৯ জানুয়ারি ২০২২, রবিবার, ১০:৫১

১২ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান : বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে হু হু করে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমান। তথ্য বলছে, ২০০৯ সালে দেশে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা।  আর এখন তা  ১ লাখ ১ হাজার ১৫০ কোটি। অর্থাৎ ১২ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় পাঁচ গুণ। বছর হিসাবে হলে প্রতিবছর প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা করে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। আর এর সঙ্গে যদি অবলোপন করা ঋণ ধরা হয়, তাহলে মোট খেলাপি দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এখন পর্যন্ত অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এটাকে গোপন খেলাপি ঋণও বলা হয়। এদিকে ঋণের টাকা ফেরত না আসলেও প্রকৃত খেলাপির তথ্য তুলে ধরা হচ্ছে না দীর্ঘদিন ধরে। ব্যাংকগুলোকে প্রভিশন রাখার ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়েছে। ফলে সবগুলো ব্যাংকে মন্দ ঋণের পাহাড় জমছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের মতে গোপন খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি। এ নিয়ে ২০১৯ সালের অক্টোবরে বিশেষ একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল আইএমএফ। সেখানে সংস্থাটি বলেছিল, বাংলাদেশে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের মধ্যে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার প্রবণতার শিকড় অত্যন্ত গভীরে। ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংক খাতে যেভাবে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ার কথা ছিল, সেভাবে তা বাড়েনি। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংক গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধে বড় ধরনের ছাড় দিয়ে রেখেছে। ফলে ঋণ শোধ না করেও অনেকে খেলাপির তালিকায় যুক্ত হয়নি। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ঋণের টাকা ফেরত না দিয়ে অনেকেই ঋণ মওকুফ এর সুযোগ নিচ্ছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে গত বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে ব্যাংকগুলো মোট ২ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকার ঋণ মওকুফ করেছে। ২০১৯ সালে ব্যাংকগুলো ২ হাজার ২৯৩ কোটি টাকার ঋণ মওকুফ করেছিল। ২০১৮ সালে মওকুফ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আগে ব্যাংকের ভালো গ্রাহক আর মন্দ গ্রাহক বিবেচনা করা হতো। এখন মন্দ গ্রাহকের সঙ্গে ব্যাংক মালিকদের ভালো সম্পর্ক দেখা যায়। মূলত পরিচালকরা একে অপরের সঙ্গে যোগসাজশ করে মওকুফের এসব সুবিধা নিচ্ছেন। ব্যাংক খাতে সুশাসন না থাকার কারণে এমনটি হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ব্যাংকগুলো তাদের খেলাপি হওয়া ঋণ থেকে ৪ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা আদায় করেছে। ১ বছর আগে একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা। অবশ্য ২০২০ সালে ব্যাংকগুলো তাদের সম্মিলিত খেলাপি ঋণ থেকে ৫ হাজার ৮০২ কোটি টাকা পুনরুদ্ধার করে। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে এর পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা।

সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৬৫ হাজার ২১০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের  কর্মকর্তারা বলছেন, এর আগে কিছু প্রভাবশালী গ্রাহকের খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করার সময় কয়েকটি ব্যাংক তাদের বিপুল পরিমাণ ঋণ মওকুফ করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ব্যাংক খাতে এখন মন্দ ঋণের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকার বেশি। ভালো উদ্যোক্তাদের সঙ্গে অ্যাননটেক্স গ্রুপের মতো সমালোচিত প্রতিষ্ঠানও খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল বা নিয়মিত করেছে। গত মঙ্গলবার (৪ জানুয়ারি)  বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ বিশেষ বিবেচনায় অ্যাননটেক্স গ্রুপের খেলাপি ঋণকে নিয়মিত করেছে। জানা গেছে, গ্রুপটির ১৬টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আর অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে আরও প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার ঋণ। গ্রুপটি এর আগে তাদের অন্য চার প্রতিষ্ঠানের ঋণে পুনর্গঠন সুবিধা নিয়েছে, তাতে ওই ঋণের বিপরীতে নতুন করে পুনঃতফসিল করতে হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, শুধু অ্যাননটেক্স গ্রুপই নয়, জালিয়াতির মাধ্যমে নেওয়া অনেক ঋণ বিশেষ সুবিধায় নিয়মিত করা হয়েছে। এর ফলে ব্যাংক খাতে ভালো মানের ঋণের চেয়ে মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে।

https://dailysangram.com/post/476905