১৩ জানুয়ারি ২০২২, বৃহস্পতিবার, ৪:০৭

জনঘনত্বকে প্রাধান্য দিয়ে ড্যাপ চূড়ান্ত

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : অবশেষে বাস্তবায়ন হচ্ছে বহুল প্রতীক্ষিত ড্যাপ। সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে ড্যাপ আর দীর্ঘায়িত না হোক, দ্রুত বাস্তবায়ন হোক। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে ড্যাপ এর বাস্তবায়নটা কে করবে? রাজউক মূল বাস্তবায়নকারী হবে নাকি সিটি করপোরেশন। এর বাস্তবায়ন কে করবে এটা নিয়ে একমত হবার পরই এ সংক্রান্ত ফাইল প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, আমরা চাই না ড্যাপ আর দীর্ঘায়িত হোক। আমরা চাই ড্যাপ দ্রুত বাস্তবায়ন হোক। কিন্তু এখন বাস্তবায়নটা কে করবে এটা নিয়ে একমত হতে হবে। ঢাকা শহরে ২ কোটির বেশি মানুষের বসবাস। গত চার বছরে ৪ দশমিক ৩ মিলিয়ন মানুষ গ্রাম থেকে শহরে মাইগ্রেট করেছে। শিক্ষা, চিকিৎসা ও কর্মসংস্থানের জন্য মানুষ ঢাকায় আসে। আমি মনে করি ড্যাপ বাস্তবায়নে সিটি করপোরেশন একটা ভাইটাল রোল প্লে করবে। রাস্তা বানাবে সিটি করপোরেশন, ফুটপাত বানাবে সিটি করপোরেশন, পানিবদ্ধতা নিরসন করবে সিটি করপোরেশন। পৃথিবীর সব দেশেই সিটি করপোরেশন এসব কাজ করছে। সিটি করপোরেশন মানেই শুধু ময়লা ও ড্রেন পরিষ্কার করবে, তা নয়। তাই রাজউক মূল বাস্তবায়নকারী হবে না সিটি করপোরেশন বাস্তবায়ন করবে সেটা নিয়ে আমাদের একমত হতে হবে।

সূত্র মতে, ঢাকার পরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রস্তাবিত নতুন ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) ইতোমধ্যে চূড়ান্ত হয়েছে। এতে গুরুত্ব পাচ্ছে জনঘনত্ব। কোন এলাকার জনঘনত্ব কেমন হবে, তা নির্ভর করবে সংশ্লিষ্ট এলাকার নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধার ওপর। জানা গেছে, ১৯৫৯ সালে প্রথমে ঢাকার জন্য এ সংক্রান্ত একটি পরিকল্পনা করা হয়। কলম্বো ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যান স্কিমের সহযোগিতায় ব্রিটিশ কোম্পানি মিনোপ্রিও, স্পেন্সলি ও ম্যাকফারলনের মাধ্যমে এ পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। পরিকল্পনাটি ২০ বছরের জন্য করা হলেও কার্যকর ছিল ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। এরপর ঢাকা শহরের উন্নয়নের জন্য ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান (১৯৯৫-২০১৫) নামের ২০ বছরের দীর্ঘমেয়াদি কৌশল পরিকল্পনা প্রণয়ন করে রাজউক। এছাড়া নগর অঞ্চল পরিকল্পনাও (১৯৯৫-২০০৫) প্রণয়ন করা হয়। ২০০৪ সালে ড্যাপের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। ২০১০ সালের ২২ জুন এটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। ড্যাপে ঢাকার মোট আয়তন ধরা হয় এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার বা ৫৯০ বর্গমাইল। ২০১০ সালের ২৭ জুন ড্যাপ রিভিউ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করা হয়। ২০১৫ সালের মার্চে সংশোধিত ড্যাপ প্রণয়নের কাজ শুরু করে রাজউক। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ড্যাপ চূড়ান্ত করার কথা ছিল। সে সময় কাজ শেষ না হওয়ায় ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। পরে দফায় দফায় সময় আরও বাড়ানো হয়।

গত ৩০ ডিসেম্বর সচিবালয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের সম্মেলন কক্ষে রিভিউ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাশেষে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও ড্যাপ রিভিউ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির আহ্বায়ক মো. তাজুল ইসলাম ড্যাপ চূড়ান্ত হওয়ার বিষয়টি জানান। ওইদিন তিনি বলেন, ড্যাপ চূড়ান্ত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদনের পর এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হবে। জানা গেছে, সংশোধিত ড্যাপের ফাইলটি এখনও প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়নি। কিছু জটিলতা নিরসন শেষে মন্ত্রিসভা কমিটির কার্যবিবরণী প্রকাশের পর তার কাছে পাঠানো হবে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে গেজেট প্রকাশ করা হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি নগরের পরিকল্পনা করতে গেলে অনেক কিছু মাথায় রাখতে হয়। কতজন মানুষের বসবাসের সুযোগ-সুবিধা আছে, সে অনুযায়ী জনঘনত্ব নির্ধারণ করা হয়। এবার ড্যাপ চূড়ান্তে বিষয়টির ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, সবকিছুর ক্ষমতার (সুযোগ-সুবিধা) ওপর ভিত্তি করে ওই এলাকায় কত জনসংখ্যা বসবাস করবে, সেটিই হলো জনঘনত্ব। ড্যাপে এলাকাভিত্তিক জনঘনত্বের কথা বলা আছে। তিনি বলেন, আরবান প্ল্যানিংয়ের (নগর পরিকল্পনা) কনসেপ্টে যখন একটি সিটি ডিজাইন করা হয়, তখন নির্ধারণ করতে হয় যে, ওই সিটিতে কত লোক বসবাস করবে। ওই জনসংখ্যার অনুপাতে ফ্যাসিলিটিজ রাখতে হবে। ধরুন, আপনি কোনো একটি ছোট সিটি ডিজাইন করলেন। সেখানে ২০ হাজার মানুষ বসবাস করতে পারবে। ২০ হাজার মানুষের জন্য তো বিশ্ববিদ্যালয়ের দরকার নেই। তবে ওই সিটিতে যদি ৫০ হাজার মানুষ বসবাস করে, সেক্ষেত্রে একটি বিশ্ববিদ্যালয় তো দিতে হবে। কারণ, ৫০ হাজার মানুষের মধ্যে অন্তত এক হাজার শিক্ষার্থী থাকতে পারে, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবে।

আশরাফুল ইসলাম আরো বলেন, সব এলাকায় তো একই ঘনত্বে মানুষ বসবাস করবে না। কারণ, সব এলাকার বৈশিষ্ট্য এক নয়। যদি ধানমন্ডি এলাকার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে রায়েরবাজারের বৈশিষ্ট্য মেলান, তাহলে তো হবে না। ধানমন্ডিতে সুপ্রশস্ত রাস্তা আছে, কিছু পাবলিক স্পেসও আছে। যদিও জনসংখ্যার তুলনায় এগুলোও কম। মানে ধানমন্ডিতেই কম, আর রায়েরবাজারের কথা তো চিন্তাই করা যায় না। একটি গাড়ি ঢুকলে আরেকটি বের হতে পারে না। এটি শহরের পরিবেশ হতে পারে না। প্রকল্প পরিচালক আরও বলেন, যে এলাকার ফ্যাসিলিটিজ (সুযোগ-সুবিধা) বেশি, সেখানকার ডেনসিটি (ঘনত্ব) বেশি হবে। যে এলাকার ফ্যাসিলিটিজ কম, সেখানে ডেনসিটিও কম হবে। যে এলাকার ফ্যাসিলিটিজ কম, সে এলাকায় যদি ফ্যাসিলিটিজ যুক্ত হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে ডেনসিটি বাড়বে। এটা তো ডায়নামিক বিষয়। এটা যে থেমে থাকবে, তা নয়। ধরুন, আপনি ওই এলাকায় নতুন একটি রাস্তা বানালেন তখন সেখানকার ডেনসিটি আবার বেড়ে যাবে।

রাজউকের প্রধান এই নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, এটা পৃথিবীর সব দেশেই আছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও আছে। এটা এতদিন আমাদের দেশে ছিল না। কিন্তু আমাদের তো একটা জায়গা থেকে শুরু করতেই হবে। নইলে এই যে অনেক নিউজ আসছে, দূষিত শহরের মধ্যে ঢাকা প্রথম, এটা তো নাগরিক হিসেবে আমাদের ভালো লাগার কথা নয়। এই শহরে আপনি-আমি সবাই মিলে বসবাস করি। তাই শহরের প্রতি সবারই তো দায়িত্ব আছে।

এদিকে, ড্যাপে ছয়তলার বেশি উঁচু ভবন করা যাবে না বলে সম্প্রতি যে তথ্যটি ছড়িয়ে পড়েছে, সেটিকে ‘গুজব’ বলে দাবি করেছেন প্রকল্প পরিচালক। তিনি বলেন, ড্যাপের রিপোর্টে ছয়তলার কিছুই উল্লেখ করা নেই। এটি গুজব। একই দাবি করেন রাজউকের চেয়ারম্যান (সচিব) এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছয়তলার বেশি উঁচু ভবন করতে দেবে না, এটা কোথাও লেখা নেই।

জানা গেছে, সংশোধিত ড্যাপে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা বিবেচনায় নেবে ড্যাপ রিভিউ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। কোথাও সংশোধনের প্রয়োজন হলে তাও করা হবে। এ বিষয়ে কমিটির আহ্বায়ক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, কোনো পক্ষকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য ড্যাপ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কেউ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বা কারও প্রতি যদি অবিচার করা হয়, তাহলে তা অবশ্যই বিবেচনায় নেওয়া হবে। এটি চূড়ান্ত হওয়ার পর প্রতি তিন মাস পরপর রিভিউ কমিটির মিটিং হবে। সেই মিটিংয়ে সব আপত্তি ও মতামত পর্যালোচনা করা হবে। কোথাও যদি সংশোধনের প্রয়োজন পড়ে, সবার সিদ্ধান্তক্রমে তা করা হবে।

প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, ড্যাপের বড় চ্যালেঞ্জ হলো বাস্তবায়নে। আশা করি, ড্যাপ বাস্তবায়ন করতে পারবো। রাজধানীকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। রাজউকের বিরুদ্ধে আমরা অনেক অভিযোগ পাই। রাজউককে দ্রুত ডিজিটালাইজড করা দরকার। রাজউক চাইলে দ্রুত উন্নয়ন সম্ভব।

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ বলেন, নগর একটি দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি। কিন্তু নগরায়ন পরিকল্পিত না হলে তাতে নাগরিক জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। বাংলাদেশে নগরায়নের যে চিত্র তার সিংহভাগই ঢাকাকেন্দ্রিক। রাজধানী শহর হওয়ার কারণে ঢাকার জনসংখ্যা খুবই দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকার জনসংখ্যা হবে ২৬ মিলিয়ন। তখন ঢাকা হবে পৃথিবীর ষষ্ঠ মেগা সিটি।

দেশের অন্যান্য শহরের সুযোগ সুবিধার তুলনায় ঢাকার সুবিধা বেশি হওয়ার কারণে মানুষ গ্রাম থেকে ঢাকামুখী হবে, এটাই বাস্তবতা। তবে ঢাকা শহরের মানুষের সব ধরনের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য ড্যাপ বাস্তবায়নে যাতে কাজ করতে পারি, সেটাই আমার প্রত্যাশা।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, উন্নত শহর গড়ার সব উপাদান নিয়ে ড্যাপ করা হয়েছে। তাই সবাই মিলে কাজ করলে ড্যাপ বাস্তবায়ন সম্ভব। এফবিসিসিআই অংশীজনদের নিয়ে ড্যাপ বাস্তবায়নে করণীয় নির্ধারণ করবে। বেসরকারিখাতকে সঙ্গে নিয়েই ড্যাপ বাস্তবায়নে সরকারকে এগুতে হবে। এবারের ড্যাপ যেন বাস্তবায়নযোগ্য হয়, এফবিসিসিআই সেই উদ্যোগ নেবে।

নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বলেন, ড্যাপ বাস্তবায়নে যেন বেশি সময় না নেয়া হয়। ইতোমধ্যে পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিছু শর্তসাপেক্ষে এটি অনুমোদন দেয়া সম্ভব। এর আগে ঢাকার স্ট্রাকচার প্ল্যান অনুমোদন দেয়া দরকার।

https://dailysangram.info/post/477337