৯ জানুয়ারি ২০২২, রবিবার, ১১:৩৬

দায় অস্বীকার আর নয়

মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ঢাকার নীতি পরিবর্তন

বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করার প্রবণতা থেকে সরে আসছে সরকার। এখন মানবাধিকার নিয়ে বিদেশী রাষ্ট্র, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশ ও জাতিসঙ্ঘের অসন্তুষ্ট হওয়ার কারণ খুঁজে বের করে তার সুরাহার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। আর এ সব প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং এর সাবেক ও বর্তমান ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও নিরাপত্তা খাতে অনুদান অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে শর্তারোপের পর থেকে।

নিরাপত্তা খাতে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র। তার চেয়েও পশ্চিমা দেশটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে। আর এসব বিবেচনায় নিয়েই বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো, বিশেষ করে র্যাব যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগগুলো নিরসন করে প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার চায়। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় প্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তা সরঞ্জামগুলোর অব্যাহত সরবরাহ চায় বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত এই এলিট ফোর্স। অন্য দিকে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ তৈরী পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। কেননা বাংলাদেশের তৈরী পোশাকের একক বৃহত্তম বাজার যুক্তরাষ্ট্র। তাই যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা অন্য কোনো ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হয় কিনা এটা নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছে বাংলাদেশের জন্য সর্বাধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী শিল্প খাতটি।

এর আগে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার পরিষদে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের অভিযোগ বারবার উত্থাপিত হলেও সরকার তা অস্বীকার করে গেছে। বিশেষ করে পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সরকারের কাছে অভিযোগ করলেও তার সন্তোষজনক জবাব পায়নি। এমনকি অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতে ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও সরকারের কাছ থেকে সাড়া মেলেনি। কিন্তু এবার নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর সাথে আলোচনা করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসব অভিযোগের ব্যাপারে বাস্তবভিত্তিক জবাব দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকারের ওপর কয়েকটি বিদেশী রাষ্ট্রের অসন্তুষ্ট হওয়ার কারণ খুঁজে বের করে তার সুরাহার উদ্যোগ নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন।

এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির গতকাল শনিবার নয়া দিগন্তের সাথে আলাপকালে জানান, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ খণ্ডন বা বিদেশী রাষ্ট্রসহ জাতিসঙ্ঘের অসন্তোষ দূর করার সরকারের সাম্প্রতিক উদ্যোগগুলো ইতিবাচক। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ সংক্রান্ত বক্তব্যে যথেষ্ঠ যুক্তি রয়েছে। নিজেদের দিকে তাকানোর সুযোগ থাকলে তা গ্রহণ করা উচিত বলে আমরা বারবার বলে আসছি। জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের অভিযোগগুলোর বাস্তবভিত্তিক উত্তর দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে- সরকারের এই উপলব্ধিটা একটা অগ্রগতি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের পথে রয়েছে। একটি রাষ্ট্রের এ ধরনের উত্তরণের সাথে সাথে সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় চলে আসে। তাই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি নীতি-নৈতিকতা ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার প্রতিও আমাদের সচেতন হতে হবে। আর আমাদের কাজে তা প্রমাণ করতে হবে। এই প্রাথমিক ধাপটা অর্জন করা গেলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে।

মানবাধিকার সুরক্ষার বিষয়টি বাংলাদেশকে বিভিন্ন রাষ্ট্র আকারে-ইঙ্গিতে বহু দিন ধরে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে উল্লেখ করে হুমায়ুন কবির বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ক্রমাগতভাবে বলে যাচ্ছে, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পর ইউরোপের বাজারে জিএসপির ধারাবাহিকতায় শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা ‘জিএসপি প্লাস’ চাইলে বাংলাদেশকে মানবাধিকার, শ্রম অধিকার ইত্যাদির বিষয়ে আরো বেশি সংবেদনশীল হতে হবে। তিনি বলেন, কাজের ক্ষেত্রে মানুষের ভুল হয়ে থাকতে পারে। তবে তা স্বীকার করে নিয়ে ভুলের পুনরাবৃত্তি রোধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আর এটা করে গেলে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে এবং সার্বিকভাবে তা জনগণের জন্য মঙ্গলজনক হবে।

হুমায়ুন কবির বলেন, ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস থেকে শুরু করে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত সব ক’টি সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে। এই সনদগুলোতে সই করে আমরা যে অঙ্গীকার করেছি, তার রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই। বিদেশী বন্ধু রাষ্ট্রগুলো এই অঙ্গীকারগুলোর কথা বাংলাদেশকে স্মরণ করিয়ে দেয়াটা আমার কাছে অসম্মানজনক মনে হয়। রক্ত দিয়ে পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জন্য কথা শুনতে কষ্ট লাগে। সে দিক থেকে গত সপ্তাহের ঘটনাগুলো (সরকারের অবস্থান পরিবর্তন) আমার কাছে ইতিবাচক মনে হয়েছে। এখন সরকারকে তার বাস্তব প্রতিফলন দেখাতে হবে। আমাদের কাজই বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থানটা নির্ণয় করে দেবে।

গণতন্ত্র শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানানো, র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞাÑ এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসনের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ওপর গুরুত্বারোপের নীতির প্রতিফলন কিনা জানতে চাওয়া হলে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, সামরিক ও অর্থনৈতিক ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের হাতে বড় দু’টি ক্ষমতা রয়েছে। এর একটি হলো বিশ্বের জন্য মানদণ্ড তৈরি করা। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বড় ক্ষমতা এই মুহূর্ত পর্যন্ত করো নেই। জাতিসঙ্ঘের সৃষ্টি, ১৯৪৮ সালের ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস সনদ, ১৯৬৬ সালের সংস্কৃতি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত সনদ- এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ধারণাপ্রসূত। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা সৃষ্টির পেছনেও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ কাজ করেছে।

বিশ্বের মানদণ্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বা প্রক্রিয়াগুলো যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গড়া। দ্বিতীয়ত, কূটনীতির মাধ্যমে বিশ্ব জনমতকে নিজের পক্ষে নিয়ে আসার ক্ষমতার ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ কেউ নেই। অর্থনৈতিকভাবে চীন, সামরিকভাবে রাশিয়া বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। কিন্তু বাকি দু’টি ক্ষেত্রে বর্তমান বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সব বক্তব্যের সাথে আমরা একমত নাও হতে পারি। কিন্তু এই একমত না হওয়ার কারণে যে ধাক্কাটা আসতে পারে সেই উপলব্ধিটা আমাদের থাকা প্রয়োজন। পরিণতি বিবেচনায় রাশিয়া বা চীনের মতো শক্তিধর দেশগুলোকেও সেটা গুরুত্বের সাথে নিতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র কোনো নীতি অনুসরণ করতে চাইলে বিশ্বব্যাপী তার একটি প্রভাব পড়বে। বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।

হুমায়ুন কবির বলেন, রফতানি বাজার, রেমিট্যান্স ইত্যাদি বহুমাত্রিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা রয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ককে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। এগুলো বিবেচনায় আমাদের স্বল্পমেয়াদি কোনো সিদ্ধান্ত যাতে দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় স্বার্থকে ক্ষুণœ না করে সেদিকটা লক্ষ রাখতে হবে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/635314