১২ জানুয়ারি ২০২২, বুধবার, ৩:০৫

অপতৎপরতা ক্রমশ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে

ভয়ংকর অপরাধে ভাড়া খাটে কিশোর গ্যাং

সংশোধনাগার থেকে আরও ভয়ংকর হয়ে বের হয় -সাবেক আইজি নূর * রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার হয় -ড. নেহাল করিম

রাজধানীসহ দেশে কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা ক্রমশ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। তল্লাশি ও গ্রেফতার অভিযানসহ নিরাপত্তা বাহিনীর নানা পদক্ষেপেও কিশোর গ্যাং কালচার দমানো যাচ্ছে না। গ্যাংয়ে জড়িত কিশোররা দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে।

আগে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মারামারিসহ নানা ছোটখাটো অপরাধে জড়িয়ে পড়ত। কিন্তু ভাড়াটে হিসাবে তারা এখন মানুষ হত্যার মতো অপরাধে যুক্ত হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে এমন তথ্য রয়েছে।

১৩ ডিসেম্বর মিরপুরে টপটেন পোশাক কারখানার কর্মচারী শাহাদাত হোসেন হাসিবকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে পুলিশ কিশোর গ্যাংয়ের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার হৃদয় জানায়, জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে হাসিবকে খুন করতে তার (হাসিব) এক চাচাতো ভাই তাদের সঙ্গে দুই লাখ টাকার চুক্তি করেছিলেন।

সম্প্রতি মোহাম্মদপুরের কিশোর গ্যাং কবির বাহিনীর আট সদস্যকে র‌্যাব গ্রেফতার করেছে। একটি ছিনতাই ঘটনার ছায়া তদন্ত করতে গিয়ে র‌্যাব-২ এর একটি দল তাদের গ্রেফতার করে।

তাদের মধ্যে পানি রুবেল ও পেটকাটা মামুন র‌্যাবকে জানায়, খুন-ছিনতাইয়ের পাশাপাশি বসিলা, মোহাম্মদপুর ও সাভারের আমিনবাজার, হেমায়েতপুর এলাকায় জমি দখলসহ বিভিন্ন অপরাধে তারা ভাড়া খাটে।

শুধু এ দুটি ঘটনাই নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে ভয়ংকর অপরাধে ভাড়ায় খাটছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। গ্যাংয়ের পেছনে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী ও পেশাদার সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষকতাকেও দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে সামাজিক আন্দোলন জরুরি। পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষা করতে এখনই কিশোর অপরাধের লাগাম টানতে হবে। তা না হলে দিনে দিনে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। তারা বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সমাজ ও পরিবারের সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া কিশোর গ্যাং কালচার কোনোভাবেই নির্মূল করা সম্ভব নয়।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ যুগান্তরকে বলেন, পরিস্থিতি যে ভয়াবহ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে সবার সম্মিলিত প্রয়াস জরুরি। পরিবার, সমাজসহ সবাই মিলে কাজ করলে কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

তিনি আরও বলেন, কিশোররা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করলেও বয়সের কারণে তাদের শাস্তির আওতায় আনা যায় না। এ কারণে তাদের কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। সেখানে গিয়ে সংশোধন হওয়া তো দূরের কথা তারা আরও ভয়ংকর হয়ে বেরিয়ে আসে।

এ বিষয়গুলোও দেখতে হবে। এ ছাড়া সমাজ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে সবাই মিলে কাজ করার পরামর্শ দেন তিনি। এ বিষয়ে বিট পুলিশিংকেও সংযুক্ত করার কথা বলেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম যুগান্তরকে বলেন, গ্যাংয়ে জড়িত কিশোররা রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হয়। তাদের কেউ কেউ বড় ভাইদের নির্দেশনা পালন করে। আধিপত্য বিস্তার, মারামারি, মাদক সেবন ও মাদক ব্যবসা তো আছেই।

তিনি বলেন, কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সমাজ এবং পরিবারকে আরও সক্রিয় হতে হবে। সচেতনতামূলক আন্দোলন শুরু করতে হবে। শুধু আইনের শাসন কায়েম করে কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়।

মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী কমিটির মহাসচিব নূর খান লিটন যুগান্তরকে বলেন, কিশোর গ্যাং কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়-সে সম্পর্কে নিয়ন্ত্রণকারীদের মূলত কোনো ধারণা নেই।

এ ছাড়া বিচারহীনতার সংস্কৃতির পাশাপাশি অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কখনো অতি কঠোর আবার কখনো ঢিলেঢালা ভাব দেখানো হয়। এভাবে চলে না। কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে সমাজে সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে সামাজিক শক্তির উত্থান ঘটাতে হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাখাওয়াত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, কিশোররা এখন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিশোর বয়সে বৈচিত্র্যময় শ্রেণির মানুষের সঙ্গে তারা মেলামেশা করার সুযোগ পাওয়ায় বিভিন্ন অপরাধের দিকে ধাবিত হয়।

গ্যাং কালচার থেকে কিশোরদের ফিরিয়ে আনতে শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, অভিভাবক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কিশোর অপরাধ নির্মূলে সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই বলেও তিনি মনে করেন।

২০১৭ সালে উত্তরায় আদনান হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে কিশোর গ্যাংয়ের নির্মম সহিংসতা জনসম্মুখে উন্মোচিত হয়। ২০১৯ সালে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে মাদক সেবন, ছিনতাই, চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত ১২৯ কিশোরকে গ্রেফতার এবং কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়।

২০২১ সালে ২৯০ জন কিশোরকে গ্রেফতার এবং তাদের কাছ থেকে বিপুল সংখ্যক দেশীয় অস্ত্র জব্দ করা হয়। ২০১৬ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে কিশোর গ্যাংয়ের ৬০৮ সদস্যকে র‌্যাব গ্রেফতার করেছে। এর মধ্যে ৩০ জনকে অর্থদণ্ড এবং ১০ জনকে মুচলেকা নিয়ে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে র‌্যাব ব্যাটালিয়নগুলোকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ তৈরি করা হচ্ছে। অভিভাবক, শিক্ষক ও ধর্মীয় নেতাদের নিয়ে র‌্যাব কিশোরদের সচেতন করার কাজ করছে।

স্কুলগুলোতে র‌্যাবের পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক নির্দেশনা সম্বলিত লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে।

কিশোর গ্যাংবিরোধী বিভিন্ন অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, গ্যাংয়ের সদস্যদের বেশির ভাগই দরিদ্র এবং স্কুল থেকে ঝরে পড়া। এসব কিশোর হতাশাগ্রস্ত হয়ে প্রথমে মাদকে জড়ায়। এতে অস্বাভাবিক জীবন-যাপনের পাশাপাশি পরিবারের সঙ্গেও বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়।

এরা সমবয়সি কিশোরদের সঙ্গে মিশে অন্য একটা জগত পায়। কখনো কখনো কয়েকজন মিলে একটা গ্যাং তৈরি করে। নেশার টাকা জোগাড় করতে তারা ছিনতাই, মাদক বিক্রি, খুন-রাহাজানির মতো ভয়ংকর অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।

তিনি আরও বলেন, বয়োসন্ধি পার হওয়া এসব কিশোরের মধ্যে এক ধরনের হিরোইজম কাজ করে। তারা পাড়ার মেয়েদের ইভটিজিংয়ের পাশাপাশি নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিতে বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে মোটরসাইকেল মহড়া দেয়।

গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ভাসমান শিশু-কিশোরদের দলে ভেড়ায় গ্যাং লিডাররা। অপরাধজগতে ঢুকে তারা একসময় শীর্ষ স্থানে চলে যায়। তিনি আরও বলেন, উচ্চবিত্ত পরিবারের কিশোরদেরও গ্যাংয়ে জড়াতে দেখা গেছে। শুধু অর্থাভাব নয়, অর্থের প্রাচুর্যও কিশোরদের অপরাধ জগতের দিকে ঠেলে দেয়।

ডিএমপির জনসংযোগ বিভাগের ডিসি ফারুক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ঢাকায় ভাসমান অপরাধীদের তৎপরতা বেশি। মাদকাসক্ত ও ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধে তারা জড়িত। তিনি বলেন, কিশোর গ্যাং দমনে আমরা নানামুখী উদ্যোগ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংগুলোতে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সি কিশোর বেশি। গ্যাংয়ের আধিপত্য নিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল সৃষ্টি হলে দু-একজন বেরিয়ে এসে নতুন নামে গ্যাং তৈরি করে। এলাকায় আধিপত্য ধরে রাখতে তারা নতুন নতুন মুখ গ্যাংয়ে টেনে আনে। আধিপত্য নিয়ে দুই গ্যাংয়ের মধ্যে মারামারি, খুনোখুনি হয়। ছুরি, রামদা, হকিস্টিক থেকে শুরু করে আগ্নেয়াস্ত্র পর্যন্ত তারা সংগ্রহ করে।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, গত চার বছরে দেশের ৬৪টি জেলা, বিভাগ, মেট্রোপলিটন এলাকা এবং থানা এলাকায় ১০ হাজারের বেশি কিশোর গ্যাং রয়েছে। ঢাকায় ৭০ থেকে ৭৫টি গ্যাং রয়েছে। গ্যাংয়ের সদস্য সংখ্যা দেড় থেকে দুই হাজার। উত্তরা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, লালবাগ ও হাজারীবাগ এলাকায় গ্যাংয়ের তৎপরতা বেশি।

কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের এক তথ্যে জানা গেছে, কেন্দ্রে থাকা কিশোরদের ২০ শতাংশ হত্যা এবং ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/507893