৮ জানুয়ারি ২০২২, শনিবার, ১০:১৮

কিভাবে কাজ করে ভ্যাকসিন

-ডা: তৌহিদ হোসেইন

মানুষকে সব সময়ই অসংখ্য রোগজীবাণুর মোকাবেলা করেই টিকে থাকতে হয়। টিকে থাকার ন্যাচারাল ব্যবস্থা সৃষ্টিগতভাবেই মানুষ পেয়ে থাকে। অনেক সময়েই মানুষ পেরে উঠতে না পারলে নানা রকম রোগের সৃষ্টি। মানুষ উন্নত জীব হওয়ার কারণে অনেক সময় শরীরের ইমিউন সিস্টেম রোগ প্রতিরোধ করতে অসমর্থ হলে অতিরিক্ত সাপোর্টের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই অতিরিক্ত সাপোর্টকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগ প্রতিরোধের পাঁচটি বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিরোধ লেভেলে ভাগ করেছে।

ডিজিজ প্রিভেনশনের বিভিন্ন লেভেল
প্রথমত, প্রি-মরডিয়াল প্রিভেনশন। মায়ের গর্ভাবস্থায় গর্ভের সন্তানকে রক্ষার জন্য মাকে টিটেনাস ও রোবেলার টিকা দেয়া বা মায়ের যতœ নেয়া, যাতে গর্ভের বাচ্চা সুস্থ থাকে।

দ্বিতীয়ত, প্রাইমারি প্রিভেনশন। সমাজে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা-স্বাস্থ্য উন্নয়ন এবং টিকাকার্যক্রম চালুকরণের মাধ্যমে সমাজে রোগ বিস্তারের অনুকূল পরিবেশ ধ্বংস করা। তৃতীয়ত, সেকেন্ডারি প্রিভেনশন। এর আওতাভুক্ত হলো দ্রুত রোগ শনাক্তকরণ, আইসোলেশন এবং কোয়ারেন্টিন।
চতুর্থত, টারসিয়ারি প্রিভেনশন। রোগীর দ্রুত চিকিৎসা এবং জটিলতা এড়ানো। পঞ্চমত, কোয়ার্টারনারি প্রিভেনশন। সংক্রামক রোগের কারণে সৃষ্ট রোগ জটিলতার ফলোআপ ও রিহেবিলিটেশন।

ভ্যাকসিন কী?
টিকা হলো ভবিষ্যতে নির্দিষ্ট একটি রোগজীবাণু থেকে বাঁচার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এবং প্রাইমারি প্রিভেনশনের আওতাভুক্ত।
‘যার দ্বারা আমি আক্রান্ত হই, তাকে দিয়েই আমি প্রতিরোধ গড়ব’- অনেকটা এই মূলমন্ত্রের ওপরেই টিকার আবিষ্কার। সুতরাং যে জীবাণু দিয়ে মানুষ আক্রান্ত হন, সেই জীবাণু থেকেই তার দ্বারা সৃষ্ট রোগের ভ্যাকসিন প্রস্তুত করা হয়। পৃথিবীর বুকে মানুষকে আক্রান্তকারী এমন কোনো রোগ নেই যার কোনো ওষুধ বা প্রতিষেধক নেই। বিশ্ব মানবতার নবী হজরত মোহাম্মদ সা: একটি সহিহ হাদিসের মাধ্যমে এই বাস্তবতারই জয়গান গেয়েছেন। আবু হুরাইরাহ রা: থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা: বলেছেন : ‘আল্লাহ তায়ালা এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি যার ওষুধ বা প্রতিষেধক সৃষ্টি করেননি’ (বুখারি হাদিস নং-৫২৭৪)। অতীব আশ্চর্যের বিষয় হলো প্রত্যকটি সংক্রামক রোগজীবাণুরই অন্য অনেক বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি দু’টি বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্য আছে। তার একটি হলো রোগ সৃষ্টি করার ক্ষমতা যাকে বলে প্যাথজেনিসিটি, অপরটি হলো সেই রোগজীবাণুর এমন নিহিত উপাদান (মূলত প্রোটিন) যার উপস্থিতির কারণে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে আপনা থেকে সেই রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে উদ্বুদ্ধ করবে। রোগজীবাণুর এই বৈশিষ্ট্যের নাম হলো অ্যান্টিজেনিসিটি। রোগজীবাণুর এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই আক্রান্ত শরীর তাকে বিদেশী হিসেবে চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে তাকে মেরে ফেলতে চেষ্টা করে।

ভ্যাকসিন তৈরির সময় রোগজীবাণুর রোগ সৃষ্টির ক্ষমতাটিকে নষ্ট করে দেয়া হয় কিন্তু অন্য বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ অ্যান্টিযেনিসিটি ঠিক রাখা হয়। সোজা কথায় রোগ সৃষ্টির ক্ষমতাহীন জীবাণু বা তার অ্যান্টিজেনিসিটি ক্ষমতাসম্পন্ন রোগজীবাণুর উপাদানকেই ভ্যাকসিন হিসেবে দেহে প্রবেশ করানো হয়। ফলশ্রুতিতে এই জীবাণু দেহে রোগের কারণ হয় না, উল্টো রোগটি যেন না হয় তার জন্য বিশেষ প্রোটিন অ্যান্টিবিডি তৈরি করতে থাকে। আরেকটি সুবিধা হলো এই জীবাণুগুলো মেমরি সেল গঠন করে ফলে পরবর্তীতে একই জীবাণু পুনরায় প্রবেশ করলে সহজে শনাক্ত করে ফেলে। এভাবে ভ্যাকসিন শরীরের ইমিউনিটিকে বাড়িয়ে দেয়। ইঞ্জেকশন বা মুখে খাওয়ার মাধ্যমে ভ্যাকসিন দেয়া যায়।

আমাদের প্রিয় শরীরটাকে যদি রাষ্ট্র ধরি তাহলে এই রাষ্ট্রকে সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য আছে বিভিন্ন কার্যকর মন্ত্রণালয়। পুরো শরীরটা যেন একটা কম্পিউটার যার রক্ত, হাড় বা মাংস ইত্যাদি হলো হার্ডওয়ার আর বিভিন্ন ফিজিওলজিক সিস্টেম হলো সফট্ ওয়ার। মানুষের শরীর নামক রাষ্ট্রটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন ফিজিওলজিক সিস্টেম। যেমন আছে খাদ্য মন্ত্রণালয় তথা গেস্ট্রোইন্টেস্টিনাল সিস্টেম, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় তথা রক্ত সংবহনতন্ত্র, তেমনি আছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তথা ইমিউন সিস্টেম। ইমিউন সিস্টেম হলো শরীরের সবচেয়ে বড় ফিজিওলজিক সিস্টেম যার কার্যক্রম সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
ভ্যাকসিন হলো বাদক দল, গাড়ির সিট বেল্ট অথবা গ্রামের চৌকিদার

মানুষের শরীরের সবচেয়ে বিস্তৃত এবং বড় ফিজিওলজিক্যাল সিস্টেম হলো ইমিউন সিস্টেম। একটা রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষার জন্য দরকার হয় স্থল, বিমান ও নৌবাহিনী, বিভিন্ন স্থানে আর্মি ক্যাম্প, সড়ক, নৌ ও আকাশপথ এবং সীমান্ত রক্ষার জন্য বর্ডার গার্ড বাহিনী, চেক পয়েন্ট যা শরীরের ইমিউন সিস্টেমের সাথে তুলনীয়। শরীরের অস্থিমজ্জা যেখানে সব ধরনের লোহিত, শ্বেতকণিকা এবং অনুচক্রিকা তৈরি হয় আর থাইমাস গ্ল্যান্ড যেখানে টি-সেল ম্যাচিইউর হয়-আর্মি হেডকোয়ার্টারের মতো। সারা শরীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লিম্ফনোডগুলো আর্মি ক্যাম্পসদৃশ। লিম্ফনোড চ্যানেল আর রক্তনালীগুলো যথাক্রমে আর্মির জলপথ ও স্থলপথ সদৃশ। চামড়ার নিচে থাকা ডেন্ড্রাইটিক সেল এবং মিউকাস মেমব্রেনে থাকা লিম্ফনোডগুলো বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ।
টিকা আর কিছুই না, বরং টিকার ভূমিকা হলো বাদক দলের মতো যারা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে না কিন্তু যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে সৈন্যদেরকে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার জন্য উদ্বুদ্ধ করে।
টিকা হলো গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসা ড্রাইভারের সেফটি বেল্ট যা দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করতে না পারলেও দুর্ঘটনা হয়ে গেলে তা থেকে কিছুটা হলেও সুরক্ষা দেয়।
টিকা হলো গ্রামের চৌকিদার যার কাজ হলো সারা রাত জেগে পাহারা দেয়া যাতে চোর-ডাকাত ঢোকার সাথে সাথেই গ্রামবাসীকে জাগিয়ে তুলতে পারে।
ভ্যাকসিনেশন দুই প্রকার- রোগ হওয়ার আগেই ভ্যাকসিন দেয়া বা অ্যাকটিভ ইমিউনাইজেশন আর রোগ হওয়ার পরে দেয়া যাকে প্যাসিভ ইমিউনাইজেশন বলে।
টিকায় কী থাকে?
ভ্যাকসিনের ডোজে অনেক উপাদান থাকে। তার মধ্যে মূল উপাদান হলো সক্রিয় উপাদান, ইমিউনোজেন যা মূলত ভাইরাস কণা বা পার্টিকেলের ন্যানোগ্রাম পরিমাণ থাকে আর ব্যাকটেরিয়া হলে পলিস্যাকারাইডের মাইক্রোগ্রাম পরিমাণ থাকতে পারে। এই সামান্য ন্যানোগ্রাম (১০ লক্ষ ন্যানোগ্রাম=১ মিলিগ্রাম) আর মাইক্রোগ্রাম (১০০০ মাইক্রোগ্রাম=১ মিলিগ্রাম) পরিমাণ জীবাণু-প্রোটিন ঢোকালেই শরীর এতটা রিঅ্যাক্টিভ হয়ে যায় যে জ্বর, শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা ইত্যাদি কত উপসর্গ শুরু হয়। অথচ প্রতিদিন আমরা প্রত্যেকেই কম করে হলেও ১০০ ট্রিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া তার সাথে কোটি কোটি প্রোটিন শরীরের চামড়া, ইন্টেস্টাইন, রেস্পিরেটরি আপার ট্রাক্ট, জেনিটো-ইউরিনারি ট্রাক্টে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি কোনো সমস্যা হচ্ছে না। একটি ভ্যাকসিনের ইনজেকশন হোক আর ওরাল ড্রপস বা নাকের স্প্রে হোক তার বেশির ভাগই পানীয়। বেশির ভাগ ইঞ্জেক্টেবল ভ্যাকসিনের পরিমাণ ০.৫ মি.লি। অসক্রিয় অন্যান্য উপাদান ইমিউনোলজিক প্রতিক্রিয়া বাড়াতে, সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বা সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়। এই উপকরণগুলো খুব সংবেদনশীল লোকদের মধ্যে কিছু কিছু অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। ভ্যাকসিনে ব্যবহৃত বেশির ভাগ উপাদানই ন্যাচারালিই আমাদের শরীরে থাকে।
করোনা টিকায় বা ভ্যাকসিনে মূল উপাদান হিসেবে থাকে মৃত পুরো করোনাভাইরাস, পুরো জীবিত কিন্তু দুর্বল করা করোনাভাইরাস, করোনাভাইরাসের নিউক্লিক এসিড বা আরএনএ যার মধ্যে থাকে জেনেটিক মেটারিয়াল, করোনার একাংশ বা প্রোটিন সাব-ইউনিট, নিউক্লিউক্যাপসিড প্রোটিনের অংশ। এদের কোনো একটি শরীরে ঢোকার পর রোগ সৃষ্টি করার ক্ষমতা নেই।
অতিরিক্ত ইনগ্রেডিয়েন্ট
কিছু কিছু প্রোডাক্ট অতিরিক্ত ইনগ্রেডিয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয় ইমিউন রেসপন্স বাড়ানোর জন্য। অ্যালুমিনিয়াম হাইড্রক্সাইড, অ্যালুমিনিয়াম ফসফেট অথবা পটাসিয়াম অ্যালুমিনিয়াম সালফেট ব্যবহার করা হয় যা একই সাথে অ্যাডজুভ্যান্ট হিসেবে কাজ করে ইমিউন রেসপন্সের শক্তি এবং লংজিভিটি বাড়িয়ে দেয়। প্রিজার্ভেটিভ এবং স্টাবিলাইজার হিসেবে ব্যবহারের জন্য জিলাটিন এবং হিউম্যান সিরাম অ্যালবুমিন ব্যবহার করা হয়।
টিকা উৎপাদনে মূল উপাদান ছাড়াও ব্যবহৃত অসক্রিয় ইনগ্রেডিয়েন্ট যেমন, অ্যান্টিজেন, অ্যাডজুভ্যান্ট, অ্যান্টিবায়োটিক, স্টাবিলাইজার ও প্রিজারভেটিভস ইত্যাদি ব্যবহারে সঠিক মাত্রার ওপর অ্যান্টিবডি রেসপন্স নির্ভর করে।
অনেক সময় একটি ভ্যাকসিনের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এর সাথে আরেকটি ভ্যাকসিন যোগ করা হয় যাকে বলা হয় কনজুগেট ভ্যাকসিন।
কনজুগেট ভ্যাকসিন
এটি এক ধরনের সাব-ইউনিট ভ্যাকসিন যা একটি দুর্বল অ্যান্টিজেনকে আরেকটি শক্তিশালী অ্যান্টিজেনের সাথে বাহক হিসেবে একত্রিত করে যাতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল অ্যান্টিজেনের প্রতি শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
যেমন অ্যানথ্রাক্স ভ্যাকসিনের সাথে পারটুসিস ভ্যাকসিন যোগ করলে অ্যানথ্রাক্সের কাজ করার গতি বৃদ্ধি পায়।
হিব কনজুগেট ভ্যাকসিন বহুল ব্যবহৃত একটি ভ্যাকসিন।
কিউবায় করোনাভাইরাসের রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইনের সাথে টিটেনাস টক্সয়েডের কেমিক্যাল সংযোগ ঘটিয়ে একটি করোনা কনজুগেট ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছে এবং ইমার্জেন্সি ব্যবহারের অনুমোদন পেয়েছে যার নাম দেয়া হয়েছে সুবারানা০২।
অ্যাডজুভ্যান্ট ভ্যাকসিন
এটি হলো এমন একটি সহায়ক উপাদান যা কিছু ভ্যাকসিনে ব্যবহৃত হলে যা ভ্যাকসিন গ্রহণকারী লোকদের একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে সাহায্য করে। অন্য কথায়, সহায়কগুলো ভ্যাকসিনগুলোকে আরো ভালোভাবে কাজ করতে সহায়তা করে।
সহায়ক উপাদান এএস০৩, এমএফ৫৯, সিপিজি১০১৮ ইতোমধ্যেই লাইসেন্সকৃত করোনাভ্যাকসিনে ব্যবহার করা শুরু হয়েছে।
স্টাবিলাইজার হিসাবে স্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্য ভ্যাকসিনে সুগার, ল্যাকটোজ, সরবিটল, গ্লিসারল, ইউরিয়া ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।
ভ্যাকসিনকে ব্যাক্টেরিয়াল গ্রোথ এবং কন্টামিনেশন থেকে দূরে রাখার জন্য নিওমাইসিন, স্ট্রেপ্টোমাইসিন, পলিমিক্সিন-বি, কেনামাইসিন এবং জেন্টামাইসিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়।
ভ্যাকসিন যাতে নষ্ট বা দূষিত না হয় এজন্য অনেক সময় এর সাথে প্রিজারভেটিভ মেশানো হয়। প্রিজার্ভেটিভ সাধারণত মাল্টিডোজ ভায়াল ভ্যাকসিনে ব্যবহার করা হয়। থিমারোসাল নামক একটি মার্কারি সমৃদ্ধ যৌগ সবচেয়ে বেশি প্রিজার্ভেটিভ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়াও ফেনল, ২-ফেনক্সিইথানল এবং বেঞ্জেথনিয়াম প্রিজার্ভেটিভ হিসেবে ভ্যাকসিনে ব্যবহার হয়।
ভ্যাকসিন প্রদানের মূল টার্গেট কী?
ভ্যাকসিনেশনের প্রথম টার্গেট হলো পৃথিবী থেকে একটি নির্দিষ্ট সংক্রামক ব্যাধিকে পুরোপুরি নির্মূল করা।
অন্তত ১০ বছর সময়ের মধ্যে বিশ্বের কোনো অঞ্চলেই যখন কোনো একটি সংক্রামক রোগের অস্তিত্ব দেখা না যায় অর্থাৎ একজন মানুষও আক্রান্ত না হন কেবল তখনই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা মতে রোগটি নির্মূল হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। এক কথায় নির্মূল মানে বিশ্বের কোথাও কোনো নির্দিষ্ট একটি সংক্রামক রোগের অস্তিত্ব না থাকা।
ভ্যাকসিনেশনের দিতীয় টার্গেট হলো নির্মূল করা সম্ভব না হলেও কোনো একটা নির্দিষ্ট অঞ্চল বা দেশ থেকে দূর করে দেয়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে দূরীকরণ মানে টিকা অব্যাহতভাবে চলার মাধ্যমে বিশ্বের বেশির ভাগ অঞ্চলে একটি রোগের অস্তিত্ব থাকবে না।
শত বছর চেষ্টা করলেও কিছু কিছু সংক্রামক রোগ দূরীকরণ বা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলেও নির্মূল করা সম্ভব হবে না।
ভ্যাকসিনেশনের তৃতীয় টার্গেট হলো উপরোক্ত দু’টি টার্গেট সম্ভব না হলেও অন্তত পক্ষে একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় এর সংক্রমণ সহনীয় মাত্রায় একটি সংক্রামক রোগকে বেঁধে ফেলা। এই নিয়ন্ত্রণের সংজ্ঞা একেক ভৌগোলিক এলাকায় একেক রোগের জন্য একেক রকম। যেমন, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ত্রাস সৃষ্টিকারী করোনা মহামারীর বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রণের সংজ্ঞা হলো নমুনা পরীক্ষার সংখ্যার সাপেক্ষে সংক্রমণের হার এক নাগাড়ে ১৫ দিন ৫% এর নিচে থাকা।
টিকা তৈরির মূল এবং মিনিমাম লক্ষ্য মাত্রা হলো
উপসর্গযুক্ত রোগ হবে না।
উপসর্গযুক্ত যদিওবা হয় তা হবে মৃদু কিন্তু মারাত্মক হবে না।
সংক্রামক রোগ আছে বলেই টিকা আবিষ্কার, টিকা মানুষের দেহকে নির্দিষ্ট কোনো একটি অণুজীব, ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়া রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত করে। টিকায় মূলত যে জীবাণুটির কারণে ওই রোগটি হয় তারই একটি নিষ্ক্রিয় বা দুর্বল অংশ থেকে বিশেষভাবে তৈরি করা একটি প্রতিষেধক যা দিয়েই তাকে ভবিষ্যতে প্রতিরোধ করা হয়।
এই অংশটি মানুষের শরীরের টি এবং বি লিম্ফোসাইটস্কে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতের জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি করে রাখে। পরবর্তীতে ঐ একই জীবাণু দ্বারা ব্যক্তি আক্রান্ত হলে এই অ্যান্টিবডিগুলো শরীরের ভেতরে ঢোকা রোগজীবাণুগুলোকে চিনে ফেলে এবং আক্রমণ করে মেরে ফেলে।
টিকা কিভাবে আমাদের শরীরে কাজ করে তা বুঝতে হলে একটা ন্যাচারাল ইনফেকশনকে শরীর কিভাবে মোকাবেলা করে তার কিঞ্চিৎ জানা দরকার।
আমাদের শরীর যখন কোনো নতুন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয় যা আগে কখনো করেনি তখন শরীরের ইমিউন সিস্টেম বৃহত্তর পরিসরে দুইভাবে রেসপন্স করে।
প্রথমত, তৎক্ষণাৎ সরাসরি রেসপন্স বা প্রাথমিক রেসপন্স
দ্বিতীয়ত, এডাপ্টিভ ইমিউন রেসপন্স।
প্রাথমিক ইমিউন রেসপন্স
তাৎক্ষণিক সরাসরি ইমিউন রেসপন্সের একটা ধরনকে আমরা ইনফ্লামেশন বা প্রদাহও বলি। এই ইফ্লামেশন বা প্রদাহ আবার দু’ভাবে হয়ে থাকে। প্রথমত, আমাদের শরীরের রক্তে প্রবহমান শ্বেতকণিকা সেল যেমন নিউট্রোফিল, ম্যাক্রোফেজ ইওসিনোফিল এবং বেজোফিল, ডেনড্রাইটিক সেল ইত্যাদিকে কাজে লাগিয়ে। দ্বিতীয়ত, তাদের রিয়েকশনে প্রস্তুত ইন্টারফেরন ও কেমোকাইন জাতীয় সিক্রেশনকে কাজে লাগিয়ে।
এ ছাড়াও চামড়ার নিচে, নাক, মুখ, পায়ুপথ এবং যৌন নালীতে থাকা অসংখ্য ডেন্ড্রাইটিক সেল পেশাদার অ্যান্টিজেন প্রেজেন্টিং সেল হিসেবে এসব পয়েন্ট থেকে ধরে নিয়ে লম্ফনোডগুলোতে পৌঁছে দেয়।
এডাপ্টিভ ইমিউন রেসপন্স
এডাপ্টিভ ইমিউন রেসপন্সের সাথেই ভ্যাকসিনেশন এবং স্পেসিফিক ইমিউনিটি জড়িত।
এডাপ্টিভ ইমিউন রেসপন্স আবার দুই ভাবে অর্জিত হয়।
বি-সেল থেকে প্রোটিন মলিকিউল ইমিউনো গ্লোবিউলিন বা অ্যান্টিবডি প্রডাকশন করে হিউমোরাল ইমিউনিটি তৈরি করে আর টি লিম্ফোসাইট তৈরি করে সেল মেডিয়েটেড ইমিউনিটি বলে।
পুরো এডাপ্টিভ ইমিউন রেসপন্স মূলত লিম্ফোসাইটকে কেন্দ্র করেই ঘুরপাক খায়। লিম্ফোসাইটকে কাজের সুবিধার কথা বিবেচনা করে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। টি-লিম্ফোসাইট বা টি-সেল এবং বি-লিম্ফোসাইট বা বি-সেল। রক্তে টি-সেল থাকে ৭০ শতাংশ আর বি-সেল ২০ শতাংশ। টি-সেল বেশি দিন বাঁচে এবং রক্তে লিম্ফোকাইন সিক্রেশন করে। টিউমার, ট্রান্সপ্ল্যান্ট, ইন্ট্রাসেলুলার ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধেও টি-সেল সক্রিয়। বি-সেল অল্প দিন বাঁচে, ইমিউনো গ্লোবিউলিন অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এক্সট্রাসেলুলার ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে এরা কার্যকর। টি-সেলই বি-সেলকে নিয়ন্ত্রণ করে।
এডাপ্টিভ ইমিউন রেসপন্সের অংশ হিসেবে দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে অ্যান্টিবডি তৈরি করে রোগজীবাণু দূর করে এবং মেমোরি টি এবং বি লিম্ফোসাইট তৈরির কাজটিও করে ফেলে যেন ভবিষ্যতে আক্রান্ত হলে দ্রুত কাজ করতে পারে।
ও দিকে বোনমেরো থেকে টি লিম্ফোসাইট বের হয়ে থাইমাস গ্ল্যান্ডে মেচিউর হবার পর নেইভ টি লিম্ফোসাইট (যে টি-সেল আগে কখনো রোগজীবাণুর মোকাবেলা করেনি) নাম ধারণ করে। এই নেইভ টি-সেল সারফেসে থাকে টি-সেল রিসেপ্টর বা টিসিআর নামক প্রোটিন। এই টিসিআর এর ভূমিকা রাত্রিতে টহলরত পুলিশের হাতে থাকা টর্চ লাইটের মতো। অন্য দিকে বি লিম্ফোসাইট বোনমেরোতেই ম্যাচিউর হয়ে টি লিম্ফোসাইটের মতোই বি-সেল রিসেপ্টর (বিসিআর) নামক টর্চলাইট হাতে রক্তে টহল দিতে থাকে। ভাইরাস বা অ্যান্টিজেন ঢোকার সাথে সাথে শরীরের ইমিউন সিস্টেমের নেইভ টি এবং বি লিম্ফোসাইটস যারা এই প্রথম অ্যান্টিজেনকে চিনে নিলো তারা রিঅ্যাকশন দেখায়। নেইভ টি লিম্ফোসাইট (যে টি লিম্ফোসাইটস ম্যাচিউর হয়ে সবে মাত্র রক্তে প্রবেশ করেছে এবং এখন পর্যন্ত কোনো রোগজীবাণুর মোকাবেলা করতে হয়নি) একটিভ হয়ে এর ইফেক্টর সাবসেট সিডি+৪, সিডি+৮ এবং রেগুলেটরি টি সেলে রূপান্তর ঘটে, পাশাপাশি টি মেমোরি সেলও তৈরি করে। অপর দিকে বি নেইভ লিম্ফোসাইট প্লাজমা সেলে রূপান্তর হয় এবং অ্যান্টিবডি তৈরি শুরু করে দেয় পাশাপাশি মেমোরি বি সেলও তৈরি করে এবং দশকের পর দশক বেঁচে থাকে। এখানে উল্লেখ্য যে নেইভ টি বা বি লিম্ফোসাইটকে কাজ শুরু করার পূর্বে অ্যান্টিজেন চিনে একটিভ হতে হয় কিন্তু পূর্ব থেকে তৈরি হওয়া মেমোরি সেল সরাসরি এবং দ্রুত ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ শুরু করে দিতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কর্তৃক এ পর্যন্ত ৮৫টি ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে।
মৌলিকভাবে ভ্যাকসিন চার প্রকার : হোল সেল ভ্যাকসিন (কিল্ড অথবা লাইভ এটেনিউয়েটেড), প্রোটিন সাব-ইউনিট ভ্যাকসিন, ভিরাল ভেক্টর ভ্যাকসিন এবং নিউক্লিক এসিড ভ্যাকসিন। এই চারটি মৌলিক ভ্যাকসিন থেকে অসংখ্য রকমের ভ্যাকসিনের উৎপত্তি।
লাইভ এটেনিউয়েটেড ভ্যাকসিন
জীবন্ত জীবাণু দিয়ে করা হয় যাকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় এমন দুর্বল করা হয় যে শরীরে ঢোকালে রোগ সৃষ্টি করতে পারবে না কিন্তু এর উপস্থিতিতে ইমিউন রেসপন্স হবে।

কিভাবে লাইভ এটেনিউয়েটেড ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলো
এ ধরনের ভ্যাকসিনের গোড়াপত্তন ডা: জেনার সাহেবের স্মলপক্স আবিষ্কারের মধ্যেই নিহিত ছিল। গরুর পক্স যা গরুকেও আক্রান্ত করে এবং মানুষকেও আক্রান্ত করে। মানুষকে আক্রান্ত করলেও তা খুব মৃদু আকারে আক্রান্ত করে। কিন্তু মৃদু আক্রান্তের কারণেই মানুষের শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় তা দিয়ে আসল গুটিবসন্ত প্রতিরোধ হয়ে যায়। এই ধারণা থেকেই বিজ্ঞানীরা লাইভ ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ক্লু পেয়ে যায়। এ কথা মাথায় রেখেই ১৯৫৪ সালে মিসলস ভ্যাকসিন আবিষ্কারের উদ্যোগ নেয়। আর সে উদ্যোগ হলো হাম রোগে আক্রান্ত একটি শিশুর শরীর থেকে মিসলস ভাইরাস আলাদা করে তাকে এক নাগাড়ে দশ বছর টিসু কালচার করতে করতে এমন দুর্বল পর্যায়ে চলে আসে যে তা দিয়ে রোগসৃষ্টি হবে না কিন্তু উপস্থিতির কারণে প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি তৈরি হবে। এ জন্যই এ ভাবে অরিজিনাল ভাইরাসকে হত্যা না করে এবং যেকোনো ভাবে দুর্বল করে ভ্যাকসিন উপযোগী করাকেই লাইভ এটেনিউয়েটেড ভ্যাকসিন বলে। এখানে যেহেতু জীবিত কিন্তু দুর্বল পুরো জীবাণু ব্যবহার করা হয় সেহেতু এই সকল ভ্যাকসিন মুখে বা ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে শরীরে ঢোকার সাথে সাথে মাল্টিপ্লাই হতে থাকে। মাল্টিপ্লাইড দুর্বল জীবাণুর উপস্থিতির কারণে আমাদের শরীরের ইমিউন সিস্টেম এক ধরনের প্রতিরোধ রিঅ্যাকশন দেখায়। এই অর্জিত প্রতিরোধ রিঅ্যাকশনে লিম্ফোসাইটস রূপান্তরিত হয় ইফেক্টর এবং মেমোরি টি-সেলে। সাধারণ অবস্থায় যখন শরীরে কোনো রোগজীবাণু থাকে না তখন টি এবং বি-লিম্ফোসাইটস নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রক্তে টহল দিতে থাকে। টহলরত অবস্থায় টি এবং বি-লিম্ফোসাইটের সারফেসে থাকা প্রোটিন যথাক্রমে টি-সেল রিসেপ্টর এবং বি-সেল রিসেপ্টর দ্বারা রোগজীবাণুর উপস্থিতির সন্ধান পাওয়ার সাথে সাথেই ইমিউন সেল তথা টি এবং বি-লিম্ফোসাইটস সক্রিয় হয়ে যায়। টি-লিম্ফোসাইটস সক্রিয় হয়ে ইফেক্টর টি-সেল (যেমন সাইটোটক্সিক টি-সেল, হেল্পার টি-সেল) এবং মেমোরি টি-সেলে রূপান্তর হয়। তেমনিভাবে বি- সেলও সক্রিয় হয়ে ইফেক্টর বি-সেল (যেমন প্লাজমা সেল) এবং মেমোরি বি-সেলে রূপান্তর হয়। টি এবং বি লিম্ফোসাইটের ইফেক্টর সেলগুলো তাৎক্ষণিকভাবে কাজ শুরু করে দেয় আর মেমোরি টি এবং বি-লিম্ফোসাইটস বছরের পর বেঁচে থাকতে পারে। বি-সেল সক্রিয় হয়ে যে ইফেক্টর প্লাজমা সেলে রূপান্তর হয় সেই প্লাজমা সেলই রোগ প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি তৈরি করে। বি-সেল টি-সেলের সহযোগিতায় অনেক দিন বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু মেমোরি বি-সেল টি-সেলের সহযোগিতা ছাড়াই দশকের পর দশক বেঁচে থাকতে পারে। লাইভ ভ্যাকসিন শক্তিশালী অ্যান্টিবডি টাইটার তৈরি করে এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়। ইঞ্জেক্টেবল ফর্মে অনেক ক্ষেত্রেই এক ডোজ দিলেই হয় কিন্তু মুখে খাওয়ার ভ্যাকসিন হলে কিংবা কম্বাইন্ড ভ্যাকসিন হলে দুই ডোজ দিতে হয়। এই ভ্যাকসিন শরীরে প্রবেশ করার পর ন্যাচারাল ইনফেকশনের মতোই মাইল্ড ফর্মে ইনফেকশন হয় এবং শক্তিশালী ইমিউন রেসপন্স হয়। ইমিউনো কম্প্রোমাইজড, গর্ভবতী মা এবং অতিশয় দুর্বল বৃদ্ধদের এই টিকা প্রয়োগে অনেক সময় মারাত্মক ইনফেকশন হয়। এই জন্য করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে লাইভ ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হয় না। এ ছাড়াও লাইভ ভ্যাকসিন নিম্ন তাপমাত্রায় স্টোর করতে হয়। যার শরীরে লাইভ ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হবে, তার রক্তে যদি মায়ের কাছ থেকে বা অন্য কোনোভাবে সার্কুলেটিং অ্যান্টিবডি থাকে তাহলে লাইভ ভ্যাকসিনে কাজ নাও হতে পারে। লাইভ ভ্যাকসিন হিউমোরাল এবং সেল মেডিয়েটেড-এই দুই ধরনের ইমিউনিটি তৈরি করতে পারে। মানুষের নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় এনে করোনার কোনো লাইভ ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি।
কিল্ড বা ইনঅ্যাক্টিভেটেড ভ্যাকসিন
এটি একটি ইনঅ্যাক্টিভেটেড মৃত পুরো ভাইরাস ভ্যাকসিন শরীরে যার উপস্থিতির কারণে ইমিউন সিস্টেমকে স্পেসিফিক অ্যান্টিবডি তৈরিতে স্টিমুলেট করে কিন্তু র্যাপ্লিকেট করতে পারে না। ফলে ইমিউনো কম্প্রোমাইজড রোগীদেরও ইনঅ্যাক্টিভেটেড ভ্যাকসিন দেয়া যায়। এই ভ্যাকসিন সার্কুলেটিং অ্যান্টিবডি দ্বারা কম প্রভাবিত হয়। ইনঅ্যাক্টিভেটেড ভ্যাকসিন প্রথম আবিষ্কার হয় ১৮৮০ সালে। ১৮৯৬ সালে আবিষ্কৃত হয় কলেরা ভ্যাকসিন। তাপ, কেমিক্যালস এবং রেডিয়েশনের মাধ্যমে জীবিত জীবাণুকে মেরে ফেলা হয়। সুতরাং এর প্যাথজেনিসিটি বা রোগ সৃষ্টি করার ক্ষমতা রহিত করা হয় কিন্তু এর অ্যান্টিজেনিসিটি ঠিক রাখা হয়। এ ধরনের ভ্যাকসিন দুর্বল মানের এবং কম স্থায়িত্বের অধিকারী হয়। এ ধরনের ভ্যাকসিনে সেল মেডিয়েটেড ইমিউনিটি হয় না বললেই চলে। ফলে দুই থেকে তিনটি ডোজ দেয়ার পরেও বুস্টার ডোজ দিতে হয়।
ইনঅ্যাক্টিভেটেড ভ্যাকসিন আবার কয়েক প্রকার : যেমন হোল সেল ইনঅ্যাক্টিভেটেড ভ্যাকসিন, সাব-ইউনিট প্রোটিন ভ্যাকসিন, কঞ্জুগেট সাব-ইউনিট প্রোটিন ভ্যাকসিন। আরেক ধরনের ভ্যাকসিন আছে যাদেরকে পিউর পলিসেকারাইড ভ্যাকসিন বলে। এটি হলো পিউর পলিসেকারাইড বি-সেল ডিপেন্ডেন্ট কিন্তু টি-সেল ইন্ডিপেন্ডেন্ট ভ্যাকসিন যা টি-হেল্পার সেলের সহযোগিতা ছাড়াই বি-সেলকে অ্যান্টিবডি প্রোডাকশনে উদ্বুদ্ধ করে। এখানে অ্যান্টিজেন হিসেবে ভাইরাসের প্রোটিন অংশ বা পলিসেকারাইড বা উভয়টাই ব্যবহার করা হয়।
ভাইরাসের প্রোটিন অংশকে কেমিক্যালি একটি পলিসেকারাইডের সাথে সংযুক্ত করে কঞ্জুগেশন প্রক্রিয়ায় কঞ্জুগেট সাব-ইউনিট ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়। ফলে এ ধরনের ভ্যাকসিন লং লাস্টিং হয়। সাইনোফার্ম, তুর্কোভ্যাক, হোল সেল পার্টোসিস, পোলিও, ইনফ্লুয়েঞ্জা, জাপানিজ এনকেফালাইটিস, হেপাটাইটিস-এ এবং র্যাবিজ ভ্যাকসিন।
টক্সয়েড ভ্যাকসিন : ১৯২৩ সালে ডিপথেরিয়া ভ্যাকসিন এবং টিটেনাস ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়।
সাব-ইউনিট ভ্যাকসিন : পিউরিফাইড প্রোটিন, রিকম্বিনেন্ট প্রোটিন, পলিসেকারাইড এবং পেপ্টাইড ভ্যাকসিন। এই ভ্যাকসিনগুলোর উদাহরণ হলো এনথ্রাক্স, (১৯৭০ সাল) পার্টোসিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হেপাটাইটিস বি, মেনিংগোকক্কাল, নিউমোকক্কাল, টাইফয়েড এবং হেপাটাইটিস এ ভ্যাকসিন।

ভাইরাস লাইক পার্টিকেল ভ্যাকসিন : এই ভ্যাকসিন তৈরিতে একটি নির্দিষ্ট ভাইরাসের শুধু প্রোটিনের অ্যান্টিজেনকে কাজে লাগিয়ে আর্টিফিসিয়াল ভ্যাকসিন তৈরি করে। যেমন হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস ভ্যাকসিন এবং হেপাটাইটিস বি ভাইরাস ভ্যাকসিন (১৯৮৬ সাল) আউটার মেমব্রেন ভেসিকল ভ্যাকসিন, যেমন গ্রুপ বি মেনিংগোকক্কাল ভ্যাকসিন (১৯৮৭ সাল)
প্রোটিন-পলিসেকারাইড কনজুগেট ভ্যাকসিন : সাধারণত প্রোটিন ভ্যাকসিন দুর্বল মানের ভ্যাকসিন। তাই ভ্যাকসিনকে শক্তিশালী করার নিমিত্তে কঞ্জুগেট ব্যবহার করা হয়। হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি, নিউমোকক্কাল, মেনিংগোকক্কাল এবং টাইফয়েড ভ্যাকসিন।

ভাইরাল ভ্যাক্টর ভ্যাকসিন : এখানে প্যাথজেনিক জেনেটিক মেটারিয়ালকে এবং অপেক্ষাকৃত কম প্যাথজেনিক একটি ডিএনএ ভাইরাসের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া হয়। যেমন ইবোলা ভাইরাস ভ্যাকসিন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন, স্পুটনিক-ভি এবং জনশন অ্যান্ড জনশন ভ্যাকসিন।
নিউক্লিক এসিড ভ্যাকসিন : লিপিড ন্যানোপার্টিকেলের ভেতর মেসেঞ্জার আরএনএকে ঢুকিয়ে দেয়া হয়।
ব্যাক্টেরিয়াল ভ্যাক্টর ভ্যাকসিন এবং অ্যান্টিজেন প্রেজেন্টিং সেল ভ্যাকসিন এক্সপেরিমেন্টাল পর্যায়ে রয়েছে।

কিছু ভ্যাকসিন রিকম্বিন্যান্ট ডিএনএ টেকনোলজি ব্যবহার করে তৈরি করে। যখন একটি নিউক্লিক এসিড বা জেনমের এক অংশ আরেকটি নিউক্লিক এসিড বা জেনমের আরেক অংশের সাথে মিশিয়ে নতুন একটি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ভ্যাকসিন তৈরি হয়, তাকেই রিকম্বিন্যান্ট ভ্যাকসিন বলে।
ব্রিটেনে একটি ভ্যাকসিন আছে যাতে জেনেটিকালি মডিফাইড অর্গানিজম অ্যান্টিজেন হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/635018