১২ জানুয়ারি ২০২২, বুধবার, ২:৪৯

বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’ গড়তে মহামান্য রাষ্ট্রপতির আহ্বান, বাধা কী?

অধ্যক্ষ মুহাম্মদ শাহাবুদ্দীন : ॥ গত কিস্তির পর ॥
অনুচ্ছেদ ৪-এ আমরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করিতেছি যে, আমরা যাহাতে স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধি লাভ করিতে পারি এবং মানব জাতির প্রগতিশীল আশা আকাক্সক্ষার সহিত সঙ্গতি রক্ষা করিয়া আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে পারি, সেইজন্য বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি স্বরূপ এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুন্ন রাখা এবং ইহার রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান আমাদের পবিত্র দায়িত্ব।
ধারা- ৯ এ জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হইবে বাঙালী জাতীয়তাবাদ।
ধারা- ১০ এ সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তি:
মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজলাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে। (পরিচ্ছদ-১৭ এর ১০ দ্রষ্টব্য)
ধারা- ১১ গণতন্ত্র ও মানবাধিকার :
প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবিক ও স্বাধীনতার নিশ্চিয়তা থাকিবে; মানবসত্তার মর্যদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর আংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।
ধারা- ১২ ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা :
ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য
ক) সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা
খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান।
গ) রাজনৈতিক উদ্দেশে ধর্মীয় অপব্যবহার।
ঘ) কোন বিশেষ ধর্মপালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন, বিলোপ করা হইবে।
(পরিচ্ছদ- ১৭ এর ১১ নং অনুসারে)
মৌলিক অধিকার ও আমাদের সংবিধান
মৌলিক অধিকারের সহিত অসমঞ্জস আইন বাতিল
ধারা-২৬। এর উপধারা ১ ও ২ এ মৌলিক অধিকার অসমঞ্জস্য হইলে বাতিল হইবে ইহা যুক্তিযুক্ত কথা উপধারা- ৩ এ উল্লেখিত ১৪২ অনুচ্ছেদের অধীন প্রনীত সংশোধনের ক্ষেত্রে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই প্রযোজ্য হইবে না।
ধারা-২৭ আইনের দৃষ্টিতে সমান। সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।
ধারা- ২৮ ধর্ম প্রভৃতির কারণে বৈষম্য। এ ধারার উপধারা- ১, ২, ৩ ও ৪ এ উল্লেখিত নারী পুরুষ, শিশুসহ সকল ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠীর সকলের শিক্ষাসহ সমান অধিকার নিয়ে কথা বলা হয়েছে।
তাছাড়া ধারা- ২৯, ৩০, ৩১ ও ৩২ এ আরোও অন্যান্য অধিকার নিয়ে সংবিধান তৈরি হয়েছে। উপরোক্ত সকল অধিকার ধর্মনিরপেক্ষ মূলনীতিকে অনুসরণ করে সকল ধর্মের উক্ত বিষয় সমূহের নির্দেশনা সমূহ প্রতিপালন করা যেতে পারে বিশেষ করে জীবন বিধান হিসেবে ইসলাম ধর্ম উপরোক্ত বিষয় সমূহ সহ বিভিন্ন বিষয়ে যে সমাধান দিয়েছে মুসলিম সরকার তা বাস্তবায়ন করলে উপরোক্ত ধারা সমূহের বিপরীত কিছুই করতে হবে না। কারণ ইসলামে ঐগুলির সমাধান উত্তরূপ ও আরোও উত্তমরূপে বর্ণিত হয়েছে।
ধারা- ৩৫ এর বিভিন্ন উপধারায় :
বিচার কার্য প্রয়োগে বিভিন্ন দিক সঠিক আছে শুধু আইন ও দণ্ড শরীয়ত অনুসারে মুসলিম সরকার গ্রহণ করতে পারে।
ধারা-৩৬ হতে ধারা-৪৪ পর্যন্ত বিভিন্ন উপধারা স্বাধীনতার বিভিন্ন দিক লিপিবদ্ধ আছে।
যেমন
(১) চলাফেরার স্বাধীনতা।
(২) সমাবেশের স্বাধীনতা।
(৩) সংগঠনের স্বাধীনতা।
(৪) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক স্বাধীনতা।
(৫) পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা।
(৬) ধর্মীয় স্বাধীনতা।
(৭) সম্পত্তির অধিকার।
(৮) গৃহ ও যোগাযোগের রক্ষণ।
(৯) মৌলিক অধিকার বলবৎ করণ।
মুসলিম সরকারের বৈশিষ্ট অনুসারে ঐগুলির সাথে সাংঘার্ষিক নয় বরং আরো চমৎকার সমাধান আছে।
রাষ্ট্র ধর্ম : ২ ক। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন (পরিচ্ছেদ-১৭ এর ৪ নং অনুসারে প্রতিস্থাপন)
সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রতিস্থাপিত হয়েছে। ইহা বাংলাদেশের পরিচয় বহন করছে। সংবধিানে উল্লেখ না থাকলেও মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে এ দেশের রাষ্ট্রীয় পরিচয় ধর্মীয় দিক দিয়ে ইসলাম, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভারত হিন্দু প্রধান হিন্দু রাষ্ট্র, আমেরিকা খৃষ্টান প্রধান- খৃষ্টান রাষ্ট্র, ইহুদী প্রধান-ইহুদী রাষ্ট্র, চিন বৌদ্ধ প্রধান- বৌদ্ধ রাষ্ট্র, সৌদি আরব মুসলিম প্রধান এবং এর রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম তা লিখার প্রয়োজন হয় না। তারপরও লিপিবদ্ধ হওয়াতে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও পরিচয় আরোও সুদৃঢ় হয়েছে।
সংবিধানের চার মূলনীতির সমাধান কি রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম দ্বারা সম্ভব? এ বিষয়ে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে বক্তব্য নিয়ে আমাদের মুসলিম সরকারের নিকট আবেদন করতে চাই যে, উহা সম্ভব কি সম্ভব নয়?
এ ক্ষেত্রের সরকারের করণীয় কি?
(১) দেশে বসবাসরত সকল নাগরিকের ধর্মের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় (সীমা রেখা) প্রকাশ করা।
(২) সকল ধর্মের সীমারেখা (Boundary) কার্যকর থাকলে সকল ধর্মের মানুষ স্ব-স্ব ধর্মের পূর্ণ অনুসারী হয়ে চলতে পারবে। চলার পথ সরকার আইন দ্বারা করে দিবে।
(৩) মুসলিম হিসেবে যারা পরিচিত তারা জানেন ইসলাম শুধু সংকীর্ণ অর্থে ধর্ম নয়, ইহা একটি শ্বাশত জীবন বিধান। যেখানে সমগ্র মানবজাতির সবকিছুর সমাধান আছে। আমরা বিশ্বাস করি সকল মানুষের স্রষ্টা আল্লাহ। বাবা আদম, মা হওয়া হতেই দুনিয়ায় সকল মানুষের জন্ম। তাই যুগে যুগে নবী ও রাসূলগণের মাধ্যমে আল্লাহ তার দেয়া জীবন ব্যবস্থা ইসলাম পাঠিয়ে মানুষকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন। এরই পূর্ণাঙ্গরূপ আমরা লাভ করতে পেরেছি। ইহা কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে। আল্লাহর দেয়া হেদায়াত নবী রাসূলদের প্রতি পর্যায়ক্রমে নতুনভাবে নাজিল হয়েছে তখনি যখন উহার আসল অবস্থা বিকৃত হয়ে গেছে। আজ পৃথিবীতে যত ধর্ম দেখা যায় সেগুলি প্রকৃত ধর্মের বিকৃতরূপ। একমাত্র ইসলাম ছাড়া প্রকৃতরূপে আর কোন ধর্ম এখন চালু নেই। চালু নেই বলেই শেষ নবীর মাধ্যমে ইসলামকে পূর্ণাঙ্গরূপে চলার জন্য আল্লাহ নাজিল করেছেন। ধর্মীয় দিক দিয়ে প্রত্যেকটি ধর্মের মধ্যে, কিছু কিছু ভালনীতি কথা আছে যা বর্তমানে ইসলামের গুণাবলির সাথে মিল খায়। প্রকৃত ধর্ম বিকৃত হওয়ার কারণে ব্যক্তির ইবাদত, সমাজ, পরিবার, অর্থনীতি, আইন, আদালত, বিচার, রাজনীতি, মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধে স্রষ্টার নির্দেশ অবর্তমান থাকায় রাষ্ট্রীয়ভাবে ঐসব ধর্ম অনুসারে বহু কাজ সম্পন্ন হয় না বিধায় স্রষ্টার দেয়া শেষ হেদায়াত ইসলাম অনুসারে মুসলিম সরকার তার বৈশিষ্ট অনুসারে দেশ পরিচালনা করলে সকল ধর্মের মানুষের ধর্মীয় অধিকার সহ সকল অধিকার ভোগ করতে পারবে। নাগরিক হিসেবে দেশে বসবাস করা যেমন তাদের কোন সমস্যা হবে না তেমনি মুসলমানদেরও কোন অসুবিধা হবে না। শুধু শর্ত থাকবে একটি, তা হল দেশের সকল স্তরের মুসলমানকে প্রকৃত মুসলমান হয়ে আল্লাহ ও রাসূলের পথে চলতে হবে। এ বিষয়ে কোন বাত্যয় ঘটলে সরকার খোদার বিধান শক্তভাবে কার্যকর করবে।

আল্লাহ বলেন, ধর্মে কোন যবর দস্তি নেই। অন্যজায়গায় বলেছেন, যার যে ধর্ম সে তা পালন করুক।
আমাদের সংবিধানের চারটি মূলনীতি নিয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ :
চারটি মূলনীতি নিয়ে সংবিধানে যে ব্যাখ্যা আছে তা পূরণ করতে আমার জানামতে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশে সরকার পরিচালনায় ও নেতৃবৃন্দের নিজস্ব চিন্তা ভাবনা, বক্তব্য ও ব্যবহারিক দিক বিশ্লেষণ করলে যা দেখা যায় তাতে সংবিধানের সব-দাবি পূরণ করেও আরো অধিকতর সমাধান পাওয়া যবে যদি মুসলিম সরকার ইসলামের আলোকে তার বৈশিষ্ট অনুসরণ করতে পারে। চারটি মূলনীতি এবং এগুলি হতে উদ্ভূত নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার পরিগণিত কোন হবে না এবং উপস্থাপনার ২ অনুচ্ছেদের বক্তব্যও সাংঘার্ষিক হবে না।
মূল চারটি বিষয়ের চাহিদা ও Sprit পূরণ করতে মুসলিম সরকারের হাতে যে ক্ষমতা থাকবে সে বিষয়ে এখানে লেখা সম্ভব নয়। কারণ প্রতিটি বিষয়ের উপর কুরআন ও সুন্নাহর যে সমাধান আছে তা লিখতে গেলে প্রতিটি বিষয়ের উপর পৃথক পৃথক গ্রন্থ রচিত হবে।
শুধু সংক্ষেপে বলতে চাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য শূরাই নিজাম বিষয়ে আল্লাহ সূরা আশ শূরা ও ইমরানে উল্লেখ করেছেন এবং নবী করীম (সা.) ও খোলাফায়ে রাশেদীনরা রাষ্ট্র পরিচালনায় তা দেখিয়ে গেছেন। উহার উপর ভিত্তি করে আমাদেরকে এগুতে হবে। এবং
ইনসাফ কায়েম ও রাষ্ট্র শক্তি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন :

ধনী গরিবের আকাশচুম্বী পার্থক্যর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ও সাম্য কায়েমে যাকাত ভিত্তিক অর্থনীতি সহ অন্যান্য নীতি কথা, ত্যাগ ও কুরবাণীর যে সব দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন আমাদের প্রিয় রাসূল (সা.) তা গ্রহণ করতে হবে। এগুলির শাখা উপশাখা অনুসরণ করলেই এর সমাধান দেয়া যাবে। নিজে খেয়ে ঘুমালে এবং প্রতিবেশী পেটের জ্বালায় রাতে না খেয়ে ছটফট করলে সে সম্পর্কে রাসূলের বাণী, তরকারির মধ্যে মাছ বা গোশত প্রতিবেশীকে পৌঁছানোর সামর্থ না থাকলে অন্তত তরকারির ঝোল পৌঁছানোর তাগিদ, নিজের হক দাবিয়ে অন্যর হক আদায়, প্রতিবেশীর হক আদায়ে কুররআন সুন্নায় বার বার তাগিদ এবং সমাজে সাম্য আনার নির্দেশনা গ্রহণ করতে হবে। ন্যায় ইনসাফ কায়েমের জন্য আল্লাহ বলেন, ক) “ইন্নাল্লাহা ইয়া মুরুকুম বিল আদলে ওয়াল এহসান” অর্থঃ আল্লাহ ন্যায়নীতি, পরোপকার ও আত্মীয়-স্বজনদেরকে দান করার হুকুম দেন। -সূরা নহল ৯০

খ) আল্লাহ বলেন, বস্তুত আমি পাঠিয়েছি নবী রাসুলগণকে এবং তাদের সাথে নাযিল করেছি কিতাব ও মানদণ্ড, যেন লোকেরা ইনসাফের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আরো নাযিল করেছি লৌহ। সুরা হাদীদ-২৫ লৌহ মানে শক্তি- রাষ্ট্রশক্তি, যে লোক কুরআনের হেদায়াত পেয়ে দ্বীনের পথে চলতে উদ্যোগী হবে না। রাষ্ট্রশক্তি তাকে গোমরাহি ও বিপর্যয় সৃষ্টির পথ থেকে বিরত রাখতে পারবে। নৌকার আরোহীরা ডুবে মরুক এ উদ্দেশে নৌকায় ছিদ্র সৃষ্টি করার অধিকার কাউকে দেয়া যেতে পারে না। সমাজকে যে শক্তি বিপর্যয় ও পথভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা করতে পারে তা হলো রাষ্ট্র শক্তি, রাষ্ট্রর সার্বভৌমত্ব। আল্লাহর এই ভূখন্ডে কোন ব্যক্তি বা শক্তি যাতে তাঁর বিধিবিধানের বিরুদ্ধাচারণ করে কোন বিপর্যয় সৃষ্টি করতে না পারে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী বান্দারা তা রাষ্ট্রীয় শক্তি দিয়ে প্ররিরোধ করবে এবং মানবমন্ডলির জন্য পূর্ণ ইনসাফ কায়েম করবে। (চলবে)

https://dailysangram.info/post/477230