১০ জুন ২০২২, শুক্রবার, ১:০৩

অভিযোগ যাদের ঘিরে তারাই তদন্ত কমিটিতে

সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি ঘিরে তৈরি হয়েছে ছয়-ছয়টি তদন্ত কমিটি। যেসব সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে এসব কমিটি হয়েছে; তাদের নামেই রয়েছে গাফিলতির অভিযোগ। বিশিষ্টজন মনে করছেন, তদারকি সংস্থাগুলো যথাযথ দায়িত্ব পালন করলে এড়ানো যেত এন্তার প্রাণহানি, কমে আসত ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা। গাফিলতির অভিযোগ ওঠার পরও তাদের কমিটিতে যুক্ত করায় এখন আগুন ও বিস্ম্ফোরণের আসল রহস্য ভেদ করা যাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

তদন্ত কমিটিতে আছেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, কাস্টমস, পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং বিস্ম্ফোরক অধিদপ্তরের প্রতিনিধিরা। বিএম ডিপোর মালিকরাও গঠন করেছেন একটি তদন্ত কমিটি।

এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবীর চৌধুরী বলেন, 'সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডির মূল কারণ ডিপো মালিক ও তদারকি সংস্থার গাফিলতি। তারা যদি আইনে নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করত তাহলে এই ভয়াবহ ঘটনা ঘটত না। এখন তাদের গঠিত তদন্ত কমিটি কতটা সঠিক প্রতিবেদন দেবে, তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে। সরকারের উচিত অগ্নিকাণ্ডের দায়-দায়িত্ব নির্ধারণে নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা।' বেসরকারি কনটেইনার ডিপো মালিকদের সংগঠন বিকডার সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান বলেন, '৩৮ বছর ধরে ব্যবসা করছি আমরা। লাইসেন্স নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে ১৯ ডিপো। ঘটনার পর আমাদের শত শত ত্রুটির কথা বলা হচ্ছে। যাঁরা বলছেন, তাঁরা এতদিন কোথায় ছিলেন। তদারকি সংস্থা যদি আমাদের যথাযথ গাইডলাইন দিত তাহলে হয়তো এমন দুর্ঘটনা এড়ানো যেত।'

ছাড়পত্র দিয়ে 'ঘুমিয়ে থাকা' পরিবেশ অধিদপ্তরও করেছে কমিটি :পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে পোলট্রি ফিড, ভোগ্যপণ্য ও তৈরি পোশাক রাখার ছাড়পত্র নিয়েছিল বিএম কনটেইনার ডিপো। রাসায়নিক বা বিপজ্জনক পণ্য রাখার কোনো ছাড়পত্র তারা নেয়নি। এ ব্যাপারে কোনো তথ্যও তারা পরিবেশ অধিদপ্তরকে দেয়নি। বছরের পর বছর ডিপো দিয়ে রাসায়নিক রপ্তানি করছে তারা। ট্র্যাজেডির পর এসে পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, ডিপো কর্তৃপক্ষের রাসায়নিক রাখার ছাড়পত্র নেই। এ বিষয়ে তারা ঢাকায় প্রতিবেদনও পাঠিয়েছে। ছাড়পত্র দেওয়ার পর কখনও পরিদর্শনে গিয়েছিলেন কিনা তা নিয়ে নিশ্চুপ দেখভালের দায়িত্বে থাকা এই তদারকি সংস্থা। এত প্রাণহানির পর ঘুম ভেঙেছে তাদের। এখন ডিপোটিতে কী কী রাসায়নিক রাখা হতো, তা জানতে নমুনা সংগ্রহ করেছে সংস্থাটি।

তদন্ত কমিটি করেছে লাইসেন্স দেওয়া কাস্টমসও :বেসরকারি ডিপো নির্মাণে লাইসেন্স দেয় চট্টগ্রাম কাস্টমস। লাইসেন্স অনুমোদনের আগে কিছু শর্তজুড়ে দেওয়া হয় ডিপো মালিকদের। শর্তগুলো পূরণ করতে পারলেই মেলে লাইসেন্স। ডিপোগুলো এসব শর্ত আদৌ বাস্তবায়ন করেছে কিনা, শর্ত অনুযায়ী ডিপো পরিচালনা করছে কিনা তা তদারকির দায়িত্ব তাদের। এসবের কোনোটিই যথাযথভাবে করেনি সংস্থাটি। এখন প্রাণহানির পর বিএম ডিপোর ঘটনায় তদন্ত কমিটি করেছে কাস্টমস। চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষের গঠিত কমিটির প্রধান হলেন অতিরিক্ত কমিশনার শফিউদ্দিন। অন্য সদস্যরা হলেন- যুগ্ম কমিশনার তারেক হাসান, সালাহউদ্দিন রিজভী, সহকারী কমিশনার উত্তম চাকমা ও রাজস্ব কর্মকর্তা বিকাশ দাশ।

নিয়মের ব্যাপারে উদাসীন বন্দরও করেছে কমিটি :বেসরকারি ডিপোর মূল ভোক্তা চট্টগ্রাম বন্দর। মূলত তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে ডিপোগুলো। সমুদ্রপথে যাওয়া প্রায় শতভাগ রপ্তানি কনটেইনার ও ৩৮ ধরনের আমদানি পণ্য রাজস্ব আদায় করা হয় ডিপোতে। এ জন্য ডিপোগুলোতে কোনো অনিয়ম আছে কিনা, রপ্তানি পণ্য যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে চার মাস পরপর পরিদর্শনের দায়িত্ব চট্টগ্রাম বন্দরের। তাদের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের একটি দল ডিপো পরিদর্শন করে পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন দেওয়ারও কথা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে। ওই প্রতিবেদনও দেওয়া হয় না নিয়মিত। এর ফলে উঠে আসে না প্রকৃত অনিয়ম। অনিয়মে ডুবে থাকা বিএম ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের পর এখন সেই বন্দর কর্তৃপক্ষও গঠন করেছে তদন্ত কমিটি। তাদের তিন সদস্যের কমিটিতে রয়েছে টার্মিনাল ম্যানেজার, ডেপুটি ডাইরেক্টর ও চট্টগ্রাম কাস্টমসের উপকমিশনার।

অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়া ফায়ার সার্ভিসেরও কমিটি :শ্রমবিধি অনুযায়ী, পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রপাতি নিশ্চিত, অগ্নিনির্বাপণে পানির রিজার্ভার, ফায়ার হাইড্রেন্ট ও ছয় মাস অন্তর অন্তর মহড়া দেওয়া নিশ্চিত করার কথা ছিল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের। তবে তারা তা করেনি। এ কারণে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড নেভাতে গিয়ে প্রাণহানি হয়েছে তাদের ৯ সদস্যেরও। এখন বিএম ডিপোর ঘটনায় তদন্ত কমিটি করেছে তারা। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের গঠিত সাত সদস্যের কমিটির প্রধান পরিচালক (প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. রেজাউল করিম। সদস্য সচিব হলেন চট্টগ্রাম বিভাগের উপপরিচালক মো. আনিছুর রহমান।

শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যর্থ কলকারখানা দপ্তরও কমিটিতে :বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা ২০১৫ অনুযায়ী, ডিপোতে কর্মরত শ্রমিকদের নিয়ে অগ্নিনির্বাপক দল, উদ্ধারকারী দল ও প্রাথমিক চিকিৎসা দল গঠনের কথা ছিল। এই কমিটি গঠন করা হয়েছে কিনা তা দেখভালের দায়িত্ব ছিল কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের। গত ডিসেম্বরে পরিদর্শনে গিয়ে বিএম ডিপোতে অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে অনিয়ম পেলেও নোটিশ দিয়ে দায় সেরেছে তারা। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর এখন তারা রয়েছে জেলা প্রশাসনের গঠিত কমিটিতে।

বিভাগীয় কমিশন ও জেলা প্রশাসনের কমিটিতেও আছে ওরা :সীতাকুণ্ডের ঘটনায় চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশন ৯ সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে। প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে। তবে এই কমিটিতে আছেন দায়িত্বে অবহেলা করা বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিও। জেলা প্রশাসন গঠিত কমিটির আহ্বায়ক উপপরিচালক (স্থানীয় সরকার) বদিউল আলম। এখানেও আছেন আগে গাফিলতি করা সেই সব সংস্থার প্রতিনিধি।

https://samakal.com/whole-country/article/2206115953