১৮ জানুয়ারি ২০২২, মঙ্গলবার, ৩:২৭

অধিদফতর করার প্রস্তাব আজ কৃষি মন্ত্রণালয়ে

প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতায় অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ ‘বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি’

কারিগরি দক্ষতা সম্পন্ন জনবলের অভাব; দক্ষ বীজ প্রযুক্তিবিদদের স্থায়ী ক্যাডার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব

মানসম্মত বীজে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ফসলের উৎপাদন বাড়তে পারে। অল্প জমিতে বেশি উৎপাদন করতে হলে ভালো বীজ নিশ্চিত করা জরুরি। প্রত্যয়ন এজেন্সি ফসলের জাত ছাড়করণ ও মান নিশ্চিতকরণের কাজ করে থাকে; কিন্তু দক্ষ জনবল না থাকায় মানসম্পন্ন বীজ নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় ‘বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি’কে অধিদফতরে রূপ দেয়ার প্রস্তাব এসেছে কৃষি মন্ত্রণালয়ে। গতকাল কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: সায়েদুল ইসলামের সভাপতিত্বে জাতীয় বীজ বোর্ডের ১০৬তম সভা অনুষ্ঠিত হবে। এই সভায় এটি উপস্থাপিত হবে বলে নিশ্চিত করেছেন বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির পরিচালক শুধেন্দু শেখর মালাকার।

অধিদফতর করার প্রস্তাবনায় বলা হয়, বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষিতে সবিশেষ উন্নতি সাধন করার মতো জলবায়ু এবং উর্বর মাটি আছে আমাদের, যা পৃথিবীর খুব কম দেশেই আছে। কৃষির উন্নতির সাধন তথা খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে বীজের গুণগতমানের উৎকর্ষ সাধন কৃষকপর্যায়ে ভালো বীজ পৌঁছানো এবং ভেজাল বীজ নিয়ন্ত্রণে রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ২২ জানুয়ারি প্রত্যয়ন এজেন্সি (এসসিএ) প্রতিষ্ঠা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির জনবল ২২৩ থেকে ৫৬৯ জনে উন্নীত করেন। পরবর্তী সময়ে ২০১৯ সালে ৬৪ জন গাড়ি চালক পদ সৃজনসহ মোট জনবল ৬৩৩-এ উন্নীত হয়। বর্তমান সরকারের আমলে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনসহ বিদেশে চাল রফতানি ও খাদ্যসহায়তা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে।

প্রস্তাবনায় আরো বলা হয়, বাংলাদেশ ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে দানা জাতীয় ফসল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল এক কোটি মেট্রিক টন। বর্তমানে দানাজাতীয় ফসল উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪.০৯৭ কোটি টন (বিবিএস ২০২০)। ফসলের উন্নত জাত, মানসম্পন্ন বীজ, সার, বালাইনাশক, সেচ ইত্যাদির ফলপ্রসূ ব্যবহারের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদনের এ অর্জন সম্ভব হয়েছে। তবে এই অভাবনীয় উন্নতির মূল চাবিকাঠি হচ্ছে ফসলের উন্নত জাত এবং মানসম্পন্ন বীজের ব্যবহার। প্রত্যয়ন এজেন্সি ফসলের জাত ছাড়করণ ও মান নিশ্চিতকরণের কাজ করে থাকে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) এবং বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির কাজের ধরন আলাদা। বর্তমানে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সিতে দ্বিতীয় গ্রেডে একজন, তৃতীয় গ্রেডে ১০ জন, পঞ্চম গ্রেডে ৭৮ জন, ষষ্ঠ চারজন, নবম গ্রেডে ১৫৮ জনসহ মোট ২৫১ জন বিসিএস (কৃষি) কর্মকর্তার পদ আছে। এ ক্যাডার পদগুলোর জনবল ডিএই থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রদান করা হয়।

এসসিএ’র সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী, বিসিএস (কৃষি) ক্যাডার (ডিএই) হতে নবম গ্রেডের কর্মকর্তা পদায়ন হন এবং পদায়নের পর কর্মকর্তারা ফসলের নতুন জাত ছাড়করণে ডিইউএস টেস্ট (স্বতন্ত্রতা, অভিন্নতা এবং স্থিতিশীলতা পরীক্ষা), ভিসিইউ টেস্ট, ডিএনএ ফিঙ্গার প্রিন্টিং টেস্ট, হাইব্রিড ও ইনব্রিড ফসলের জাত মূল্যায়ন, মাঠ পরিদর্শন, বীজ পরীক্ষা এবং মার্কেট মনিটরিংয়ের মাধ্যমে বীজ প্রত্যয়ন কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। বীজের এরূপ কারিগরি বিশেষ দক্ষতা অর্জনের পর নবম গ্রেডের ১৫৮টি পদ থেকে ষষ্ঠ গ্রেডে চারটি পদোন্নতির সুযোগ থাকায় বাকি ১৫৪ কর্মকর্তাকে ডিএইতে আবার ফিরে যেতে হয়। অনুরূপভাবে দ্বিতীয়, তৃতীয়, পঞ্চম গ্রেডে পদোন্নতির সময় ডিএই থেকে বেশির ভাগ কর্মকর্তা এসসিএ-তে পদায়িত হন। তখন বীজের সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী কাজের সাথে সম্পৃক্ত হতে সময় ও মেধার অপচয় হয়। সর্বোপরি প্রতিনিয়ত বদলিজনিত ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ পদবিন্যাসের কারণে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন জনবলের অভাবে একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামোতে সদর দফতর, আঞ্চলিক অফিস, জেলা বীজ প্রত্যয়ন অফিসগুলোয় জনবলের সংস্থান অনুযায়ী গাড়ি, অফিস সরঞ্জামাদির সংস্থান টিওঅ্যান্ডই-ভুক্ত করা হয়নি। এ অসঙ্গতি থাকার জন্য বীজ প্রত্যয়নের পেশাগত কারিগরি কাজ দারুণভাবে বিঘিœত হচ্ছে। কিন্তু বীজ পরীক্ষাগারে দক্ষ জনবলের দীর্ঘমেয়াদি অবস্থানের সুযোগ না থাকায় কেন্দ্রীয় বীজ পরীক্ষাগারকে ইন্টার ন্যাশনাল সিড টেস্টিং অ্যাসোসিয়শন (ইস্টা) এক্রিডেটরি (এক্রিডাইটেড ল্যাবরেটরি) হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বিদেশে বাংলাদেশের বীজের বিপুল চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সার্টিফিকেটের অভাবে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে।

জাতীয় বীজ নীতি ১৯৯৩-এর ১১(৪) অনুযায়ী ‘বীজ শিল্পের লাগাতার প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি খাতে দক্ষ ও অভিজ্ঞ বীজ প্রযুক্তিবিদদের একটি স্থায়ী ক্যাডার প্রতিষ্ঠা বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির অবকাঠামো এবং পরীক্ষাগারের সুবিধা বৃদ্ধি, অধিকসংখ্যক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রযুক্তিবিদ এবং ক্রমান্বয়ে বীজ অনুমোদন সংস্থাকে শক্তিশালী করার নিমিত্তে নিজের জন্য সাব-ক্যাডার গঠনের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। উল্লেখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করে ২০১৮ সালের ২৩ ও ২৪ এপ্রিল কৃষি মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির খসড়া পর্যালোচনা সভায় সুপারিশ/সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয় যে, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির সক্ষমতা বৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে এসসিএ তার ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। এ পরিপ্রেক্ষিতে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি কার্যক্রমকে জোরদার করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে সাব-ক্যাডার করার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।

অধিদফতর করার প্রস্তাবনায় আরো উল্লেখ করা হয়, কৃষি মন্ত্রণালয় ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি অর্ধবার্ষিক মূল্যায়ন পর্যালোচনা সভায় সুপারিশ প্রদান করা হয়। যেখানে উল্লেখ আছে, ‘বীজের মান নিয়ন্ত্রণ কৃষির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির কর্মকর্তারা ডিএই কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত বিধায় প্রতিষ্ঠানের জনবল অস্থায়ী। ফলে প্রতিষ্ঠান কাঠামোগত দুর্বলতা রয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ‘বিসিএস (কৃষি) : বীজ প্রত্যয়ন’ শিরোনামে পৃথক শিডিউলভুক্ত করে একটি সাব-ক্যাডার করা করা যেতে পারে। ‘বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সিকে বীজ প্রত্যয়ন অধিদফতর হিসেবে গঠন, অধিদফতরের জনবলের পদ সৃজন এবং বিসিএস (কৃষি) বীজ : প্রত্যয়ন’ ক্যাডার সৃষ্টির বিষয়ে এসসিএ’র মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা ও স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে সেমিনারের সুপারিশ করা হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ২(৩)-এর আওতায় ২০১৬ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে কৃষিজ খাদ্য উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করার প্রত্যয়ে ফসলের উন্নত জাত ছাড়করণ, বীজ প্রত্যয়ন ও বাজার পরিবীক্ষণের কাজ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতাসম্পন্ন অস্থায়ী জনবল নিয়ে প্রতিষ্ঠান গঠনের জন্য বীজ প্রত্যয়ন অধিদফতরের পদ সৃজন প্রয়োজন। জাতীয় বীজ নীতি-১৯৯৩-এর আলোকে এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) সভার সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সিকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সিকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বীজ আইন, ২০১৮তে ‘বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি’ পরিবর্তন করে ‘বীজ প্রত্যয়ন অধিদফতর’ হিসেবে অন্তর্ভুক্তকরণের প্রস্তাব বিবেচনা করার জন্য বলা হয় এই প্রস্তাবনায়।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/637381