২৬ মে ২০২২, বৃহস্পতিবার, ১:০৯

ডেঙ্গু ঝুঁকি বাড়ছে

ঢাকায় বেড়েছে এডিস মশার ঘনত্ব। ডেঙ্গু বাহক এই মশার কামড়ে অতিষ্ঠ নগরবাসী। যতই দিন যাচ্ছে, ততই বাড়ছে এর প্রকোপ। এদিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন অনেকে। সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালেও বাড়ছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। রাজধানীর প্রায় প্রতিটি ভবনের বেজমেন্ট কিংবা পরিত্যক্ত বিভিন্ন পাত্র এখন এডিস মশার প্রজনন স্থল। বস্তি কিংবা অভিজাত এলাকা, সব খানেই মিলছে এডিসের লার্ভা। সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের চিরুনি অভিযানেও উঠে এসেছে এ তথ্য। বর্ষা শুরু হলে এডিসের ঘনত্ব আরও বাড়তে পারে এমনটাই আশঙ্কা করেছেন কীটতত্ত্ববিদরা। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, চলতি বছর রাজধানীতে ডেঙ্গুর ঝুঁকি রয়েছে

গত বছরের চেয়ে এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ কয়েকগুণ বাড়তে পারে। একই আশঙ্কা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও। সম্প্রতি বর্ষা-পূর্ব মশা জরিপে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন- করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। সামনে বর্ষা কাল। এ অবস্থায় ডেঙ্গু পরিস্থিতির যদি অবনতি হয় তাহলে তা সামাল দেয়া কঠিন হবে। মশক নিধনের দায়িত্বে থাকা দুই সিটি করপোরেশন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রস্তুতির কথা বলে এলেও মাঠ পর্যায়ে এখনো কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। অনেকেই বলছেন, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মশা মারতে কিটনাশক প্রয়োগ ও চিরুনি অভিযানের নামে জরিমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছেন। জনসচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগী না হলে শুধু ওষুধ ছিটিয়ে কিংবা জনগণের জরিমানা করে মশার বিস্তার কমানো যাবে না। এজন্য সিটি করপোরেশনেকে আন্তরিকতার সঙ্গে নিয়মিত তদারকি করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেল্‌থ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার সূত্রে জানা যায়, ২৫শে মে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৬ জন, ২৩শে মে একদিনে ১২ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে।

চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ২৮২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এডিস মশা নিধনে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করে আসছে। সংস্থাটির অভিযানকালে নগরীর বিভিন্ন বাসা বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা মিলেছে। একই সঙ্গে নির্মাণাধীন বিভিন্ন ভবনের নিচে মিলছে ডেঙ্গু বাহক এই মশার লার্ভা। এজন্য সংশ্লিষ্টদেরকে জরিমানাও করা হয়েছে। তবে কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, এই অভিযান যথেষ্ট নয়। ঢাকা শহরে লাখ লাখ বাসাবাড়ির আনাচে-কানাচে এডিসের প্রজনন ক্ষেত্র রয়েছে। মাত্র কয়েক দিনের চিরুনি অভিযানে মশার আবাসস্থল ধ্বংস করা যাবে না।

এজন্য সিটি করপোরেশনের প্রতিটি পাড়া-মহল্লার অলিগলি একদিনে একই সঙ্গে কিটনাশক ছিটিয়ে অভিযানে নামতে হবে। মশক নিধনে কর্মীর সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। বিভিন্ন ক্র্যাশ প্রোগ্রাম হাতে নিতে হবে। নগরবাসী বলছেন, সিটি করপোরেশন প্রতি বছর সকালে বিকালে কিটনাশক প্রয়োগ করে আসার কথা বললেও তা যথেষ্ট নয়। মশককর্মীরা কেবল মাত্র নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় লার্ভিসাইডিং ও এডাল্টিসাইডিং প্রয়োগ করে। অধিকাংশ বাসাবাড়ি কিংবা অলি- গলিতে তাদেরকে দেখা যায় না। এমনকি তাদের ফগার মেশিনের সাহায্যে ছিটানো ওষুধে মশা মরে না। মশক নিধনে সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। তারা বলছেন-মশক নিধনে যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তার সঠিক তদারকি হচ্ছে না। ফলে অর্থ খরচ হচ্ছে কিন্তু যথাযথ মশক নিধন হচ্ছে না।

এডিস নিয়ন্ত্রণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, আমাদের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেশি। সেই প্রেক্ষিতেই আমরা এবারের কর্মপরিকল্পনা সাজিয়েছি। কর্মপরিকল্পনার আলোকে ১লা আষাঢ় (১৫ই জুন) থেকেই আমাদের কার্যক্রম আমরা পূর্ণাঙ্গভাবে শুরু করবো। আমাদের ১০টি অঞ্চলে ১০জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবো। এছাড়াও আমাদের চিরুনি অভিযান পরিচালিত হবে। গতবার আমরা ১ মাস নিয়ন্ত্রণ কক্ষ পরিচালনা করেছিলাম। এবার সেটা আমরা ২ মাস ধরে পরিচালনা করবো এবং এই নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মাধ্যমে আমরা চিরুনি অভিযানগুলো তদারকি করবো।

কীটতত্ত্ববিদ ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, সামনে ডেঙ্গুর প্রকোপ আসছে। রাজধানী ঢাকা সব সময় ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে থাকে। করপোরেশনের অভিযানে দেখা গেছে বিভিন্ন স্থানে জমা পানিতে এডিসের লার্ভা রয়েছে। ডেঙ্গু রোগীও শনাক্ত হয়েছে। সিটি করপোরেশনের উচিত দ্রুত সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের শনাক্ত করা এবং তাদের বাসাবাড়ির আশপাশে এডিসের লার্ভা ধ্বংস করা। আক্রান্তদের পরিবারের সদস্যদের শরীরে ডেঙ্গুবাহিত ভাইরাস আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করা। যেন এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে না পারে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে মশক নিধনে ব্যবহৃত কীটনাশকে বাজেট রাখা হয়েছে সাড়ে বাইশ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত ২২শে মে পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১৯ দশমিক ৯২ কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের ৮৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। ফগার মেশিন পরিবহন ব্যয় খাতে ৩ দশমিক ৭৫ কোটি টাকার মধ্যে ব্যয় হয়েছে ৭৩ লাখ টাকা। মশক নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি ক্রয় ৯ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও ইতিমধ্যে ৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। সিটি করপোরেশনের ‘মশক নিয়ন্ত্রণে বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা ২০২২’-এ দেখা যায়, চলতি বছরের মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, আইইডিসিআর, কীটতত্ত্ববিদ, ওয়াসা, রেলওয়ে, মন্ত্রণালয়, রিহ্যাব, রাজউক, পিডব্লিউডি, ডিএমপি এবং গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করবেন। বিশেষজ্ঞ দ্বারা অঞ্চল ভিত্তিতে মশক কর্মীদের ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। জনসম্পৃক্তকরণের অংশ হিসেবে আষাঢ, শ্র্রাবণ ও ভাদ্র মাসে লার্ভিসাইডিং এর সময়ে মশক সুপারভাইজারগণ হ্যান্ড মাইকে জিঙ্গেল বাজাবে।

বছরব্যাপী মসজিদে জুম্মার নামাজের খুৎবার আগে ইমাম সাহেব যে সমস্ত এলাকায় ১ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কীটনাশক প্রয়োগ হয়নি সেগুলোর তালিকা নিয়ে পরের দিন শনিবার কাউন্সিলর অফিসে জমা দেয়ার জন্য বলবেন এবং কাউন্সিলরগণ সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন। জনসচেতনতার জন্য মশা নিয়ন্ত্রণে করণীয় উল্লেখযোগ্য তথ্য সংবলিত লিফলেট বিতরণ করা হবে। আষাঢ় থেকে আশ্বিন পর্যন্ত এই চার মাস ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডে প্রয়োজন অনুযায়ী মাইকিং করা হবে। বছরব্যাপী প্রতিদিন প্রতি ওয়ার্ডে ৭ জন কর্মী দিয়ে লার্ভিসাইডিং এবং ৬ জন কর্মী দিয়ে এডাল্টিসাইডিং করা হবে। আষাঢ় থেকে আশ্বিন এই ৪ মাস ম্যালাথিয়ন এবং বাকি ৮ মাস ডেল্টামেথ্রিন ব্যবহার হবে। সারা বছর টেমিফস লার্ভিসাইড হিসেবে ব্যবহার করা হবে। শ্রাবণ-ভাদ্র মাস পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডে প্রয়োজন অনুযায়ী ১৩ জন মশক কর্মী দিয়ে সকালে ও বিকালে কীটনাশক প্রয়োগের মাধ্যমে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা হবে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরাসরি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ তদারকিযোগ্য চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা স্থাপন হবে (আইসিটি সেলের সমন্বয়ে)। আষাঢ়-আশ্বিন (০৪ মাস) প্রতিটিপ অঞ্চলে ১ জন করে মোট ১০ জন নির্বাহী মাজিস্ট্রেট এর মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। আষাঢ় থেকে আশ্বিন মাসে ডেঙ্গু রোগীর ঠিকানা সংগ্রহ করে ওয়ার্ড ভিত্তিক বাড়িতে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হবে। ছাদ বাগান সঠিকভাবে পরিচর্যা করার বাগান মালিকদের প্রেরণা প্রদান করা হবে। বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী স্বাস্থ্য বিভাগের চাহিদার প্রেক্ষিতে ভাণ্ডার ও ক্রয় বিভাগ সারা বছরের জন্য কীটনাশক ও যন্ত্রপাতির মজুত গড়ে তোলা হবে। এছাড়া বছরব্যাপী কর্মপরিকল্পনার আলোকে কার্যক্রম চলমান থাকায় বর্তমান সময়ে অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় মশকের উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন জানায়, ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রতিদিন সকালে লার্ভিসাইডিং এবং বিকালে ফগিং করা হচ্ছে। দশদিনের বিশেষ মশক নিধন অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এছাড়া প্রায় ৯০০ মশককর্মী এবং ১০০ সুপারভাইজার মশা নিধনে কাজ করছে। দশটায় দশমিনিট প্রতি শনিবার স্লোগানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য সচেতনতা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রতিটি ওয়ার্ডে মাইকিং করা হচ্ছে। এডিস মশার লার্ভা নিরসনে প্রতিটি সরকারি- বেসরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেয়া হয়েছে। নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে এবং এডিসের লার্ভা পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।

https://mzamin.com/news.php?news=4604