১১ জানুয়ারি ২০২২, মঙ্গলবার, ২:০৩

কুঋণ হচ্ছে সব খেলাপি ঋণ

৯০ শতাংশই আদায় অযোগ্যে পরিণত

কুঋণে চলে যাচ্ছে খেলাপি ঋণ। দীর্ঘ দিন ধরে আদায় না হওয়ায় এরই মধ্যে প্রায় ৯০ ভাগ খেলাপি ঋণ আদায় অযোগ্য ঋণে পরিণত হচ্ছে। এমনকি দীর্র্ঘ দুই বছর ঋণ আদায়ে শিথিলতা থাকায় বড় অঙ্কের ঋণখেলাপি হওয়ার আগের স্তরে রয়েছে। ঋণ আদায়ের শিথিলতা আর না দেয়া হলে সামনে মার্চের হিসাবেই বড় অঙ্কের ঋণখেলাপির খাতায় যুক্ত হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী কোনো ঋণের কিস্তি পরপর ছয় মাস পরিশোধ না হলে ওই ঋণ খেলাপি ঋণে পরিণত হয়। এই খেলাপি ঋণের আগের স্তর হলো এসএমএ অর্থাৎ মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ। আগে যা ছিল ৩ মাস। এসব মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ ৬ মাস অতিক্রম করলেই তা খেলাপি ঋণে পরিণত হবে। খেলাপি ঋণ আবার তিন ধরনের হয়। ঋণের কিস্তি ৬ মাস অতিক্রম হলেই সেটি খেলাপি ঋণের নিম্ন স্তর বা নিম্নমানের খেলাপি ঋণ হয়। ৯ মাস অতিক্রম হলেই ওই ঋণ সন্দেহজনক খেলাপি ঋণে পরিণত হয়। আর এক বছর পার হলেই তা মন্দ বা কুঋণ হয়। এসব ঋণকে ব্যাংকিং খাতে আদায় অযোগ্য খেলাপি ঋণ বলা হয়। এ ধরনের ঋণ আদায়ের জন্য সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের বিরুদ্ধে ব্যাংকগুলোর মামলা করার অনুমোদন রয়েছে। আবার কোনো ঋণ মন্দ ঋণে চলে গেলে আর তা পরপর তিন বছর আদায় না হলে তা খেলাপি ঋণের হিসাব থেকেই আলাদা করে রাখা হয়; যা ব্যাংকিং ভাষায় ঋণ অবলোপন বলে।

জানা গেছে, করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব থেকে ব্যবসায়ীদের কিছুটা রেহাই দেয়ার জন্য দুই বছরের জন্য ঋণশ্রেণীকরণ থেকে অব্যাহতি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বশেষ বলা হয়, মাত্র বকেয়া কিস্তির ১৫ শতাংশ পরিশোধ করা হলে পুরো ঋণই নিয়মিত হয়ে যাবে। এ শিথিলতাও গত ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়ে গেছে। নতুন করে আর কোনো শিথিলতা দেয়া হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের হিসাব চূড়ান্ত করা হয়েছে। ডিসেম্বরের হিসাব এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ঋণ আদায়ের শিথিলতার মাঝেই গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে এক লাখ এক হাজার ১৪৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দ ঋণই ৯০ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ৯০ শতাংশ। গত মার্চ শেষে এ কুঋণ ছিল প্রায় ৮৪ হাজার কোটি টাকা। ৬ মাসে মন্দ ঋণ বেড়েছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। মন্দ ঋণ বেড়ে যাওয়ায় সুদ আয় স্থগিত করা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪১ হাজার কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ আরো বেড়ে যাবে, যদিও এ হিসাব এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি। পাশাপাশি খেলাপি ঋণের পূর্ব অবস্থায় বড় অঙ্কের ঋণ। এসব ঋণ যুক্ত হয়ে বড় আকারের খেলাপি ঋণ ধারণ করবে মার্চ শেষে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতিমালা আবার শিথিল করলে তা আগের অবস্থায় থাকবে।

সাড়ে ৪১ হাজার কোটি টাকার সুদ আয় স্থগিত : ব্যাংকিং খাতে মন্দ ঋণ বেড়ে যাওয়ায় প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকার সুদ স্থগিত করা হয়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে ব্যাংকের মুনাফায়। আর মুনাফা কমে যাওয়ায় শেয়ারহোল্ডাররা বছর শেষে প্রকৃত লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এর ফলে একদিকে ব্যাংকগুলোর মুনাফা কমে যাচ্ছে পাশাপাশি শেয়ারহোল্ডাররাও বছর শেষে প্রকৃত লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পাশাপাশি টাকা আটকে যাওয়ায় ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। মন্দ ঋণ বেড়ে যাওয়ায় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর নিট আয় কমে গেছে। শুধু ব্যাংকগুলোর নিট লোকসানই বাড়েনি, প্রায় ডজন খানেক ব্যাংকের ইতোমধ্যে মূলধন ঘাটতি বেড়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে এক লাখ ১৪৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকাই মন্দ ঋণ। এ হিসাবে ১০০ টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে ৯০ টাকাই মন্দ ঋণ, যা আদায় অযোগ্য বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, এ মন্দ ঋণের বিপরীতে সুদ আয় স্থগিত করে রাখতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী মন্দ ঋণের বিপরীতে ধার্যকৃত সুদ ব্যাংকগুলোর আয় খাত থেকে আলাদা করে রাখা হয়। অপর দিকে এ ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর আয় খাত থেকে টাকা এনে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। জানা গেছে, মন্দ ঋণ ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ হিসাবে ধরা হয়। আর এ ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে ১০০ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হয়। প্রভিশন ঘাটতি হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ব্যাংকগুলোর জরিমানা বা তিরস্কার গুনতে হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তিরস্কার বা জরিমানার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ব্যাংকের আয় খাত থেকে টাকা এনে প্রভিশন ঘাটতি পূরণ করে থাকে।

পাশাপাশি, মন্দ ঋণের বিপরীতে অর্জিত সুদ ব্যাংকগুলোর আয় খাতে স্থানান্তর করা হয় না। অর্জিত সুদ ব্যাংকের আলাদা হিসেবে স্থগিত করে রাখা হয়। গত ৩০ সেপ্টেম্বরভিত্তিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকিং খাতের প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকার মন্দ ঋণের বিপরীতে প্রায় সাড়ে ৪১ হাজার কোটি টাকার সুদ আয় খাতে আনা যায়নি। এটা ব্যাংকের আলাদা হিসাবে রাখা হয়েছে। এর ফলে ব্যাংকের আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আর প্রকৃত লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/635692