৮ জানুয়ারি ২০২২, শনিবার, ১০:৩৮

ধান সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার ১০ শতাংশ

চাল দিয়ে লাভবান মিলাররা

গত বছরের চেয়ে আমন ধানের কিছুটা ভালো দাম পেয়ে কৃষক খুশি হলেও বিপাকে পড়েছে সরকার। সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে স্থানীয় বাজারে দাম বেশি থাকায় সরকারি গুদামে ধান বিক্রিতে কৃষকের আগ্রহ নেই। এতে ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রার ১০ শতাংশও অর্জন হয়নি গত দুই মাসে। বাকি দেড় মাসে ৯০ শতাংশের ওপরে ধান কেনার লক্ষ্য পূরণ সম্ভব নয়, বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

তবে খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ধানে পিছিয়ে থাকায় তারা চাল কেনায় মনোযোগ দিয়েছে। মিল মালিকদের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে নিয়মিতই তারা চাল সরবরাহ করছে। এতে খাদ্যের মজুদ নিয়ে তেমন সমস্যা হবে না বলেও মনে করছে তারা।

কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্তে বাজারে দুই ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। সরকার এবার ধানের দাম বাড়িয়েছে এক টাকা, বিপরীতে চালের দাম বাড়িয়েছে তিন টাকা। এতে কৃষকের সরকারি গুদামে ধান দিয়ে খরচে পোষাচ্ছে না। তাঁরা দাম কিছুটা কম হলেও বাড়িতে ফড়িয়ার কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন।

বিপরীতে চালের দাম বেশি হওয়ায় মিল মালিকরা সরকারি গুদামে চাল দিচ্ছেন বেশি, যে চালগুলো বাজারে আসছে না। ফলে ভরা মৌসুমেও বাজারে চালের দাম বাড়ছে। সরকারের সিদ্ধান্তে শেষ পর্যন্ত লাভবান মিল মালিকরাই। কৃষক খুব একটা নয়।

খাদ্য মন্ত্রণালয় গত ৭ নভেম্বর থেকে আমন সংগ্রহ কার্যক্রম শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়। প্রতিবছরের মতো ২৮ ফেব্রুয়ারি এই কার্যক্রম চালোনো হবে। আমনের এই মৌসুমে সরকারিভাবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে তিন লাখ মেট্রিক টন আমন ধান কেনার লক্ষ্য ঠিক করে মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া পাঁচ লাখ মেট্রিক টন সিদ্ধ আমন চাল সংগ্রহ করার লক্ষ্য নেওয়া হয়।

২০২০ সালে আমন মৌসুমে দুই লাখ টন ধান, ছয় লাখ টন সিদ্ধ চাল এবং ৫০ হাজার টন আতপ চাল সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা ছিল। সে হিসেবে চলতি মৌসুমে ধানের সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে এক লাখ টন এবং সিদ্ধ চালের সংগ্রহ লক্ষ্য কমেছে এক লাখ টন।

সংগ্রহের জন্য ধানের প্রতি কেজি দাম ঠিক করা হয় ২৭ টাকা এবং চালের ৪০ টাকা। আগের বছর আমন ধানের সংগ্রহমূল্য ছিল ২৬ টাকা এবং চালের ছিল ৩৭ টাকা। অর্থাৎ চালে তিন টাকা বাড়লেও ধানে বেড়েছে এক টাকা।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, গত ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমন ধান সংগ্রহ হয়েছে ২৪ হাজার ১১১ টন। লক্ষ্যমাত্রার ৮ শতাংশ। বিপরীতে তিন লাখ ১৫ হাজার ৩৪২ মেট্রিক টন সিদ্ধ আমন চাল সংগৃহীত হয়, যা এ মৌসুমের লক্ষ্যমাত্রার ৬০ শতাংশ। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সরকারকে ৯২ শতাংশ ধান এবং ৪০ শতাংশ চাল সংগ্রহ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই ধারাবাহিকতায় চললে চালের সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার অনেক বেশি হয়ে যাবে। কিন্তু ধানের সংগ্রহের লক্ষ্য থেকে অনেক পিছিয়ে থাকবে সরকার।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সংগ্রহ ও সরবরাহ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব খাজা আব্দুল হান্নান বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল কৃষকরা যাতে ধানের ন্যায্য দাম পায়। সরকারি সংগ্রহের কারণে বাজারে ধানের দাম ভালো, যা সরকারি দামের চেয়ে বেশি বা কাছাকাছি। আমরা ধান কেনার সময় ময়েশ্চার (আর্দ্রতা) দেখে ধান কিনি। তাই অনেক কৃষক ঝামেলা মনে করে সরকারি গুদামে ধান দিতে আসে না। বাজারে ভালো দাম পেয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে। এ ছাড়া ধানের মৌসুমে ফড়িয়ারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান কেনে। তাই অনেক কৃষক বাড়িতেই ধান বিক্রি করে দিচ্ছে। তবে এতে সরকারি মজুদে তেমন সমস্যা হবে না। কারণ আমরা চাল কেনায় বেশি মনোযোগ দিয়েছি।’

সরকার ধানের পরিবর্তে চাল সংগ্রহ বেশি করায় তার ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে নিত্যদিনের চালের বাজারে। ভরা মৌসুমেও চালের দাম দুই দফা বেড়েছে।

কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সরকারের উচিত চালের চেয়ে বেশি করে ধান কেনা। কিন্তু কৃষক ধান ভালোভাবে শুকিয়ে ময়েশ্চার নির্ধারিত মাত্রায় এনে গাড়িভাড়া খরচ করে সরকারি গুদামে পৌঁছে দিয়ে ধান বিক্রি করে তেমন লাভবান হচ্ছেন না। ফলে দাম কিছুটা কম হলেও মিল মালিকদের নিয়োজিত ফড়িয়াদের কাছে বাড়িতে বসেই ধান বিক্রি করে দিচ্ছেন। তিনি বলেন, এ অবস্থায় মিল মালিকরা এক টাকা বেশি দামে ধান কিনে তিন টাকা বেশি দামে চাল বিক্রি করছেন সরকারের কাছে। এতে দুই দিকে ক্ষতি হচ্ছে। যে চাল তাঁরা সরকারের গুদামে দিচ্ছেন, তা আর বাজারে আসছে না। এতে বাজারে চালের সরবরাহে ভাটা পড়েছে। সরবরাহের ভাটায় চালের দাম আরো বেড়েছে। সব মিলিয়ে মুনাফার ভাগ সেই মিল মালিকেরই বেশি।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক আন্ত প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে বাজারে দাম ভালো স্থিতিশীল রাখতে সরকারকে উৎপাদনের ১০ শতাংশ ধান-চাল মজুদ রাখা উচিত। দেশে প্রতিবছর তিন কোটি ৮০ লাখ টন ধান উৎপাদনের হিসেবে যৌক্তিক মজুদ পরিমাণ ৪৫ লাখ টনের বেশি।

তবে গবেষণায় বলা হয়েছে, বার্ষিক সংগ্রহ ২৫ লাখ টনের বেশি হতে হবে। প্রতি মাসে দেশে কমপক্ষে ২৫ লাখ টন চালের প্রয়োজন হয়। সে হিসাবে ১৫ দিনের মজুদ দাঁড়ায় সাড়ে ১২ লাখ টন। অর্থাৎ এই পরিমাণ চাল সরকারের গুদামে সব সময় মজুদ থাকা দরকার।

গত ২ জানুয়ারির হিসাবে খাদ্যশস্যের সরকারি মোট মজুদ ১৮.৫৫ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে চাল ১৪.৯৫ লাখ মেট্রিক টন, গম ৩.৪৪ লাখ মেট্রিক টন এবং ধান ০.২৫ লাখ মেট্রিক টন।

গত বছর বোরো ও আমন মিলিয়ে মোট সাড়ে ২৬ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহ লক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা পূরণ হয়নি বলে মজুদ নেমে গিয়েছিল প্রত্যাশিত মাত্রার অনেক নিচে। এতে প্রতিবেশী দেশ থেকে চাল আমদানি করতে হয়েছে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2022/01/08/1108829