৭ জানুয়ারি ২০২২, শুক্রবার, ১২:৪২

বুস্টার ডোজ টিকা নিতে গিয়েছিলাম

-ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের ৩য় ডোজ নিতে গিয়েছিলাম জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে মঙ্গলবার দুপুর একটায়। টিকা কেন্দ্র মোটামুটি ফাঁকা। প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজও সেখানেই নিয়েছিলাম। তখন পরিবেশ পেয়েছিলাম। এবার গিয়ে তার বিপরীত চিত্র দেখলাম। প্রথম দুটি ডোজ নেয়ার সময় গিজগিজে ভিড় ছিল। কেন্দ্রে যেতেই এগিয়ে এসেছিলেন তরুণ-তরুণী স্বেচ্ছাসেবীরা। কোন ডেস্কে যেতে হবে , সেখানে নিয়ে যাচ্ছিলেন তারাই। তারপর রেজিস্ট্রেশন। শেষমেষ তারা একেবারে টিকা দানকারী নার্সের কাছে পৌঁছে দিচ্ছিলেন। এতে টিকা গ্রহীতারা খুশি মনে টিকা নিয়ে ফিরছিলেন। আমি নিজেও এ ব্যবস্থাপনায় খুশি হয়েছিলাম। ভিড় থাকলেও নির্ঝঞ্ঝাটে টিকা নিয়ে ফিরে এসেছিলাম। ফিরে এসে স্বজন-বন্ধুদের কাছে টিকা ব্যবস্থাপনার তারিফ করেছিলাম।

টিকা নিয়ে ঝামেলা কম হয়নি। এখনও প্রায় অর্ধেক মানুষ প্রথম ডোজ টিকাই পাননি। মঙ্গলবারও দেখলাম, অনেকে প্রথম ডোজ টিকা নিতে এসেছেন। কেউ বা দ্বিতীয় ডোজ। কিন্তু এবারে দেখলাম ভিন্ন চিত্র। হেল্প ডেস্কগুলো খালি। যারা টিকা নিতে এসেছেন তারা এ ডেস্ক থেকে ও ডেস্কে দৌড়াদৌড়ি করছেন। স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যাও খুব কম। যারা ছিলেন, তারাও দায়িত্ব পালনে সিরিয়াস ছিলেন না। স্লিপগুলো হাতে নিয়ে কেবলই নাড়াচাড়া করছিলেন। কেউ কেউ বলছিলেন, কাগজ নাড়াচাড়া করছেন কেন, টিকা নেবার ব্যবস্থা করে দেন। প্রথম ডেস্কের তরুণ কর্মী বেশ রাগত স্বরে বললেন, দেখে লাইনে দাঁড়াতে পারে না? ঐ তো দেওয়ালে লেখা আছে কোথায় কাকে দাঁড়াতে হবে, চোখে দেখেন না। তারপর তিনি স্লিপগুলো পাশের টেবিলে পাঠালেন। সেখানে আবার নাড়াচাড়া। ইতিমধ্যে হেল্প ডেস্কের প্রত্যেকে ঘড়ি দেখা শুরু করলেন। একজন বললেন, দুটো বেজে যাচ্ছে, আজ আর হবে না।

টিকা নিতে আগতদের মধ্যে আমিও ছিলাম সবচেয়ে বয়স্ক। ফলে দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তাদের কথা হলো, দু’জনকে বাদ দিতে হবে। কিন্তু প্রত্যেকেই যার যার অসুবিধার কথা তুলে ধরছিলেন। বয়স্ক মানুষ নিয়ে এসেছেন। আর একদিন আসা বেশ কষ্টসাধ্য। স্বেচ্ছাসেবীরা তা মানছিলেন না।

কিন্তু আমি ঐ ছয়জনের রহস্য বুঝতে পারছিলাম না। একজন স্বেচ্ছাসেবীকে জিজ্ঞেস করলাম। ছয়জনের বেশি লোকের কেন টিকা দেওয়া যাবে না। তিনি জানালেন, একটা অ্যাম্পুলে ৬ জনকে টিকা দেওয়া যায়। আর একটা অ্যাম্পুল যে ভাঙব, লোক তো নেই। সুতরাং আপনারা আগামী কাল সকালে আসেন। অথবা কেউ একজন আজকে চলে যান। তাতে রাজি ছিল না কেউ। আমি বললাম, অ্যাম্পুল ভাঙন। আরও লোক তো আসতে পারে। তাদের জবাব, লোক সামনে এলেই তো হবে না। টাইমতো শেষ। আমি তাকে এসএমএসটা দেখিয়ে বললাম, এখানে তো সময় বেঁধে দেওয়ার কথা বলা হয়নি। তা হলে আপনারা এত তাড়াহুড়া করছেন কেন। তাদের বক্তব্য, আমাদের ডিউটিতো দুইটায় শেষ। ইতিমধ্যে দুইটা পাঁচ বেজে গেছে।

ততক্ষণে এক এক করে আরও পাঁচজন লোক এসে হাজির হলেন। যাই হোক ছয় দ্বিগুণে বারো হলো। কিন্তু টাইম যে শেষ। সকলেই তাদের অনুরোধ করলেন যে, আমরা যখন এসে গেছি, পাঁচ দশ মিনিট দেরি হলেও আমাদের দয়া করে টিকা দিয়ে দিন। ফলে একটু হৈচৈ বেঁধে গেল।

এ সময় সেখানে হাজির হলেন কেন্দ্রের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী। তিনি গলা চড়িয়ে বললেন, এখনও যদি টিকা দেওয়া বন্ধ করি, তা হলেও আমাদের বাসায় যেতে ৪টা সাড়ে চারটা বেজে যাবে। সেই সকাল সাতটায় বাসা থেকে বের হয়েছি। আটটা থেকে ডিউটিতে আছি। আপনারা সকালে আসেন না কেন। এ কথার জবাব আমরা কেউ দেইনি। শেষ পর্যন্ত সকলের অনুরোধে নিতান্তই দয়া পরবশ হয়ে আমাদের বারোজনকে টিকা দিয়ে দেওয়া হল। এ কর্মকর্তা বা কর্মচারী চিৎকার করে বলছিলেন, এই গেট বন্ধ করো, আর যেন কেউ ঢুকতে না পারে।

আমার মতো প্রবীণ নাগরিকদের জন্য এ অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। মানুষ বাঁচাতে, সমাজ বাঁচাতে, দেশের অর্থনীতি বাঁচাতে দেশেই টিকাদান কর্মসূচি জোরদার করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। বলা হচ্ছে, একজন মানুষও টিকানেয়ার আওতার বাইরে থাকবে না। ইতিমধ্যে স্কুল শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। সর্বস্তরের মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা হচ্ছে, সেখানে ঠুনকো অজুহাতে টিকা দান কর্মসূচিতে এই অসহযোগিতা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে বাধ্য।

দেশে করোনা প্রতিরোধের নানা রকম আয়োজন চলছে। ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ এখন জনপ্রিয় স্লোগান। টিকা তার একধাপ ওপরে। যারা টিকা নিয়েছে, তাদের করোনা আক্রান্তের সংখ্যা কম। টিকা গ্রহণকারীদের মধ্যে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যাও নগণ্য। এ রকম পরিস্থিতিতে যদি টিকা প্রদানে অনীহা বা অসহযোগিতার প্রশ্ন ওঠে, তাহলে সেটা হবে দুর্ভাগ্যজনক।

আমি তো শুধু একটি টিকা দান কেন্দ্রের চিত্র তুলে ধরলাম। হয়ত সর্বত্র একই চিত্র নয়। অন্যান্য কেন্দ্রে হয়ত সহযোগিতাই মুখ্য। হয়ত এর বিপরীত চিত্র আছে। কিন্তু টিকা দান কর্মসূচি সফল করতে, করোনা মোকাবিলা করতে সর্বত্র দরকার সেবার মনোভাব ও সহযোগিতার মানসিকতা। যাতে টিকা নিতে এসে কাউকে ফিরে যেতে না হয়।

একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, টিকা এবং মাস্কই করোনা প্রতিরোধের কার্যকর উপায়। তার সঙ্গে আছে হাত ধোয়া ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা। সারা পৃথিবীতে করোনার তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। ইউরোপ-আমিরকায় আবার ছড়িয়ে পড়েছে করোনা। আমাদের চেষ্টা করতে হবে। বাংলাদেশে যেন এ ঢেউ আঘাত না হানে। তার জন্য টিকা মাস্কের পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিরোধ ব্যবস্থাও জোরদার করতে হবে। আশা করি, টিকা কর্মসূচি সফল করার সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এখানে দরকার সহযোগিতা, খামখেয়ালি নয়।

https://dailysangram.info/post/476727