১৬ জানুয়ারি ২০২২, রবিবার, ৭:১৩

অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

মানব পাচার চক্রের খপ্পরে সর্বস্ব হারাচ্ছেন তরুণরা

ভারত থেকে নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরেছেন ৯ জন, জিম্মি আরও ২২ * ভুয়া ভিসা-ওয়ার্ক পারমিট দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে চক্রটি, এরপর ধাপে ধাপে হাতিয়ে নেয় টাকা

প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটসহ দেশের তরুণদের ইউরোপ যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। এসব তরুণদের টার্গেট করে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে একটি আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্র। বাংলাদেশ-ভারতে এ চক্রের সদস্যরা ভুয়া ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট ইত্যাদি দেখিয়ে তরুণদের কৌশলে ফাঁদে ফেলে। প্রথমে দেশে কয়েক দফা তাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়। পরে তাদের পাঠানো হয় ভারত। বলা হয়, সেখান থেকে তাদের ইউরোপ পাঠানো হবে। এরপর সেখানেও ধাপে ধাপে তাদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। তাদের পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে হোটেল রুমে জিম্মি করে রাখা হয়। টাকা না দিলে নেমে আসে নির্যাতন। সম্প্রতি ভারত থেকে কোনোমতে পালিয়ে দেশে ফিরেছেন ৯ তরুণ। এদের মধ্যে দুজন মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। সিলেট ও যশোর থেকে চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দুদেশের এ চক্রের দেওয়া জাল ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট, আর্থিক লেনদেন, চুক্তিপত্র ও অডিও কথোপকথনসহ বিভিন্ন তথ্য যুগান্তরের হাতে এসেছে।

আল-আমিনের বাড়ি সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে। তিনি ওই চক্রের কাছে ১৫ লাখ টাকা খুইয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। সম্প্রতি ভারত থেকে পালিয়ে এসেছেন তিনি। ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন আল-আমিন। এজন্য জমি বিক্রি করে সব প্রস্তুতি নেন। এ সময় তার স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসে সিলেটের ‘এ ইন্টারন্যাশনাল ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান মাসুক আহমদ মাসুম ১০০ টাকার তিনটি স্ট্যাম্পে ক্রোয়েশিয়ার ভিসা প্রসেসের চুক্তি করেন। ১৫ দিনের মধ্যেই ক্রোয়েশিয়ার ওয়ার্ক পারমিটও করে ফেলেন। একপর্যায়ে আল-আমিনকে পাঠানো হয় চট্টগ্রামে ইন্ডিয়ান দূতাবাসে ভিসার জন্য। সেখান থেকে পাঠানো হয় ঢাকা। এরপর আখাউড়া হয়ে ভারতের দিল্লিতে পৌঁছেন আল-আমিন। ইতোমধ্যে তার কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় মাসুক আহমদ মাসুমসহ চক্রের অন্য সদস্যরা। ভারতে যাওয়ার পর একই চক্রের সদস্যরা তাকে ইউরোপের ভুয়া ভিসা দেখিয়ে ফের টাকা আদায় করে। কিন্তু তার ইউরোপ যাওয়া তো দূরে থাক, বাবা-মা ও স্ত্রী-সন্তানের কাছে দেশে ফেরাই অনিশ্চিত পড়ে। চক্রের সদস্যরা তার পাসপোর্টও কেড়ে নেয়। একপর্যায়ে আল-আমিন বুঝতে পারেন তিনি প্রতারিত হয়েছেন। প্রায় ৬ মাস পর গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর নিঃস্ব হয়ে প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরেছেন তিনি।

আল-আমিনের মতো আরও আট তরুণ এ চক্রের কাছে সর্বস্ব হারিয়ে ভারত থেকে দেশে ফিরেছেন। তারা জানান, বর্তমানে ভারতের দিল্লির পাহাড়গঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন ও কলকাতার সিটি সেন্টার-২, নিউ মার্কেট এলাকার বিভিন্ন হোটেলে অন্তত ২০-২২ জন বাংলাদেশি যুবক জিম্মি রয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন- সিলেটের মিনহাজুর রহমান, নুরুল ইসলাম, সাহেল আহমদ, জিল্লুর রহমান, জুবায়ের হোসেন, আব্দুল কাইয়ুম, শিবরুল হাসান চৌধুরী, ওয়াহিদ আহমদ, জান্নাতুল নাইম নোবেল, নোয়াখালীর মাহবুবুর রহমান ও কুমিল্লার মহিউদ্দিন। এদের সবার কাছ থেকেই পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

আল-আমিন জানান, দিল্লি ও কলকাতায় হোটেল রুমে আটকে রেখে তাদের ওপর নির্যাতনও করা হয়। এসব বিষয় পরিবারের কাউকে জানালে মেরে ফেলার ভয় দেখায় তারা।

দেশে ফিরেছেন ৯ জন : আল-আমিন ছাড়া দেশে ফেরাদের মধ্যে রয়েছেন-সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের আল-আমিন, কুমিল্লার জাকির হোসেন, যশোরের রায়হান উদ্দিন ও শান্তি রহমান। এরা পাসপোর্ট-ভিসা দেখিয়ে পরিবারের কাছ থেকে টাকা আনার কথা বলে কৌশলে পাসপোর্ট নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। আর প্রাণের ভয়ে পাসপোর্ট ছাড়াই পালিয়ে দেশে এসেছেন সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের নাজমুল হাসান শাওন, রিয়াজ উদ্দীন ও হবিগঞ্জের মাহবুবুর রহমান। এরমধ্যে আল-আমিন ও রায়হান থানায় মামলা করেছেন।

এ বিষয়ে কোম্পানীগঞ্জের আল-আমিন যুগান্তরকে বলেন, আমি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। এখনো দিল্লি ও কলকাতায় তাদের কাছে অনেক বাংলাদেশি জিম্মি রয়েছে, তাদের উদ্ধার করা জরুরি।

নাজমুল হাসান শাওন যুগান্তরকে বলেন, ৫০ হাজার টাকার চুক্তি হয়েছিল। কথা ছিল ভিসা পেয়ে ইউরোপ গিয়ে বাকি টাকা দিব। কিন্তু বাড়ি থেকে বের করার পর পদে পদে কৌশলে প্রায় আড়াই লাখ টাকা নিয়েছে তারা। দিল্লিতে গিয়ে যখন বুঝতে পারলাম এরা প্রতারক তখন প্রাণ নিয়ে পাসপোর্ট ছাড়াই পালিয়ে দেশে ফিরেছি। আমি এদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেব।

কুমিল্লার জাকির হোসেন দেশে ফিরে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, জমিজমা বিক্রি করে প্রায় ১৪ লাখ টাকা দিয়েছি তাদের। এখন আমি নিঃস্ব।

যশোরের রায়হান উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, প্রায় ৯ লাখ টাকা নিয়েছে চক্রটি। ভিসা নিয়ে দেশে ফিরে ফ্লাইটের জন্য যখন এয়ারপোর্ট যোগাযোগ করি তখন জানতে পারি এটি জাল। ফ্রান্স দূতাবাসে গেলে তারাও নিশ্চিত করে ভিসাটি জাল এবং তারা আমার পাসপোর্ট রেখে দেয়। পরে আইনি পদক্ষেপ নেই।

দুদেশে সক্রিয় মানব পাচার চক্রের সদস্যরা : অনুসন্ধানে জানা যায়, আন্তর্জাতিক এ চক্রের সদস্যরা হল- কলকাতার বারাসত এলাকার সজিব (হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বর +৯১৮৬৯৭৭৬৩৮১৭), তার সহযোগী পোল্যান্ডের নাগরিক অভি (হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বর +৪৮৭৯৭০৬৩৫৩৩), সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার গাজীনগর গ্রামের একরাম উল্লাহর ছেলে মাসুক আহমেদ মাসুম ওরফে শাকিল, সিলেটের গোলাপগঞ্জের হাজিলপুর গ্রামের মঈনুল হকের ছেলে মাসুম আহমেদ ওরফে হাজী মাসুম ওরফে রেদওয়ান, কেএমসি হলিডেইজর ম্যানেজার মো. হাসান, জালালাবাদ থানার সোনাতুলা এলাকার নাজিরের গাওয়ের মৃত আবদুল আলিমের ছেলে শহিদুল ইসলাম শাহিন, মোগলাবাজার থানার দক্ষিণ সুলতানপুরের মানিক মিয়ার ছেলে আশিকুর রহমান, যশোরের বেজপাড়া মেইন রোডের মৃত আ. সামাদ প্রফেসরের বাসার ভাড়াটিয়া মো. নুর গাজীর ছেলে রফিকুল ইসলাম রফিক, যশোরের বাঘারপাড়ার শরিফুল ইসলাম, কুমিল্লার বাতেন, চট্টগ্রামের পাহাড়তলী খুলশী এলাকার এসবি নগরের ২নং গলির ৬০০ নম্বর বাসার নুরুন্নবীর ছেলে সালাউদ্দিন মাহমুদ ওরফে সৌরভ, খুলনার সোনাডাঙ্গার গোবরচাকার ১নং ক্রস রোডের ১৭৯/১ নম্বর বাসার মো. আব্দুল খালেকের ছেলে নুর নবী ওরফে আল-আমিন।

এরইমধ্যে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব-৯ এ চক্রের সদস্য শাহিন ও আশিককে আটক করেছে। পরে আল-আমিনের করা মানব পাচার মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আর রফিক একই অপরাধে যশোর কোতোয়ালি থানায় করা রায়হানের মামলায় কারাগারে আছে। মাসুম শাকিল গা ডাকা দিয়েছে। আর হাজী মাসুম বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছে।

এ ব্যাপারে জানতে কলকাতার বারাসত এলাকার সজিবের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করলে সে প্রতিবেদকের বক্তব্য শুনে কোনো জবাব না দিয়ে গালাগাল করে। তবে সজিবের সহযোগী অভি নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে যুগান্তরকে বলে, কারও সঙ্গে থাকলেই তো আর তার অপরাধের সঙ্গে জড়িত সেটা বলা যায় না।

বেনাপোলের নুর নবী ওরফে আল-আমিন মানব পাচারের বিষয়টি অস্বীকার বলে, ওখানে আমার একটা অফিস আছে। পাসপোর্ট ছাড়া আমরা কাউকে ইমিগ্রেশনে পাঠাই না। পাসপোর্ট-ভিসা থাকলে বর্ডার ফি দিয়ে পাঠিয়ে দেই। এছাড়া আর কিছু নয়, শাকিলসহ চক্রের কাউকে চিনি না।

চট্টগ্রামের সালাউদ্দিন মাহমুদ ওরফে সৌরভ মাসুম শাকিলকে চিনেন জানিয়ে যুগান্তরকে বলেন, আমরা ইন্ডিয়ান ভিসা প্রসেসিংয়ের কাজ করি। এখন কে কোন নিয়তে ভিসা করায় এসব তো জানি না। আমরা কোনো ধরনের মানব পাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িত নই।

মাসুক আহমদ মাসুম ওরফে শাকিল ও মো. মাসুম আহমেদ ওরফে হাজী মাসুম ওরফে রেদওয়ানের বক্তব্য জানার জন্য তাদের একাধিক নম্বরে বারবার কল করলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। মাসুকের ‘এ ইন্টারন্যাশনাল ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস’ প্রতিষ্ঠানটিও বর্তমানে নেই। সে নতুন নামে অফিস খুলেছে। সেখানে দুদিন গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। অফিসে থাকা হাবিব নামে একজন জানায়, স্যার ঢাকায় আছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্য : আন্তর্জাতিক এ চক্রের বিরুদ্ধে করা দুটি মামলার বিষয়ে যশোরের পুলিশ সুপার (এসপি) প্রলয় কুমার জোয়ারদার যুগান্তরকে বলেন, মামলার যথাযথভাবে তদন্ত চলছে। এসব ব্যাপারে আমাদের নজরদারিও রয়েছে।

সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) কমিশনার নিশারুল আরিফ যুগান্তরকে বলেন, মানব পাচারের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। ইতোমধ্যে আমরা আটাবের কাছ থেকে সিলেটের সব ট্রাভেলস এজেন্সির তালিকা নিয়েছি। যাচাই-বাচাই করে যারা অবৈধ বা মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত তাদের ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন যুগান্তরকে বলেন, মানব পাচার নিয়ে আমরা কাজ করছি। ইতোমধ্যে ১২-১৪টি রোডও পেয়েছি। প্রায় তিন শতাধিক মানব পাচারকারীকে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছি। পাশ্বর্বর্তী দেশের যারা আমাদের দেশের মানব পাচারকারীদের সঙ্গে জড়িত, তাদের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে যথাযথ প্রক্রিয়ায় ওই দেশে সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠিয়েছি। তারা তাদের দেশের মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/509324