১৬ জানুয়ারি ২০২২, রবিবার, ৭:১১

ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে সবজি ও ফল রফতানি

নামেই সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউজ সব চলে সনাতন পদ্ধতিতে

প্যাকিং করেন রফতানিকারকরাই, টেস্ট রিপোর্ট আনেন বাইরে থেকে; দক্ষ জনবলের অভাবে তিন বছর ধরে ল্যাববন্দী মেশিনারিজ

শাকসবজি-ফলমূল মোড়কীকরণ, নাম শুনলেই ভেসে আসে আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে প্রক্রিয়া ও মোড়কীকরণ দৃশ্য। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হাতের স্পর্শ ছাড়াই ফলমূল-শাকসবজি ধোয়া, পরিষ্কার ও প্যাকিং বা মোড়কীকরণ হচ্ছে উন্নত দেশগুলোতে। গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন দৃশ্য চোখে পড়লেও বাংলাদেশের সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউজের দৃশ্য এর উল্টো।

প্রায় ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে ল্যাবের জন্য তিন বছর আগে কেনা হয়েছে আধুনিক যন্ত্রপাতি। কিন্তু দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবলের অভাবে সেটা এখনো ঘরবন্দী। ইউরোপে রফতানির জন্য রফতানিকারকরা যেসব ফল ও সবজি নিয়ে আসছেন প্যাকিং হাউজে, তা সনাতন পদ্ধতিতে ধৌত-পরিষ্কার ও মোড়কীকরণ করছেন তাদেরই লোকজন। মোড়কীকরণের সময় সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউজে নিযুক্ত কৃষি সম্প্রসারণের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দাড়িয়ে চোখের দেখায় নির্ণয় করছেন পণ্যটির মান। যেসব ক্ষেত্রে ফল বা সবজির রাসায়নিক পরীক্ষার প্রয়োজন, বেসরকারি কোনো ল্যাব থেকে রফতানিকারকরাই তা পরীক্ষা করে আনছেন। রফতানিকারকদের আনা ল্যাব রিপোর্টেই ছাড়পত্র দিতে হচ্ছে কর্মকর্তাদের।

জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে পরিমাণ সবজি ও ফল রফতানি হয়; তার বেশির ভাগই হয় ইউরোপের দেশগুলোতে। সবজি ও ফলে কয়েক দফা পোকা এবং ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব পাওয়ায় ইউরোপে ফল-সবজি রফতানি কার্যক্রম হুমকিতে পড়ে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার আগেই ২০১৫ সালের এপ্রিলে রফতানি কার্যক্রম নিজ থেকেই বন্ধ করে দেয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। ফল ও সবজিতে পোকা এবং ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া যাতে না থাকে সেটা নিশ্চিত এবং যথাযথ প্রক্রিয়ায় মোড়কীকরণে জোর দেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। বিশেষ করে শুধুমাত্র কন্ট্রাক্ট ফার্ম বা চুক্তিবদ্ধ কৃষকের কাছ থেকেই ফল ও সবজি সংগ্রহ করে তা ইউরোপে পাঠানোর জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়। এ জন্য রাজধানীর শ্যামপুর বিসিক শিল্পনগরীতে স্থাপন করা হয় সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউজ। ২০১৭ সালের মে মাসে এই প্যাকিং হাউজটি চালু করা হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের শর্তানুযায়ী চুক্তিবদ্ধ চাষিদের কাছ থেকে গুড এগ্রিকালচার প্র্যাকটিস বা জিএপি (গ্যাপ) অনুসরণ করে চাষ করা ফল ও সবজি সংগ্রহ করে তা কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে পাঠাবেন রফতানিকারকরা। এরপর সেখানে ফল ও সবজি যথাযথ পন্থায় মোড়কীকরণ করে পণ্যগুলো পাঠানো হয় এয়ারপোর্টে। কিন্তু এটা কতটুকু অনুসরণ হচ্ছে কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে? এ নিয়েই প্রশ্ন নানামহলে।

শ্যামপুরে সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউজে সরেজমিন দেখা যায়, প্যাকিং হাউজের চার দিকেই নোংরা পরিবেশ, বস্তি এলাকা। শিল্প কারখানার ধোঁয়া ও কেমিক্যালের গন্ধ নাকে নিয়েই ঢুকতে হয় এই প্যাকিং হাউজে। প্রায় এক একর জমির মাঝখানে তিনতলা বিল্ডিং। জানা যায়, এখানে এক সময় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কীটনাশকের গোডাউন ছিল। পাশেই ছিল ডোবা, নিচু এলাকা। ত্বড়িতগতিতে এটা ভরাট করে ইউরোপে ফল ও সবজি পাঠানোর জন্য দ্রুত বিল্ডিং নির্মাণ করা হয়। প্যাকিং হাউজের তিনতলা ভবনের নিচতলায় সবজি ও ফলমূলের মান যাচাই-বাছাই, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ধোয়া ও শুকানো এবং মোড়কজাত করার জন্য আলাদা আলাদা কক্ষ আছে। দোতলায়ও একই ব্যবস্থা আছে। দোতলায় পণ্যবাহী ট্রাক ওঠার জন্য আলাদা র্যাম্প করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রয়োজন হলে ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সবজি ও ফলমূল সংরক্ষণের জন্য নিচতলা ও দোতলায় কয়েকটি কুলিং কক্ষ রয়েছে। ভবনের তৃতীয় তলায় কর্মকর্তাদের জন্য কার্যালয়, রফতানিকারকদের প্রশিক্ষণের জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রশিক্ষণকক্ষ ও একটি সভাকক্ষ আছে। প্যাকিং কার্যক্রম শুরু হয়েছে প্রায় পাঁচ বছর হতে চলল। কিন্তু এখনো আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি প্যাকিং কার্যক্রমে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টিন উইং সূত্রে জানা যায়, সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউজে একটি আধুনিক ল্যাব স্থাপনে বাংলাদেশ ফাইটোসেনেটারি শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের আওতায় ৪৫ ধরনের ৭০টি যন্ত্রপাতি কিনতে ৬০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করা হয়েছে। দেশে এক হাজার ২৫০ জন এবং বিদেশে ৯০ জন কর্মকর্তা (কোনো কোনো কর্মকর্তা একাধিক দেশে) প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। অথচ এখন ল্যাবটি পরিচালনার জন্য কোনো কর্মকর্তা নেই। ল্যাব পরিচালনার জন্য যাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল, তাদের বেশির ভাগই পদোন্নতি ও বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। ফলে ল্যাব থাকলেও যন্ত্রগুলো পরিচালনার মতো যথেষ্ট দক্ষ জনবল নেই।

সূত্র জানায়, ২০১২ সালে চালু হওয়া ১৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘বাংলাদেশ ফাইটোসেনেটারি সামর্থ্য শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্পটির মেয়াদ ২০১৯ সালের জুনে শেষ হয়েছে। এই প্রকল্পের পিডি এরই মধ্যে মারা গেছেন। তাই এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারেননি বা বলতে চাননি কোনো কর্মকর্তা। তবে ১৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে স্থাপিত উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ ল্যাবরেটরিকে ‘আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরিতে রূপান্তর’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের কৃষিপণ্যের রফতানি বাড়াতে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

জানা যায়, ইউরোপের ১২টি দেশে এই ফল ও সবজি রফতানি হচ্ছে। এর ৬০ শতাংশের বেশি রফতানি হয় যুক্তরাজ্যে। বাকি দেশগুলো হলোÑ ইতালি, ফ্রান্স, গ্রিস, জার্মানি, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও বেলজিয়াম। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ইউরোপীয় দেশগুলোতে মোট ৯৭৫.৪৬৮ মেট্রিক টন ফল রফতানি হয়েছে। এর মধ্যে এক যুক্তরাজ্যেই হয়েছে ৭৩১.২৩৬ মেট্রিক টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে রফতানি হয়েছে দুই হাজার ৩০৫ দশমিক ৮৪৮ টন; যার মধ্যে যুক্তরাজ্যেই এক হাজার ২৪০ দশমিক ৭৮৫ টন। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস তথা ডিসেম্বর-২১, পর্যন্ত রফতানি হয়েছে ৯৯১.২৩ টন ফল। বিভিন্ন ধরনের ফল রফতানি হলেও মূলত কাঁঠাল ও আম সবচেয়ে বেশি রফতানি হচ্ছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ইউরোপের দেশগুলোতে এক হাজার ১০৫ দশমিক ২৮৬ মেট্র্রিক টন সবজি রফতানি হয়েছে। যার মধ্যে ৮৬৫ টনই গেছে যুক্তরাজ্যে। ২০২০-২১ অর্থবছরে দুই হাজার ৬৭ দশমিক ৬৩৬ মেট্রিক টন সবজি রফতানি হয়েছে। যার মধ্যে এক হাজার ২৭৩ টনই গেছে যুক্তরাজ্যে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (ডিসেম্বর পর্যন্ত) ৬২৭.২১৮ মেট্রিক টন সবজি ইউরোপে রফতানি হয়েছে; যার মধ্যে যুক্তরাজ্যে গেছে ৪২৪ টনের বেশি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফ্রুটস ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, প্যাকিং হাউজটি যখন তৈরি করা হয়েছে, তখন হয়তো আন্তর্জাতিকমানের বিষয়গুলো দেখে করেনি। বিল্ডিংটাও দেখেশুনে করেনি। সেটা হলে আরো সুন্দর হতো। এখন কোনো রকম চাহিদা মেটানোর কাজ হচ্ছে। গত অর্থবছরে প্রায় দেড় মিলিয়ন ডলারের মতো ফল-সবজি রফতানি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিমানভাড়া বেড়েছে। ফ্লাইট শিডিউলও কমবেশি হয়। অন্য দেশের চেয়ে আমাদের বিমানভাড়া অনেক বেশি। ফল-সবজি রফতানি আগের চেয়ে কমেনি। তবে আরো বাড়ানো যেত, যদি বিমানভাড়াটা নাগালের মধ্যে থাকত।

শ্যামপুরের সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউজের উপপরিচালক (উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কেন্দ্র) মো: লুৎফর রহমান সিকদার নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের জনবল বলতে এখন আছি অফিসারসহ স্টাফ ১২ জন। আর সংযুক্তিতে আছেন আটজন। মোট ২০ জন। এত দিনেও ল্যাব কেন চালু হয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ল্যাবে যন্ত্রপাতি থাকলেও চালানোর জন্য যে জনবল আছে তা যথেষ্ট না। ল্যাব চালানোর জন্য এক্সপার্ট লাগবে। যেটা দেয়া হয়নি। প্রশিক্ষিত জনবল দরকার, রি-এজেন্ট, কেমিক্যাল দরকারÑ এখানে কিছুই নাই। শুধু মেশিন দিয়ে তারা চলে গেছে। তাহলে এখন কিভাবে ফল ও সবজি রফতানি হচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে ডিডি বলেন, এখানে সবকিছুর তো আর টেস্ট দরকার হয় না। যেগুলোর দরকার এক্সপোর্টাররা বাইরের বেসরকারি ল্যাব থেকে টেস্ট করে নিয়ে আসেন। আমরা সেটা দেখে অনুমতি দেই।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো: বেনজীর আলম নয়া দিগন্তকে বলেন, আগের প্রকল্প অধীনে এই মেশিনগুলো কেনা হয়েছে। এখানে কিছু টেকনিশিয়ান থাকার কথা ছিল, সেটা নেই। তিনি বলেন, কিছু লোককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু যারা পরিচালনা করবে, এমন লোকদের দেয়া হয়নি। কর্মকর্তাদের দেয়া হয়েছিল বটে; কিন্তু মেশিন পরিচালনার জন্য যেভাবে প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা সেভাবে করা হয়নি। আর এটাও হয়েছে অনেক আগে, তাই সঠিকভাবে বলতে পারব না। আর পিডিও মারা গেছেন।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/636865