১৯ জানুয়ারি ২০২২, বুধবার, ৩:৫৯

চাপ বাড়ছে হাসপাতালে

ফের দ্রুতগতিতে বাড়ছে করোনার সংক্রমণ। দেশে দৈনিক শনাক্তের হার এখন ২৪ শতাংশের কাছাকাছি। প্রায় প্রতি চারজনে একজন করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছেন। করোনার তৃতীয় ঢেউয়ে দেশের বিভিন্ন জেলার মতো ঢাকার হাসপাতালগুলোতেও বাড়ছে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। নতুন শনাক্ত হওয়া রোগীদের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশই রয়েছেন রাজধানীতে। গত এক সপ্তাহে ঢাকা মহানগরের হাসপাতালগুলোতে করোনা ইউনিটে সাধারণ সিটে রোগী ভর্তি বৃদ্ধির হার ৮৬ শতাংশেরও বেশি। এ সময়ে আইসিইউতে রোগী বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৫৬ শতাংশে। এতে চাপ বাড়ছে হাসপাতালগুলোতে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ)-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতালে ভর্তি রোগীরা শতভাগই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। স্বাস্থ্যমন্ত্রীও বলেছেন, হাসপাতালে রোগীর চাপ আবার বেড়ে যাচ্ছে। এখন যেভাবে বাড়ছে, তাতে আগামী এক-দেড় মাসের মধ্যে হাসপাতালে কোনো জায়গা থাকবে না। তখন চিকিৎসা দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গত এক সপ্তাহের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঢাকা মহানগরীতে চলতি মাসের ১১ই জানুয়ারি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল মিলে মোট ৪ হাজার ৬৪৬ কোভিড সাধারণ শয্যার বিপরীতে ভর্তি রোগী ছিল ৫২৪ জন। সেখানে গতকাল (১৮ই জানুয়ারি) ৪ হাজার ৬৮৬ কোভিড সাধারণ শয্যার বিপরীতে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৭৬ জনে। সাতদিনে রোগী বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৫২ জন। করোনা রোগী ভর্তি বেড়ে যাওয়ার হার ৮৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। মহানগরীতে গত ১১ই জানুয়ারি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল মিলে আইসিইউতে ৭৬৪ শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি ছিল ৮১ জন। তা গতকাল ৭৭৮ সিটের বিপরীতে ভর্তি রোগী ৪৫ জন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৬ জনে। যা শতকরা হিসেবে ৫৬ শতাংশ বেড়েছে। একইভাবে করোনার এইচডিইউ শয্যার ৫২৬ বিপরীতে রোগী ভর্তি ২০ জন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৯ জনে। ঢাকা মহানগরীতে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল মিলে হাসপাতালের সংখ্যা ৪৭টি। এরমধ্যে সরকারি ১৫টি হাসপাতাল করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে। গত এক সপ্তাহে সারা দেশে ১৩ হাজার ৪৬৬ সাধারণ শয্যার বিপরীতে ভর্তি করোনা রোগী ৬২৫ জন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৪৬ জন। আইসিইউতে ১ হাজার ২৩৭ শয্যার বিপরীতে ভর্তি রোগী ৬৩ জন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০০ জনে। করোনার এইচডিইউ শয্যার ৭১৩-এর বিপরীতে ২০ জন বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১০২ জনে।

এদিকে, গত বছরের ডিসেম্বরের শেষদিক থেকে রোগীর চাপ ধীরে ধীরে বাড়ছে। শ্বাসকষ্ট, খুশখুশে কাশি, জ্বর, শরীর ব্যথাসহ বিভিন্ন লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে আসা রোগীর বেশিরভাগেরই করোনা শনাক্ত হচ্ছে। করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট দেশে শনাক্ত হওয়ার পর থেকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। যদিও নতুন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত এখনো খুব একটা নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘরে ঘরে জ্বর-সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত মানুষ। ঠাণ্ডাজ্বর, গলাব্যথা, মাথাব্যথায় আক্রান্তের হার বেড়েছে। এ ধরনের রোগীদের করোনা টেস্ট করালেই পজেটিভ আসছে। কিন্তু অনীহার কারণে টেস্ট করাতে যাচ্ছেন না অধিকাংশ মানুষ। উপসর্গ থাকলেও শনাক্ত না হওয়ায় করোনা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভিসি অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ গতকাল এক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে বলেন, ঘরে ঘরে জ্বর-সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত রোগী রয়েছে। দেশে শনাক্ত হওয়া ২০ শতাংশ রোগীই বর্তমানে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। আর বাকি ৮০ শতাংশ রোগী করোনার অতি সংক্রামক ধরন ডেল্টায় আক্রান্ত। তবে উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের শতভাগই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিত। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট গুণিতক হারে বৃদ্ধির আশঙ্কা করেন তিনি। ওমিক্রন সংক্রমণে মৃদু উপসর্গ থাকায় হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে ওমিক্রন না পাওয়ার কারণ হতে পারে বলে জানান তিনি। পাশাপাশি মৃদু উপসর্গের রোগীদের মধ্যে টেস্ট না করার প্রবণতা রয়েছে। তাই প্রাপ্ত ফলাফলের চেয়েও অনেক বেশি ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগী রয়েছে বলে মনে করে গবেষণা দল।

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, এখন ঘরে ঘরে ঠাণ্ডা-জ্বর-সর্দিজ্বরে আক্রান্তের হার বাড়ছে। অনেকের কাশিও রয়েছে। বিভিন্ন বয়সী মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। করোনার উপসর্গগুলোও একই রকম। তাই অনীহা না করে করোনা টেস্ট করতে হবে। তিনি আরও বলেন, করোনা আক্রান্তদের আলাদা করে আইসোলেশনে রাখতে হবে। নয়তো আক্রান্তের হার নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে। সব বয়সী মানুষের অ্যান্টিবডি একরকম থাকে না। অনেকেই বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত থাকেন। তাই উপসর্গ দেখা দিলে টেস্ট করেন, চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবন করেন। করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন নিয়ে এখন ঘরে ঘরে চলছে আলোচনা। দেশে বাড়ছে ওমিক্রন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন অ্যানালাইসিস’-এর গবেষণা বলছে, ওমিক্রনের সাধারণ উপসর্গগুলোর মধ্যে কাশি, অত্যধিক ক্লান্তি, নাক বন্ধ এবং নাক দিয়ে পানি পড়া অন্যতম। এ ছাড়াও হালকা জ্বর, ঘামাচি, শরীরে ব্যথা, অতিরিক্ত ঘামও দেখা দিতে পারে। লন্ডনের কিংস কলেজের জেনেটিক এপিডেমিওলজির অধ্যাপক টিম স্পেক্টর একটি সমীক্ষার মাধ্যমে জানিয়েছেন, ওমিক্রন আক্রান্ত রোগীদের বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, খিদে হ্রাস পাওয়ার মতো উপসর্গও দেখা দিচ্ছে। এ ছাড়া মাথাব্যথা, গলা চুলকানো বা গলা জ্বালা ভাবও রয়েছে।

গত ১৭ই জানুয়ারি সচিবালয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, হাসপাতালে করোনা রোগী ইতিমধ্যে ১ হাজার ২০০ হয়েছে। প্রতিদিন ৫ হাজার করে বাড়লে, এক সময় তো ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার, ১০ হাজারে যেতে সময় লাগবে না। ১০ শতাংশ হলেও তো প্রতিদিন এক হাজার রোগী হাসপাতালে ভর্তি হবেন। আমাদের বেড আছে সবমিলিয়ে ২০ হাজার। তাহলে এটা ফিলাপ হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। হাসপাতালে রোগীর চাপ আবার বেড়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, এখন যেভাবে বাড়ছে, তাতে আগামী এক-দেড় মাসের মধ্যেই হাসপাতালে কোনো জায়গা থাকবে না। তখন চিকিৎসা দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এ নিয়ে সরকার চিন্তিত ও আতঙ্কিত বলে তিনি জানান। মন্ত্রী সবাইকে মাস্ক পরার আহ্বান জানিয়ে বলেন, সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। এছাড়া সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার অনুরোধও করেন তিনি।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=312022&cat=2