৩ জানুয়ারি ২০২৩, মঙ্গলবার, ১১:০৬

শীতে বাড়ছে পোড়া রোগী খালি নেই আইসিইউ শয্যা

আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হয়েছে ছয় বছরের শিশু রওজা মণি। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে তার চিকিত্সা চলছে। গতকাল তোলা। ছবি : কালের কণ্ঠ

শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট। পর্যবেক্ষণকক্ষে ঢুকতেই চোখ গেল ছোট্ট রোকেয়ার দিকে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে পাঁচ বছরের মেয়েটি। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে পানি।

বারবার মুছে দিচ্ছেন মা মাহমুদা। তিনি জানান, তীব্র শীতের মধ্যে রান্নার চুলায় আগুন পোহাতে গিয়ে মেয়েটির শরীরের ১৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। গত ৩০ ডিসেম্বর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

পাশের শয্যায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের অগ্নিদগ্ধ ফাতেমা (২৪)। পাশে বসা তাঁর মা জানান, মোটা কাপড় পরে রান্না করছিলেন। হঠাৎ শরীরে আগুন ধরে যায়। চিকিৎসক জানিয়েছেন, শরীরের ১২ শতাংশ পুড়ে গেছে।

শুধু রোকেয়া আর ফাতেমা নন, শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি বেশির ভাগ রোগীই শীতের আগুনে পোড়া। এর মধ্যে শিশু ও নারীর সংখ্যা বেশি। এ ছাড়া রাজশাহী ও রংপুরেও পোড়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, অভিভাবকদের অসচেতনতা ও খামখেয়ালিতে এমন ঘটনা ঘটছে। শীতে আগুনের উত্তাপ নেওয়ার প্রতি সব বয়সী মানুষেরই ঝোঁক থাকে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এ সময় আগুনে পোড়া রোগীর সংখ্যা বাড়ে। মফস্বল শহরগুলোতে ভালো চিকিৎসা না পেয়ে সবাই ভিড় জমায় এখানে।

গতকাল সোমবার শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি ১১ জন আগুনে পোড়া রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শীতে আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হয়েছে ছয়জন। চারজন রান্নাঘরের গ্যাসের চুলা থেকে দগ্ধ হয়েছে। একজন পারিবারিক অনুষ্ঠানে বারবিকিউ পার্টি করতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হয়েছে।

বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি প্রকল্পের তথ্য বলছে, বছরে আনুমানিক পাঁচ লাখ লোক আগুনে পুড়ে যায়। শিল্পোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সচেতনতার অভাবে প্রতিবছর এই সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। বিশেষ করে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ও বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হয়ে পুড়ছেন শিশু থেকে বৃদ্ধ অনেকেই। পঙ্গুত্ব বরণ করছে অসংখ্য মানুষ। শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে গত এক বছরে শুধু বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছে ৫৬ হাজার ৬২৫ জন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে পাঁচ হাজার ১৯৩ জন, ফেব্রুয়ারিতে পাঁচ হাজার ১৩, মার্চে চার হাজার ৪১৬, এপ্রিলে তিন হাজার ৯০৪, মে মাসে চার হাজার ১২৯, জুনে চার হাজার ৬৭৩, জুলাইয়ে চার হাজার ২১৬, আগস্টে পাঁচ হাজার ৩২, সেপ্টেম্বরে চার হাজার ৭৯৪, অক্টোবরে পাঁচ হাজার ৪৮, নভেম্বরে পাঁচ হাজার ৮৪ ও ডিসেম্বরে চার হাজার ৯২০ জন চিকিৎসা নেয়। আর এক বছরে মৃত্যু হয় ৯০৮ জনের। এর মধ্যে এইচডিওতে ১২৪ জনের ও আইসিইউতে মৃত্যু হয় ৭৮৪ জনের।

বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি প্রকল্পগুলোর সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, শীতে আগুনে পোড়া রোগী বাড়ে। দেখা যায়, গোসল করার সময় গরম পানি পাতিলে করে গোসলখানায় নিতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। অথচ পানি বালতিতে করে নিয়ে গেলে এ দুর্ঘটনা ঘটত না। শীতের সময় আগুন পোহাতে গিয়েও, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে আগুনে পোড়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তিনি বলেন, ইংরেজি নববর্ষ বরণ করতে গিয়ে ফানুস ওড়াতে গিয়ে আগুনে পুড়ে চিকিৎসা নিতে এসেছে বেশ কয়েকজন। গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে বেলুন ওড়াতে গিয়ে আগুনে দগ্ধ একজন এসেছেন চিকিৎসা নিতে। বারবার গ্যাস বেলুন নিষিদ্ধ করার পরও মানুষ সতর্ক হচ্ছে না।

ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, “বিদ্যুতের ব্যবহার নিয়ে আমাদের আরো অনেকে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কারণ দেখা যায়, প্রতিবছর বিদ্যুস্পৃষ্ট হয়ে যারাই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, তাদের বেশির ভাগকেই পঙ্গুত্ব নিয়ে বাঁচতে হয়। এ ছাড়া শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র পরিষ্কার না রাখা, বাড়ির ছাদে কাপড় শুকানোর দড়ির সঙ্গে বিদ্যুতের তার ঝুলে থাকার কারণেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। তাই ৩ জুন নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের দিনটিকে ‘অগ্নিসচেতনতা দিবস’ পালন করা গেলে এবং এই দিনটিতে প্রতিবছর ব্যাপক প্রচার করা গেলে কিছুটা হলেও কমবে অগ্নিদুর্ঘটনা, মানুষ জানবে ও সচেতন হবে। ”

ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. এস এম আইউব হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের এখানে ৫০০ শয্যার একটিও খালি নেই। প্রতিদিন গড়ে গড়ে ৬০ জন রোগী আসছে জরুরি বিভাগে। আর ২৩০ থেকে ২৫০ রোগী আসে বহির্বিভাগে। এর মধ্যে খুবই সংকটাপন্ন ১০ থেকে ১২ জনকে ভর্তি করানো হয়। অপেক্ষায় থাকে তার কয়েক গুণ। ’

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একাধিক সূত্র জানায়, হাসপাতালটির পুরনো বার্ন ইউনিটের ২৫০ শয্যার বেশির ভাগ পূর্ণ থাকলে এখানকার ২০টি আইসিইউ ও এইচডিইউ সাপোর্ট পায় না রোগীরা। রোগীদের পাঠানো হয় শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে অথবা কোনো প্রাইভেট হাসপাতালে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুরনো বার্ন ইউনিটের সহযোগী অধ্যাপক বিধান চন্দ্র সরকার বলেন, ‘পোড়া রোগীদের অনেকের শ্বাসকষ্ট হয়, কিডনি ফেইলিওর হয়। এর বাইরেও অন্যান্য জটিলতা দেখা দেয়। এতে রোগীর আইসিইউ আর এইচডিইউ সাপোর্ট লাগে। অথচ আমাদের এখানে আইসিইউ আর এইচডিইউ নেই। ফলে বেশি পোড়া রোগী নিতে পারি না। তখন শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়। ৩০ শতাংশের নিচে পোড়া হলে রোগী ভর্তি করা হয়। ’

এদিকে রংপুরের গোপালপুরের আমেনা খাতুন আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হন। তাঁর ভাই আনারুল ইসলাম জানান, প্রায় সাত দিন ধরে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি তাঁর বোন। অসাবধানতার কারণে আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হন। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এম এ হামিদ পলাশ জানান, গত এক মাসে খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হওয়া ২৮ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। মারা গেছে এক শিশু।

 

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/01/03/1218885