৭ জানুয়ারি ২০২৩, শনিবার, ৮:১৭

ব্যয় মেটাতে এবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঢালাওভাবে ঋণ নিচ্ছে সরকার

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান: তারল্য সংকটের কারণে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অর্থায়ন করতে না পারায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিচ্ছে সরকার। সুদ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে যে হারে ঋণ নিচ্ছে তার বেশির ভাগ পরিশোধ করতে হচ্ছে ঋণের সুদে। সরকার যদি অব্যাহতভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এমন ঋণ নিতে থাকে, তাহলে সামনে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে গেলে মানুষের দুর্ভোগও বেড়ে যাবে। এদিকে ব্যাংক ব্যবস্থায় থাকা তারল্য বা নগদ টাকার পরিমাণও কমে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ২৮ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকার তাদের কাছ থেকে ৪৫ হাজার ৫৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিল ৩১ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া মানে নতুন ছাপানো টাকা বাজারে ছাড়া হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া মূল্যস্ফীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো অর্থ বাজারে গেলে পরবর্তীতে টাকার পরিমাণ ৫ গুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে। অর্থনীতির ভাষায় যাকে ‘মানি মাল্টিপ্লায়ার’ বলা হয়। ফলে সরকার যে ৪৫ হাজার ৫৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, শেষ পর্যন্ত গিয়ে এর পরিমাণ ২ লাখ ২৫ হাজার ২৮৫ কোটি টাকায় দাঁড়াতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে এই নতুন টাকা সরবরাহের বিপরীতে তৈরি হওয়া অতিরিক্ত অর্থ পণ্যের চাহিদা তৈরি করবে, যার ফলে দ্রব্যমূল্যও বাড়বে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশে, যা নবেম্বরে ছিল ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল গত ১০ বছরের সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধ্বে এ পর্যন্ত অর্থনীতিতে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি ডলার সরবরাহ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২১-২২ অর্থবছরেও এর পরিমাণ ছিল ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আহসান এইচ মনসুর জানান, আমদানি বিল পরিশোধের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে স্থানীয় মুদ্রা বিনিময়ে বিপুল পরিমাণ ডলার কিনছে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে টাকা জমা হচ্ছে। ফলে ব্যাংকিং খাতে তীব্র তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। সরকারি ঋণ হিসেবে অর্থনীতিতে এই নতুন অর্থের সরবরাহ শিগগির মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করবে না। কিন্তু সরকার যদি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া অব্যাহত রাখে, তাহলে আগামীতে তা মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ তৈরি করতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার বিষয়ে সরকারের সতর্ক থাকা উচিত। কারণ এর ফলে সামনে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ সৃষ্টি হতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের নভেম্বর শেষে সরকারের ব্যাংকঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আগের অর্থবছরের ৩০ জুনে যা ছিল ২ লাখ ৭০ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা। এ ঋণের মধ্যে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণ। আলোচ্য সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। প্রচলিত ব্যাংকগুলোকে আগে নেয়া ঋণের দুই হাজার কোটি টাকার মতো ফেরত দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরের ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ৪৫ হাজার ৫৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।

পিআরআই’র নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ বেড়ে যাওয়ায় একদিকে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি চাপ বাড়ছে মূল্যস্ফীতির। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষিত মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গেছে। দেশি-বিদেশি পুঞ্জীভূত ঋণ বেড়ে যাওয়ায় বেড়ে যাচ্ছে সুদ ব্যয়। প্রতিবছরই বেড়ে যাচ্ছে ঋণ পরিশোধের ব্যয়। এতে বাজেট ঘাটতি বাড়ছে। আর বাজেট ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় সরকারের ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। উচ্চ সুদে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার পাশাপাশি ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়ায় প্রতিবছরই বাড়ছে সুদ ব্যয়।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে সুদ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮০ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা, যা আগের বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ছিল ৬৮ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। এ সুদ ব্যয় অনুন্নয়ন বাজেটের একক খাত হিসেবে সর্বোচ্চ ১৯ দশমিক ২ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরেও একক খাত হিসেবে সর্বোচ্চ ছিল ১৮ দশমিক ১ শতাংশ। এ হিসাবে এক বছরে ঋণ পরিচর্চা বাবদ সুদ ব্যয় বাড়ছে ১১ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা, যা শতকরা হিসেবে প্রায় ১৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। সুদ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে যে হারে ঋণ নিচ্ছে তার বেশির ভাগ পরিশোধ করতে হচ্ছে ঋণের সুদে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের রাজস্ব আদায়ে তেমন গতি নেই। অন্যদিকে কমছে না সরকারের ব্যয়। বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হচ্ছে। এ জন্য সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে এবং

অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে। অন্যথায় মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে গেলে মানুষের দুর্ভোগও বেড়ে যাবে। সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় কম হয়েছে।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরেছে সরকার। আর সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার। এর বিপরীতে প্রথম চার মাসে এই খাত থেকে কোনো ঋণ পায়নি সরকার, উল্টো ৬৩২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা কোষাগার থেকে অথবা ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করেছে।

এদিকে ব্যাংকিং খাতে তারল্য পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত ডিসেম্বরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণের প্রকৃত সুদহার কমে যাওয়া, করোনাভাইরাস মহামারীর বিধিনিষেধ কমে এলে অর্থনীতির জোরালো কর্মকা-ে ঋণ বাড়া এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিদেশি মুদ্রা বিশেষ করে ডলার কেনার কারণে ব্যাংক ব্যবস্থায় থাকা তারল্য বা নগদ টাকার পরিমাণ কমে এসেছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে বিশেষায়িত ব্যাংক ছাড়া দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট তারল্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা। ২০২১ সালের একই সময়ে যা ছিল ৪৩ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে কমেছে ২৮ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা; শতকরা হিসাবে ৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এর তিন মাস আগে জুন শেষে এ অঙ্ক ছিল ৪৩ হাজার ১৯২ কোটি ৯০ লাখ টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে তারল্যের পরিমাণ কমেছে ১ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা।

https://dailysangram.com/post/512985