৫ জানুয়ারি ২০২২, বুধবার, ৪:০৯

ফ্লাইওভার নির্মাণে নৈরাজ্য

ইবনে নূরুল হুদা : যানজট নিরসন ও যোগযোগ ব্যবস্থাকে গতিশীল করার জন্য শুধু আমাদের দেশে নয় বরং বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই নবতর সংস্করণ হচ্ছে ‘ফ্লাইওভার’ বা ‘উড়াল সেতু’। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ফ্লাইওভারের জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করা গেলেও ১৮৪২ সালে ইংল্যান্ডের ‘নরউড জংশন’ রেলওয়ে স্টেশনে বিশ্বের প্রথম উড়ালসেতুর যাত্রা শুরু হয়। দীর্ঘকালের পরিক্রমায় তা এখন অনেকটা বিস্তৃতি লাভ করেছে। আমাদের দেশও তা থেকে আলাদা নয়।

বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ। জনসংখ্যা অনুসারে আমাদের দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা কাক্সিক্ষত মানে উন্নীত করা সম্ভব হয়নি। ভঙ্গুর অর্থনীতি, সেকেলে যানবাহন, মানহীন ও অপর্যাপ্ত রাস্তাঘাট এবং অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা এমনিতেই বিপর্যস্ত। উপর্যুপরি অধিক জনসংখ্যার কারণে যানজটও নিত্যসঙ্গী। আর এই যানজট সমস্যা সমাধানের জন্য বর্তমান শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে আমাদের দেশে ফ্লাইওভার প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা নগরীতে। যদিও তা আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে তা খুবই ব্যয়বহুল। কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদেই অনেকটা বাধ্য হয়েই এই প্রকল্প গ্রহণ করতে হয়েছে আমাদেরকে।

মূলত, রাজধানীর ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থায় স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠার জন্য ফ্লাইওভার নির্মাণে বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এর সুফলও পাওয়া গেছে অনেকটা। কিন্তু অতীব পরিতাপের বিষয় হলো গৃহীত কোন প্রকল্পই নির্ধারিত মেয়াদে ও বরাদ্দকৃত অর্থে শেষ করা সম্ভব হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পার হয়েছে বেঁধে দেয়া সময়ের দ্বিগুণ কিংবা তারও বেশি। কাজের সময় বাড়ানোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনাকাক্সিক্ষত ও অযৌক্তিকভাবে বেড়েছে প্রকল্প ব্যয়ও। আমাদের দেশের জীবনযাত্রার ব্যয় অন্যান্য দেশের তুলনায় কম হলেও উড়াল সেতু নির্মাণ ব্যয়ে আমরা ইতোমধ্যে রেকর্ড ভঙ্গ করে ফেলেছি। এমনকি তা ছাড়িয়ে গেছে ভারত, মালয়েশিয়া, চীনকেও। এসব দেশে ফ্লাইওভার নির্মাণে প্রতি কিলোমিটার যে খরচ হয়, আমাদের দেশে তার চেয়ে দুই থেকে ছয় গুণ পর্যন্ত বেশি হচ্ছে।

ভারত, মালয়েশিয়া ও চীনের কয়েকটি ফ্লাইওভার নির্মাণ ব্যয় পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রতি কিলোমিটারে ফ্লাইওভার নির্মাণে তাদের ব্যয় হচ্ছে গড়ে ৫০ কোটি টাকা। সেখানে বাংলাদেশে ১০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার বেশি খরচ হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করে বাংলাদেশে ব্যয়ের পার্থক্য প্রায় এমনই দৃশ্যমান হয়েছে। যা আমাদের ভঙ্গুর অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাত্রাতিরিক্ত দুর্নীতি, লুটপাট, অনিয়ম, অপরিকল্পিত নগরায়ন, জমি অধিগ্রহণে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া, প্রকল্পের সমীক্ষা যথাযথভাবে শেষ না করেই উন্নয়ন কাজে হাত দেয়া অতিমাত্রায় ব্যয় বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। বিদেশ থেকে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় উচ্চমূল্যে নির্মাণসামগ্রী আমদানীও ব্যয়বৃদ্ধিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। অনিয়ম হচ্ছে অবকাঠামো নির্মাণে ঠিকাদার ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগেও। প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশি দক্ষ প্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠায় বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হচ্ছে। ফলে অনাকাক্সিক্ষতভাবে ও অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে নির্মাণ ব্যয়।

সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা। অথচ, সরকার চাইলেই তা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নির্মাণ ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু জবাবদিহিতার অভাব, সুশাসনে বিচ্যুতি, গণতান্ত্রিক মানসিকতার অভাব ও লাগামহীন স্বেচ্ছাচারিতার কারণেই সরকারও মহল বিশেষের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। যদিও সরকার সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, ভারত, মালয়েশিয়া, চীনসহ আশপাশের দেশের চেয়ে বাংলাদেশে ফ্লাইওভারের নির্মাণ ব্যয় অস্বাবিকভাবে বেশি হওয়ার কারণ উল্লেখ করা হয় তা সর্বাংশে গ্রহণ নয়। তাদের দাবি, নানা কারণে এমন অস্বাভাবিক ব্যয় হয়ে থাকে। প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়া। দ্বিগুণ, তিনগুণ সময়েও বেশির ভাগ ফ্লাইওভার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। কিন্তু কেন প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয় বা এর পেছনে যে দুর্নীতি, অনিয়ম ও লুটপাটের সম্পর্ক রয়েছে তা তারা সযত্নে এড়িয়ে যান।

তারা আরও দাবি করেন যে, ঢাকা একটি অপরিকল্পিত ও ঘনবসতিপূর্ণ নগরী। সঙ্গত কারণেই এই নগরীতে ফ্লাইওভার নির্মাণের জন্য আগে কোনো জায়গা বরাদ্দ রাখা হয়নি। এজন্য নতুন করে বিভিন্ন সংস্থার সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে পুনঃস্থাপন করতে হয়। এতে ব্যয় বেড়ে যায়। আর কাজ শুরুর আগে সমীক্ষায় ত্রুটি থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। এতে কাজ শুরু ও বাস্তবায়নে দেরি হয়। আর প্রকল্পের সময় বাড়লে ব্যয়ও বাড়ে। তাদের এ আংশিক সত্য হলেও পুরোপুরি সত্য নয়।

মূলত, পরিকল্পনা পর্যায় থেকেই দেশে ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্পের গলদ শুরু হয়। যানজট নিরসনের কথা বলে ঢাকায় নেয়া পরিকল্পনায় ব্যয় ধরা হয় আকাশচুম্বী। যেনতেন সমীক্ষার ওপর প্রকল্প প্রণয়ন শেষে, তড়িঘড়ি শুরু হয় কাজ। মধ্যস্বত্বভোগীদের যোগসাজসে ঠিকাদারের সময়ক্ষেপণের সংস্কৃতি এজন্য কম দায়ী নয়। সঙ্গত কারণেই নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হয় না। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সুবিধাভোগীদের কমিশন বাণিজ্য, ঢাকায় অপরিকল্পিত পরিষেবা লাইনে স্থানান্তরে সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি এ অবস্থার তৈরি হয়েছে। এ সুযোগ নিয়ে থাকে প্রকৌশলী ও ঠিকাদারদের একটি অংশ। ওতপেতে থাকে মধ্যস্বত্বভোগীরাও। অথচ বাংলাদেশের শ্রমিক ও নির্মাণ সামগ্রীর ব্যয় তুলনামূলক কম। এ কারণে খরচ কম হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে এর প্রতিফলন কোন প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ফ্লাইওভারের নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধির যৌক্তিক অনেক কারণ রয়েছে। ক্ষতিপূরণ দেয়া এর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ। জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে তিনগুণ ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া দুর্নীতিও বড় একটি কারণ। দেশে পরামর্শক থাকা সত্ত্বেও চুক্তির শর্ত দেখিয়ে বেশি ব্যয়ে বিদেশি পরামর্শক নেয়া হচ্ছে। ফলে নির্মাণ ব্যয় এখন রেকর্ড ভঙ্গ করে ফেলেছে। আর এসব কারণ চিহ্নিত করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে পরিস্থিতি সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব হলেও বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টরা বরাবরই উদাসীন।

মূলত, দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশে ফ্লাইওভার নির্মাণের ব্যয় বেশি হচ্ছে বলেই মনে করছেন নির্মাণ বিশেষজ্ঞরা। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর যদি দেশ ও জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা থাকতো তাহলে নির্মাণ ব্যয়ে এমন নৈরাজ্যের সৃষ্টি হতো না। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ৮দশমিক ১৪ কিলোমিটারের কোলকাতার পরমা ফ্লাইওভারের নির্মাণে খরচ হয়েছে ৩৯২ কোটি টাকা। প্রতি কিলোমিটারে খরচ হয়েছে ৪৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনে ১০০ কিলোমিটার ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে। এসব ফ্লাইওভার নির্মাণে প্রতি কিলোমিটার খরচ হয়েছে ৫০ কোটি টাকা। সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাঁচটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। এতে কিলোমিটারপ্রতি খরচ হয়েছে ৫৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা। প্রাপ্ত তথ্যমতে, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল (এলজিইডি) অধিদপ্তর মগবাজার-মৌচাক সমন্বিত ফ্লাইওভার প্রকল্প নির্মাণ করেছে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এ ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় কয়েক দফা সময় ও ব্যয় বাড়ানো হয়। এ ফ্লাইওভারের কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয়েছে ১৩৫ কোটি টাকা। যা খুবই অস্বাভাবিক।

এ ছাড়া মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের নির্মাণ ব্যয়ও অনেক বেশি। শুরুতে চার কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৪৭ কোটি টাকা। পরে দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে করা হয় ১১ দশমিক ৭ কিলোমিটার। শেষ পর্যন্ত ২১০৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এতে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয়েছে ১৮০ কোটি টাকা। ২০১০ সালের জুনে কাজ শুরু করে তিন দফা সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে ২০১৩ সালের ১১ অক্টোবর এটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়। তবে ব্যয়ের প্রতিযোগিতায় মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার নির্মাণ খরচ ছাড়িয়ে যাচ্ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের নির্মাণ খরচ। নির্মাণ শেষে কিলোমিটারপ্রতি এ প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় চিন্তা করা হচ্ছে ৩১৬ কোটি টাকা বা তার চেয়েও বেশি।

এ ছাড়া রাজউকের তত্ত্বাবধানে নির্মিত কুড়িল ফ্লাইওভার নির্মাণে প্রতি কিলোমিটার খরচ হয়েছে ৯০ কোটি টাকা। দুই কিলোমিটার সংযোগ সড়ক ও ৩ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ কুড়িল ফ্লাইওভার নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছে ৩০৬ কোটি টাকা। আর চার লেনবিশিষ্ট মিরপুর-বিমানবন্দর সড়কে জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভারে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয়েছে ১০৫ কোটি টাকা। মহাজোট সরকারের সময় চালু হওয়া এক কিলোমিটার দীর্ঘ তেজগাঁও ফ্লাইওভার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। ২০০৫ সালে নির্মিত ১ দশমিক ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ খিলগাঁও ফ্লাইওভার নির্মাণে সব মিলে ব্যয় হয়েছিল ৭৬ কোটি টাকা। এক কিলোমিটারেরও কম দৈর্ঘ্যরে বিজয় স্মরণী-তেজগাঁও ফ্লাইওভার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। অথচ আমাদের দেশে সস্তা শ্রম হওয়া সত্ত্বেও অন্যান্য দেশের তুলনায় ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেশি।

শুধু ফ্লাইওভার নয় বরং আমাদের দেশের সরকারি সকল উন্নয়ন প্রকল্পই শনির আছরে পড়েছে। রাস্তা-ঘাট, সরকারি স্থাপনা এমনকি শিক্ষাপ্রকল্পগুলোও দুর্নীতিও ও অনিয়মের বাইরে থাকতে পারেনি। তাই সরকারি যেকোন উন্নয়ন প্রকল্পকে অনতিবিলম্বে জবাবদিহিতার আওতায় আনা দরকার। দুর্নীতিকে আনতে হবে শূন্য সহনশীলতায়।

আর এখনই দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা প্রতিরোধ করা না গেলে সকল ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয় ব্যয় শুধুই বাড়বে। কিন্তু দেশের মানুষ বঞ্চিত হবেন কাক্সিক্ষত রাষ্ট্রীয় সেবা থেকে।

https://dailysangram.info/post/476473