৪ জানুয়ারি ২০২৩, বুধবার, ১১:১৭

ঋণ পরিশোধে বাড়তি সময় দেবে না আইটিএফসি

ডলার সংকটের প্রভাব তেল আমদানিতে

ডলার সংকটের কারণে কিছু জ্বালানি তেল আমদানির বিল যথাসময়ে পরিশোধ করতে পারছে না রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (আইডিবি) সদস্য প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফিন্যান্স করপোরেশন (আইটিএফসি) থেকে ঋণ নিয়ে তেল আমদানি করা হয়। তবে পর্যাপ্ত ডলারের অভাবে আইটিএফসির কাছে দেনা সময় মতো পরিশোধ করা যাচ্ছে না। ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর অনুরোধ জানালেও রাজি হয়নি আইটিএফসি। ফলে জ্বালানি তেল আমদানি এবং দেশে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

অর্থ এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে সম্প্রতি পাঠানো এক চিঠিতে বিপিসি জানিয়েছে, আগে জ্বালানি তেল আমদানির ডলার ব্যাংকগুলো নিজস্ব উৎস থেকে দিতে পারত। ডলার সংকটের কারণে এখন তা সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকও আইটিএফসিকে ঋণ শোধের জন্য প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহ করতে পারছে না। এ কারণে নির্দিষ্ট তারিখের পরিবর্তে ৩ থেকে ৪ কিস্তিতে অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে। এটি আন্তর্জাতিক নিয়মের পরিপন্থি।

বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত আইটিএফসি ঋণ পরিশোধে দেরি হলে অতিরিক্ত সুদ দিতে হয়। তবে বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো দেরি করলেও বর্তমানে তারা এ সুদ নিচ্ছে না। বিপিসির সঙ্গে দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক এবং আইটিএফসি প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার কারণে যা সম্ভব হচ্ছে। তবে এমন দেরি হতেই থাকলে খেলাপি সুদ বা বিলম্ব চার্জ পরিহার করা সম্ভব নাও হতে পারে। একই সঙ্গে নতুন ঋণ পেতেও সমস্যা হতে পারে।

বিপিসির চিঠিতে বলা হয়, বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি, দেশের অভ্যন্তরে ডলার স্বল্পতা এবং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নসহ নানা কারণে আইটিএফসির ঋণ পরিশোধের সময় ছয় মাস বা তারও বেশি বাড়ানো প্রয়োজন। এই অর্থবছরের জন্য আইটিএফসির অনুমোদিত ১৪০ কোটি ডলার পরিশোধের সময় ছয় মাসের বদলে এক বছর বা তারও বেশি সময় বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, বছরে দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৬৫ লাখ টন। মোট চাহিদার ৯০ শতাংশই আমদানি করা হয়। এর মধ্যে প্রায় ১৬ লাখ টন অপরিশোধিত। অপরিশোধিত জ্বালানির পুরোটাই আইটিএফসির ঋণে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আমদানি করা হয়। আর পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করা হয় প্রায় ৩৯ লাখ টন। পরিশোধিত তেলের মধ্যে আছে ডিজেল, জেট ফুয়েল, অকটেন ও ফার্নেস ওয়েল।

জানতে চাইলে বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ সমকালকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর সারাবিশ্ব ডলার সংকটে পড়েছে। পেট্রোলিয়াম করপোরেশনও ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়েছে। এ জন্য আইটিএফসির ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে উদ্যোগ নিতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখেছিলেন। পাওনা পরিশোধে এখন ডলার পাওয়া যাচ্ছে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছু ক্ষেত্রে পাওয়া যাচ্ছে। তবে এখনও সমস্যা পুরোপুরি কাটেনি।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, ডলারের যে সংকট দেখা দিয়েছে, তা অন্তত আরও এক বছর অব্যাহত থাকবে। তাই সব ক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধের কিস্তি পিছিয়ে দেওয়া হলে, ভবিষ্যতে অর্থনীতির ওপর চাপ আরও বাড়বে। তাই এ পরিস্থিতিতেই ডলারের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। কারণ জ্বালানি তেল আমদানিতে সমস্যা হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হবে। ফলে শিল্পের উৎপাদন বিঘ্নিত হবে। এতে রপ্তানি আয় কমে যেতে পারে।

প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, আইটিএফসি থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়। বিপিসি তেল বিক্রি করে পাওয়া অর্থ ব্যাংকে জমা করে। ব্যাংক ওই অর্থ দিয়ে ডলার কিনে আইটিএফসির ঋণ পরিশোধ করে। প্রতি এলসির ঋণ পরিশোধে বিপিসিকে ছয় মাস সময় দেওয়া হয়। তবে ডলারের অভাবে এখন ঋণ শোধ করা যাচ্ছে না। এর আগে কখনও বিপিসির কিস্তি পরিশোধের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়নি।
আইটিএফসির ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় ছয় মাস থেকে বাড়িয়ে এক বছর কিংবা আরও বেশি করার জন্য সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব শরিফা খানের সভাপতিত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। তবে আইটিএফসি সময় বাড়াতে রাজি না হওয়ায় এ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসেনি।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ কে এম শাহাবুদ্দিন সমকালকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আইটিএফসির প্রতিনিধির উপস্থিতিতে অর্থ মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধির অংশগ্রহণে সম্প্রতি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে ছয় মাস বাড়ানোর প্রস্তাব কার্যকর করা যাবে না বলে আইটিএফসি প্রতিনিধি জানায়। তাই ঋণ পরিশোধের সময় ছয় মাসই বহাল থাকবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক সমকালকে বলেন, সংগত কারণেই ডলার ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানিতে গত এক বছরে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার সরবরাহ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রেও আগামীতে প্রয়োজনীয় ডলার নিশ্চিত করা হবে।

https://www.samakal.com/economics/article/2301149464