দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে সোমবার টিসিবির পণ্য কেনে মানুষ। রাজধানীর শনিরআখড়া থেকে তোলা
৪ জানুয়ারি ২০২২, মঙ্গলবার, ৬:২৯

টিসিবির ট্রাক দেখলেই ক্রেতাদের হুড়োহুড়ি

পণ্য না পেয়ে অনেকে ফিরছেন খালি হাতে

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাক থেকে দুই কেজি করে সয়াবিন তেল, চিনি, ডাল ও পেঁয়াজ কিনতে পারেন একজন ক্রেতা। সাশ্রয়ী দরে সব পণ্য কিনতে লাগে ৫১০ টাকা। কিন্তু একই পণ্য যে কোনো খুচরা দোকান থেকে কিনতে গেলে গুনতে হয় ৭৪০ থেকে ৭৫০ টাকা। সে হিসেবে টিসিবির পণ্য নিলে একজন ক্রেতার সাশ্রয় হয় ২৩০ থেকে ২৪০ টাকা। তাই স্বাভাবিকভাবে রাস্তায় টিসিবির ট্রাক দেখলেই ছুটে যাচ্ছেন নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ।

অনেক স্থানে এই পণ্য পাওয়ার জন্য ক্রেতাদের রীতিমতো লড়াইয়ে নামতে হচ্ছে। পণ্য বহনকারী ট্রাকের লাইনে পেছনের দিকে থাকলে পণ্য না পেয়ে খালি হাতে ফিরতে হবে। তাই কে কার আগে দাঁড়াবে, তা নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। কোথাও কোথাও পণ্য নিয়ে হুড়োহুড়ি করতেও দেখা যায় ক্রেতাদের। রাজধানীর খামারবাড়ি, মালিবাগ, কারওয়ান বাজার, তেজগাঁওসহ টিসিবির পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে এমন কয়েকটি এলাকায় গতকাল সোমবার দেখা গেছে এমন ছবি।

পাঁচ দিন বন্ধ থাকার পর গতকাল থেকে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে সাশ্রয়ী দরে পণ্য বিক্রি কার্যক্রম ফের শুরু করেছে টিসিবি। ১১০ টাকায় এক লিটার সয়াবিন তেল, ৬০ টাকায় এক কেজি মোটা দানার মসুর ডাল, ৫৫ টাকায় এক কেজি চিনি ও ৩০ টাকা দরে আমদানি করা পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছে টিসিবির ট্রাকে। রাজধানীর বাজারে বর্তমানে এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬০ টাকা, প্রতি কেজি ডাল ৯০, চিনি ৫৫ ও পেঁয়াজ ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

রাজধানীর তেজগাঁওয়ের বাউলবাগ এলাকা থেকে ছাপড়া মসজিদের সামনে টিসিবির পণ্য কিনতে আসেন মাহমুদা বেগম রেণু। তার সামনে ক্রেতার সারি দীর্ঘ থাকায় তিনি লাইন থেকে বের হয়ে টিসিবির ট্রাকের পাশে গিয়ে পণ্য কেনার চেষ্টা করেন। এতেই বেধে যায় হট্টগোল। সারি ভেঙে বের হওয়ার কারণে পেছনে থাকা ক্রেতারা তাকে পণ্য কিনতে বাধা দেয়। বাগ্‌বিতণ্ডার একপর্যায়ে ওই ট্রাকের চালক শহিদুল পণ্য বিক্রি কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে তাদের শান্ত করেন।

এই ট্রাকের সারিতেই ছিলেন আলম নামের একজন ক্রেতা। দীর্ঘ সারির পেছনে থাকায় কোনো কিছু না পেয়েই তিনি রওনা দেন বাসার দিকে। তিনি সমকালকে বলেন, 'মাসখানেক আগে এখানে টিসিবির ট্রাক এসেছিল। তখনও ভিড় বেশি থাকায় শেষ পর্যন্ত পণ্য কিনতে পারিনি।'

গতকাল খামারবাড়ি এলাকায় বিটিসিএল অফিসের সামনে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে টিসিবির পণ্য বিক্রি করেছে ডিলার প্রতিষ্ঠান পল্লবীর কাজল স্টোর। বিকেল ৩টার দিকে সেখানে দেখা যায়, কয়েক লিটার তেল ছাড়া আর কোনো পণ্য নেই। চিনি, ডাল ও পেঁয়াজ আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। তখনও ট্রাকের পেছনে নারী-পুরুষ মিলে ৩৭ জন দাঁড়ানো। শেষ পর্যন্ত তাদের ১০ জন তেল কিনতে পেরেছেন। বাকিরা ফিরে গেছেন কোনো কিছু না পেয়ে। তাদের মধ্যে রাহেলা বেগমের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। টিসিবির পণ্য কেনার জন্য আসাদ গেট এলাকা থেকে আসেন তিনি। পণ্য না পেয়ে খালি হাতে ফেরা রাহেলা বেগম বলেন, 'এত দূর থেকে হেঁটে আসলাম, কিন্তু কিছুই পেলাম না। যাদের শক্তি-সামর্থ্য আছে, ঠেলাঠেলি করে লাইনে দাঁড়াতে পারেন, তারাই কিনতে পেরেছেন। অনেক চাকরিজীবীও টিসিবির জিনিস কিনছেন। অথচ গরিব মানুষ কিনতে পারছেন না।'

ওই ট্রাকের বিক্রয় প্রতিনিধি মোশারফ জানান, দুই-আড়াই ঘণ্টার মধ্যেই তাদের পণ্য বিক্রি শেষ। এর মধ্যে মাত্র ৫০ জন চিনি পেয়েছেন। ডিলারকে ১০০ কেজি চিনি দেওয়া হয়েছে টিসিবি থেকে। কারণ, ট্রাকপ্রতি যে হারে পণ্য বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ লাইনে দাঁড়ান। ফলে প্রতিদিনই বহু মানুষ পণ্য নিতে পারছেন না। তিন-চার মাস আগের চেয়ে ক্রেতার সংখ্যা এখন অনেক বেশি বলেও জানান তিনি।

টিসিবির ডিলার গেন্ডারিয়ার ইসলাম স্টোরের স্বত্বাধিকারী মো. ইসলাম সমকালকে বলেন, দিন দিন ক্রেতার সংখ্যা বাড়ছে। ছয় মাস আগের চেয়ে এখন ক্রেতা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। নিয়মিত চারটি পণ্যের বাইরেও মানুষ অন্য পণ্যের খোঁজ করে। কেউ কেউ চাল-আটাও কিনতে চায়। যদিও এগুলো টিসিবির মাধ্যমে বিক্রি হয় না।

টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবির সমকালকে বলেন, ট্রাকপ্রতি বরাদ্দ আগের চেয়ে ১০০ থেকে ২০০ লিটার তেল বাড়ানো হয়েছে। তবে চিনির পরিমাণ কিছুটা কমানো হয়েছে। কারণ, সামনে রমজান। তখন এসব পণ্যের চাহিদা আবার বেড়ে যাবে। কিছু কিছু জায়গায় একজন ক্রেতা দু'বার করে পণ্য কিনছেন। ফলে কেউ কেউ পাচ্ছেন না। গতকাল তিনি নিজেই মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি কলোনি ও শাহজাহানপুর বাজারে গিয়ে কয়েকজন ক্রেতাকে দু'বার পণ্য কিনতে দেখেছেন। এই অনিয়ম ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা দরকার বলে মনে করেন তিনি।

প্রতি শুক্রবার ছাড়া আগামী ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে টিসিবির বিক্রি কার্যক্রম। প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৪৫০টি ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে সারাদেশের সব মহানগর, জেলা ও উপজেলায় এই পণ্য বিক্রি কার্যক্রম চলবে। দৈনিক প্রতিটি ট্রাকের মাধ্যমে ১০০ থেকে ৫০০ কেজি চিনি, ৫০০ কেজি মসুর ডাল এবং ৩০০ থেকে ৫০০ কেজি পেঁয়াজ বিক্রি করা হচ্ছে। আর সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৭০০ লিটার করে।

https://www.samakal.com/todays-print-edition/tp-last-page/article/2201139205