১৬ জানুয়ারি ২০২২, রবিবার, ৭:১৫

প্রাইভেটে আইন না মানার প্রতিযোগিতা

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেহাল দশা

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজেদের মান উন্নয়নে নেই তোড়জোড়। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় অর্থ মেলার পরও ব্যয় করেনি। আর বরাবরের মতো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আইন না মানার প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভিভাবক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কর্তৃক প্রকাশিত ২০২০ সালে বার্ষিক প্রতিবেদনে নানা তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদের কাছে পেশ করে ইউজিসি। এ সময় প্রেসিডেন্ট ইউজিসিকে প্রহরী হিসেবে কাজের জন্য নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে তিনি দেশে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের তাগাদা দেন। ২০২০ সালে পাবলিক ৪৬টি ও প্রাইভেট ১০৪টি বিশ্ববিদ্যালয় চালু ছিল।

ইউজিসি’র সর্বশেষ এই প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ৮টি পাবলিক ও ২৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় এক টাকাও ব্যয় করেনি। ১-৫ লাখ টাকা ব্যয় করেছে ৩১টি বিশ্ববিদ্যালয়। ৫-১০ লাখ টাকা ব্যয় করেছে ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়। এর অধিকাংশই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।

আবার কিছু গবেষণা নিয়ে আছে ভ্রুকুটি। যেমন, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এক কোটি ২৭ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। কিন্তু তাদের প্রকাশনা সংখ্যা মাত্র একটি। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ৭০ লাখ টাকা এবং রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তিন লাখ ৪৩ হাজার টাকা ব্যয় করলেও একটি করে প্রকাশনা প্রকাশ করেছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়, কিন্তু ২০২০ সালে নেই কোনো প্রকাশনা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে গবেষণায় সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা। তাদের প্রকাশনার সংখ্যা ছিল ৪৪৫। এদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২০২০ সালে ৩৭৮টি প্রকাশনা বের করেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের এতে ব্যয় হয়েছে ৫৫ কোটি ২৩ লাখ টাকা। আবার ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ১২ কোটি ১৬ লাখ, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ ৯ কোটি ৩০ লাখ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ আট কোটি ৩৭ লাখ এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ৬ কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যয় করেছে গবেষণায়।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ৬ কোটি ১৯ লাখ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ৪ কোটি ৭৭ লাখ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ৪ কোটি এবং বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় ৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয় করেছে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৪৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৮৩ জন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৪৩। আর এই তিন বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিলে অনুপাত দাঁড়ায় ১:২১।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাত ছিল সন্তোষজনক, ১:২২। কিন্তু এরমধ্যে ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ-এর অনুপাত ছিল ১:৫২। এ ছাড়াও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে ১:৪০, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ১:৩৫, রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকায় ১:৩৭।

৪৬টি পাবলকি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৯ লাখ ১৫ হাজার ৯ জন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত ও অঙ্গীভূত কলেজ এবং মাদ্রাসা মিলিয়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৩ লাখ ৬২ হাজার ১৮৭ জন। ২০১৯ সালে ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ ৯৬ হাজার ২৭৬ জন। ২০২০ সালে হয় ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭৬৯। এক বছরে ছাত্রী সংখ্যা বেড়েছে ৪২ হাজার ৪৯৩ জন। এদিকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কমছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৬১ হাজার ৭৯২ জন। ২০১৯-এ হয় ৩ লাখ ৪৯ হাজার ১৬০ ও ২০২০-এ আরও কমে হয় ৩ লাখ ২৮ হাজার ৫৬৯ জন। ২০১৯ থেকে ২০২০ সালে কমেছে ২০ হাজার ৪৭১ শিক্ষার্থী। হ্রাসের অনুপাত ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ।

এদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়েছে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে পড়তে এসেছিলেন ৪৮২ জন শিক্ষার্থী। ২০২০ সালে তা হয় ৭৬৭ জন। আর প্রাইভেটেও বেড়েছে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা। ২০১৯ সালে ছিল ১ হাজার ৪৬৭ জন। ২০২০ সালে তা বেড়ে হয় ১ হাজার ৫৫০ জন। ৩২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীরা অধ্যয়নরত ছিলেন।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয়ে এগিয়ে বিজ্ঞান, চিকিৎসা, প্রকৌশল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ-এর শিক্ষার্থী মাথাপিছু বার্ষিক ব্যয় সর্বাধিক ৭ লাখ ৫২ হাজার ৬৯৭ টাকা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শিক্ষার্থীপ্রতি বার্ষিক ব্যয় ৫ লাখ ৬৬ হাজার ১৬২ টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের মধ্যে এ বছর ঢাকা, বাংলাদেশ কৃষি, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস, সিলেট কৃষি, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, বেগম রোকেয়া, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম, রবীন্দ্র, শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাথাপিছু গড় ব্যয় বিগত বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে।

অপরদিকে রাজশাহী, বাংলাদেশ প্রকৌশল, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর, ইসলামী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, খুলনা, বাংলাদেশ উন্মুক্ত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, শেরেবাংলা কৃষি, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, জগন্নাথ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, বাংলাদেশ টেক্সটাইল, বরিশাল, রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটি’র শিক্ষার্থীদের মাথাপিছু গড় ব্যয় বিগত বছরের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে।

কমিশন কর্তৃক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কোনো রাজস্ব খাতে বরাদ্দ দেয়া হয় না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ও অঙ্গীভূত ২ হাজার ২৫৭টি কলেজের ২৯ লাখ ৭৫ হাজার ৮১৩ জন শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ব্যয় তাদের নিজস্ব আয় হয়ে নির্বাহ হয়, যা এ বছর শিক্ষার্থী প্রতি ১ মাত্র ১৫১ টাকা। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২টি আঞ্চলিক কেন্দ্র, ৮০টি উপ-আঞ্চলিক কেন্দ্র, ১ হাজার ৫৪২টি স্টাডি সেন্টারের মাধ্যমে ৬টি স্কুলের অধীনে ৫৬টি আনুষ্ঠানিক ও ১৯টি অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কর্মসূচির অধীনে এসএসসি ১ লাখ ৭২ হাজার ৮৮৪ জন ও এইচএসসি প্রোগ্রামের ২ লাখ ৩ হাজার ৯১ জন শিক্ষার্থীসহ মোট ৯ লাখ ৬৫ হাজার ৮৩৮ জন শিক্ষার্থীর ভিত্তিতে আলোচ্য বছরে শিক্ষার্থীপ্রতি বার্ষিক ব্যয় ১ হাজার ৭৮৬ টাকা।
আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় অবকাঠামো উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ব্যতীত সর্বমোট ব্যয় হয়েছে ৬৯ লাখ ২৪ হাজার ৮৩১ টাকা। গড় হিসাবে ৭২ হাজার ৮৯২ টাকা।

আলোচ্য বছরে অনুমোদিত ১০৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে (২০২০ সালে অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০৭টি হলেও ০৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়নি। কমিশন কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে ইবাইস ইউনিভার্সিটি, দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা এবং কুইন্স ইউনিভার্সিটির কোনো উপাত্ত আলোচ্য বছরে সংযুক্ত করা হয়নি। প্রেসিডেন্ট কর্তৃক অনুমোদিত ভাইস চ্যান্সেলরের (ভিসি) সংখ্যা ৭৩ জন, প্রো-ভিসি ২২ জন এবং ট্রেজারার ৫৪ জন নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন।

প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। মাত্র ২৯টি বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত জমিতে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়েছে। ফাউন্ডেশনের নামে জমিতে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে ২টি বিশ্ববিদ্যালয়। নির্ধারিত জমিতে আংশিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়। আইনের থেকে কম জমিতে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে ২টি বিশ্ববিদ্যালয়। নির্ধারিত ক্যাম্পাস নির্মাণাধীন ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের। আইন মেনে নিজস্ব জমিতে নির্মাণকাজ শুরু করেনি ২১টি বিশ্ববিদ্যালয়।

এই বছরে সিন্ডিকেটের কোনো সভা হয়নি ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের। একাডেমিক কাউন্সিলের কোনো সভা হয়নি ১৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের। অর্থ-কমিটির কোনো সভা হয়নি ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের। আর মাত্র ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দ্বারা নিয়োগকৃত নিরীক্ষা ফার্ম থেকে নিরীক্ষা সম্পাদন করে কমিশনে প্রেরণ করেছে।

আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাবরই ৬ মাসের সেমিস্টার করার কথা বলা হলেও আইনের তোয়াক্কা না করে সিংহভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে ৪ মাসের সেমিস্টার।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=311566&cat=3