাংকের টাকা ছাপাতে হচ্ছে কারণ সরকার ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেয়ার জন্য ল্যান্ডিং রেডক্যাপ ৯ শতাংশে বেধে দিয়েছে। এখন লিকুইডিটি ক্রাইসিসের সময় সরকারকে বড় বাজেটের সাপোর্টের জন্য কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে টাকা নিতে হবে। স্বাভাবিক নিয়মে সরকার ঋণ নেয়ার জন্য ট্রেজারি বন্ড বিল ছাড়ে। ব্যাংকগুলো সেখানে অকশনে বিট করে সাধারণত ২ থেকে ৩ শতাংশ রেটে। বাংলাদেশ ব্যাংক অকশন ডাকে সরকারের পক্ষে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যদি সরকার দুই হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার অকশন বিট করে তবে লিকুইডিটি ক্রাইসিসের জন্য অকশন কল শুরু করল ধরুন সাড়ে ৮ শতাংশ হারে। প্রথম বিটের পর দ্বিতীয় বিটে রেট আরো বেশি, পরের বিটে আরো বেশি। এভাবে দুই হাজার কোটি পর্যন্ত যেতে সুদের হার হয়তো সরকার দেয়া ক্যাপ ৯ শতাংশ ক্রস করে যায়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা ভার্বাল ইন্সট্রাকশন দিয়ে দেয় যে তারা ৮.৯৫ বিট আসলে স্টপ করে দেবে। কারণ সরকারের বেঁধে দেয়া ঋণের সুদের হার ৯ ক্রস করলে সাধারণ ঋণ গ্রহীতার ঋণের হারের সাথে মিস্ ম্যাচ হয়ে যায়। এতে যেহেতু সরকারের কাছে টাকা রাখা নিরাপদ বিধায় প্রাইভেট সেক্টর কোনো ঋণই পাবে না, ফলে এই সেক্টর কোনো বিজনেস করতে পারবে না; ইকোনমি খারাপ হয়ে যাবে। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক বাধ্য হচ্ছে কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে টাকা না নিয়ে নিজে ছাপিয়ে সরকারকে দিতে। তার মানে ফ্রেশ মানি ইঞ্জেক্ট করে দিচ্ছে। অথচ ঋণের ক্যাপ ১০-১২ শতাংশ হলে সরকার বেশি ঋণ নিতে পারত; টাকা ছাপাতে হতো না। ২০১৯ সালে ঋণে সুদের হার ৯ শতাংশ ক্রস করে ১০ শতাংশ হয়েছিল। তখন ল্যান্ডিং ক্যাপ ছিল না; টাকার সঙ্কট ছিল, সুতরাং উচ্চ হারে ব্যাংক টাকা দিতে কোনো সমস্যা ছিল না ফলে ছাপাতে হয়নি। এবারের টাকা ছাপানো মূলত সরকারকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য। এ ছাপানোর পদ্ধতিকে বলে ডিভল্বমেন্ট সিস্টেম। আগে ছাপায়নি কারণ তখন প্রচুর লিকুউডিটি ছিল। তা ছাড়া ইকোনমিতে এত একটিভিটি ছিল না। গত কয়েক বছরের ট্রেন্ডে বাংলাদেশ ব্যাংক ডিভল্বমেন্ট করেনি।

টাকা ছাপানো এক ধরনের বেইল আউট সরকারের জন্য; এর অনেক কঠিন অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে। প্রথমত মুদ্রাস্ফীতিতে আরো চাপ পড়বে। উল্লেখ্য, বাজেটে মুদ্রাস্ফীতির টার্গেট ছিল ৫.৬ শতাংশ, যা পরে রিভাইস করে ৭.৫ শতাংশ করেছে; বাস্তবে বর্তমানে ইনফ্লেশন ১০ এর কাছাকাছি। এর ওপর সরকার টাকা ছাপালে মুদ্রাস্ফীতির চাপ আরো বেড়ে যাবে। সে কারণেই সরকার ইনফ্লেশন টার্গেট আরো বাড়িয়েছে। এতে প্রথমত লিভিং স্ট্যান্ডার কমে যাবে। কারণ টাকার ভ্যালু আরো কমে গেলে তো বেতন বাড়ছে না। এই টাকার দাম যখন আরো কমে যাবে, তখন জীবনযাত্রার মান কমে যাবে। গভর্নমেন্ট কিন্তু জিডিপি ডাউনসাইজ করেছেন, তার মানে দেশের ইকোনমি একটিভিটিস কমে যাবে, উন্নয়ন কমে যাবে, মানুষের জীবনযাত্রার মানও কমে যাবে।

দ্বিতীয়ত মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়া ছাড়াও দেশের পুঁজি পাচার হবে, অর্থাৎ বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে দুর্নীতি হয়ে আরো টাকা চলে যাবে সিস্টেমের বাইরে। এরপর সেন্ট্রাল ব্যাংক তথা গভর্নমেন্ট যখন ক্যাপিটাল ইঞ্জেক্ট করছে তখন বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ক্যাপিটাল স্ল্যাইড হচ্ছে। আবার সেখানে কিন্তু টাকা ইঞ্জেক্ট করছে। এভাবে টাকাটা যখন আসছে তখন টাকাটা বাইরে চলে যাচ্ছে। পাচার বন্ধ না করে এভাবে এক দিকে টাকা ছাপানো অন্য দিকে টাকা বাইরে চলে যাওয়া মূলত চক্রাকারে টাকা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা অর্থনীতিতে মহা সঙ্কট ডেকে আনবে।

তদুপরি প্রশ্ন হলো সরকারের এই কারেকটিভ মেজার কী আল্টিমেটলি ওয়ার্ক করবে কি না? কারণ ২০২৩ এ অর্থনীতির জন্য খুবই কঠিন বছর হবে বলেছে সরকার, আইএমএফ এবং অন্যন্য সংস্থাসহ সবাই। আমরা দেখেছি, কোভিডের সময় বাংলাদেশ ব্যাংক খুব ভালোভাবে অর্থনীতি ম্যানেজ করতে পেরেছে। সেই সময় কোনো ধরনের তারল্য সঙ্কট ছিল না। যথাযথ সময়ে তারা বিভিন্ন রিফ্রেশিং স্কিম দিয়েছে যে কারণে দেশ কোনো ধরনের সঙ্কট অনুভব করেনি। তবে এখনকার দেশীও সঙ্কটের সাথে বৈশ্বিক সঙ্কট যোগ হয়েছে। যেমন আমদানি অনেক বেড়ে গেছে, ডলারের মূল্য বেড়ে গেছে। আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপানোর পদক্ষেপ নিয়েছে যেন যে করে হোক টাকার সঙ্কট কমানো যায়। এতে সরকারের জন্য সাময়িক একটা সমাধান হলেও দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতি মহা সঙ্কটে পড়বে।
ছাপানোর প্রক্রিয়ায় বন্ড বাজারও বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়বে। কারণ বন্ডের মাধ্যমে সরকার টাকা ঋণ করে। আজকে পঞ্চাশ টাকার বন্ড বিক্রি করে সেই অর্থ কাজে লাগিয়ে এক বছর পরে সরকার পঞ্চাশ টাকা ফেরত দিচ্ছে, ব্যাপারটা এরকম; সাথে সুদ। এখন, সরকারের কাছ থেকে পঞ্চাশ টাকার বন্ড কিনলে এক বছর পর সেই টাকা আদায় করলে যদি মুদ্রাস্ফীতির কারণে পঞ্চাশ টাকায় আগের চাইতে কম পরিমাণ চাল কিনতে পারে, তখন স্বাভাবিকভাবেই বন্ড কেনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আবার বন্ড বিক্রি না করতে পারলে সরকারও প্রয়োজনীয় অর্থ থেকে বঞ্চিত হবে। টাকার ক্রয়ক্ষমতার অনিশ্চয়তার কারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। ব্যবসা খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। যে দেশে মুদ্রাস্ফীতি হবে, সে দেশের মুদ্রার দাম অন্য দেশের মুদ্রার তুলনায় কমে যাবে। ধরুন, ইংল্যান্ডে মুদ্রাস্ফীতির হার দিনে ১০ শতাংশ আর আমেরিকায় শূন্য শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকার একটি দ্রব্যের মূল্য কাল ইংল্যান্ডে হবে ১১০ টাকা, আমেরিকায় ১০০ টাকাই থাকবে। সে ক্ষেত্রে আমেরিকার এক ডলারের মূল্য হবে ইংল্যান্ডের ১ দশমিক ১০ পাউন্ডের সমান।

মুদ্রাস্ফীতির সর্বোচ্চ হারের রেকর্ড হাঙ্গেরীর, ১৯৪৬ সালে সে দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার দৈনিক ১৯৫ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল। জিম্বাবুয়ের অস্বাভাবিক মুদ্রাস্ফীতির কথাও আমরা জানি। সেখানে এক প্যাকেট পাউরুটি কেনার জন্য এক বস্তা টাকা নিয়ে দোকানে যেতে হতো, এমন কথা প্রচলিত আছে। বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন জিম্বাবুইয়ান ডলার সেখানে ডালভাত। ষাটের দশক থেকেই জিম্বাবুয়ের অর্থনীতির নাজেহাল অবস্থা। একুশ শতকের, ২০০৮ সাল থেকে তা একেবারে চরম আকার ধারণ করে। অর্থনীতি সামাল দিতে মুগাবে সরকার প্রচুর টাকা প্রিন্ট করার সিদ্ধান্ত নেয়, যা ধ্বংসের পথে নিয়ে যায় জিম্বাবুয়ের অর্থনীতিকে। টাকা ছাপানোর ফলে হু হু করে দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকে। বর্তমানে জিম্বাবুয়ের মুদ্রাস্ফীতির হার দৈনিক ৯৮ শতাংশ, অর্থাৎ আজকে যার মূল্য ১০০ টাকা, আগামীকাল তা ১৯৮ টাকা দিয়ে কিনতে হবে! চিন্তা করা যায়!
অতিরিক্ত ছাপা টাকা দিয়ে যে দেশের ঋণই শোধ করে, যে দেশেই তা খরচ করে, তা ঘুরেফিরে আবার নিজের দেশেই ফেরত আসে। কারণ বাংলদেশের মুদ্রা তো আন্তর্জাতিক মুদ্রা নয় যে অন্যান্য দেশ এই মুদ্রা দিয়ে কেনাকাটা করতে পারে। এ ছাড়াও এই টাকা বৈদেশিক ঋণ শোধ করায় ব্যবহার করা যায় না। ফলে দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে বেশি করে টাকা ছাপানো কোনো সমাধান নয়, সমাধান হলো উৎপাদন বৃদ্ধি করা যাতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। উল্টোভাবে উন্নয়ন করতে গেলে উন্নয়নও উল্টোভাবেই হবে!

পরিশেষে বলতে হয়, বাংলাদেশ তথা বিশ্ব অর্থনীতির এই মিস ম্যাচ মূলত পুঁজিবাদী অর্থনীতিরই পরিণতি। অথচ ইসলামী অর্থনীতিতে যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে ঠিক তত পরিমাণ মুদ্রার সার্কুলেশন অর্থনীতিতে থাকতে পারে। তা ছাড়াও ইসলামী অর্থনীতির মুদ্রার নিজস্ব একটি মূল্যমান রয়েছে; ফিয়াট কারেন্সি ছাপানোর সুযোগ নেই। সুতরাং সমাধান হলো ইসলামী অর্থনীতি চালু করা।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/722048