৪ জানুয়ারি ২০২২, মঙ্গলবার, ৫:২০

বেগমপাড়া ও মানিলন্ডারিং প্রসঙ্গে

ড. মো. নূরুল আমিন : একই বিষয়ের ওপর একাধিকার লিখতে গেলে বিবেকে বাধে। তবে একটা কথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বা জবাবদিহিতামূলক সরকারের আমলে এ ধরনের ঘটনা কদাচিৎ ঘটে। মরহুম জেনারেল এরশাদকে আমরা অনেকেই স্বৈরাচার বলে থাকতাম। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার আমলে জবাবদিহিতার অনেকগুলো নজির ছিল। তার সরকারের সময় জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের ওপর পত্রপত্রিকায় যতগুলো প্রতিবেদন ছাপা হতো তার ওপর সরকারি অবস্থান ব্যাখ্যা করে প্রেস নোট বা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা ছাড়াও প্রতি সোমবার মন্ত্রী পরিষদের মিটিং-এ তা নিয়ে পর্যালোচনা হতো এবং ঘটনার সত্যতা বিচার করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো। কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমানে তা হয় না। সরকারের জবাবদিহিতা না থাকায় এই সংস্কৃতিটি বন্ধ হয়ে গেছে।

কানাডার বেগমপাড়া ও মানিলন্ডারিং-এর বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার জনগণ ও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গিয়ে কথাটি মনে পড়লো। বলাবাহুল্য বছর দু-এক আগে দেশের পত্রপত্রিকায় মানিলন্ডারিং ও অবৈধভাবে পাচারকৃত অর্থে কানাডায় বেগমপাড়া গড়ে তোলার ওপর একাধিক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেনের কিছু মন্তব্য ও পর্যবেক্ষণ জনমনে নানা প্রশ্ন তুলেছিল। তার মন্তব্যে তিনি বলেছিলেন যে, তার প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী বেগমপাড়ায় বাড়িঘর নির্মাণ করে বসবাসকারী ব্যক্তিদের মধ্যে সরকারি কর্মচারীরাই বেশি, এদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সংখ্যা কম। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্যের জের ধরে হাইকোর্টের দুই বিচারপতির একটি ডিভিশন বেঞ্চ যারা এই আবাসিক এলাকা গড়ে তুলেছেন তাদের নাম ঠিকানাসহ বিস্তারিত তথ্য ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে আদালতে পেশ করার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান, স্বরাষ্ট্র সচিব, পররাষ্ট্র সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফাইনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রতি রুল জারি করেছিলেন। বিচারপতি জনাব নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমদ সোহেল সমন্বয়ে এই ভার্চুয়াল বেঞ্চ গঠিত হয়েছিল।

এর আগে বিজ্ঞ আদালত দেশের অর্থে লালিত পালিত ও শিক্ষাদীক্ষা প্রাপ্ত ব্যক্তিগণ কর্তৃক বিদেশে অর্থ পাচারকে গর্হিত এবং তাদের জাতীয় বেঈমান বলে আখ্যায়িত করে তাদের শাস্তির আওতায় আনার পক্ষে মত প্রকাশ করেন।

কানাডার বেগমপাড়ার গল্পটি এখন মানুষের মুখে মুখে চলে আসছে। তবে উচ্চ আদালতের রুলিং-এর পর কি ঘটেছে তা আর জানা যায়নি। কিন্তু বেগমপাড়া বার বার খবরের শিরোনাম হচ্ছে।

বলা হচ্ছিল যে, কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতা ও ধুরন্ধর ব্যক্তি অবৈধ পন্থায় দেশে সম্পদ অর্জন করে তা রক্ষার জন্য বিদেশে পাচার করে কানাডা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর প্রভৃতিসহ ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রাসাদ তৈরি করে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেছেন। এদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা ও মন্ত্রীও রয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি করতে থাকলেও মানিলন্ডারিং বা অর্থপাচারের ব্যাপারে তদন্ত অনুষ্ঠান অথবা তা প্রতিরোধের ব্যাপারে সরকার বা সরকারের কোন এজেন্সি কোনও প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি।

বলাবাহুল্য, বিশ্ব ব্যাংকের ফাইনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৫ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৫,৮৭,৩১৭ কোটি টাকা পাচার হয়ে বিদেশে চলে গেছে। সরকারের অর্থবিভাগ বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন অথবা অন্য কোন এজেন্সি এই রিপোর্টের সত্যতা চ্যালেঞ্জ করেনি। ফলে ধরেই নেয়া যায় যে, রিপোর্ট বা অভিযোগটি সত্য। এখন এত দিন পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হঠাৎ বেগমপাড়ার গল্পটি কেন তুলে আনলেন এবং সরকারি কর্মচারীরা বিপুল হারে বেগমপাড়ার বাসিন্দা হয়েছেন বলে কেন পর্যবেক্ষণ দিলেন তা বুঝা মুশকিল। অভিজ্ঞ মহল এর মধ্যে শাসক দলের রাজনীতিবিদদের রক্ষার একটা দুরভিসন্ধি আছে বলে মনে করছেন। তাদের মতে, গত এক যুগে দেশে যারা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন, বৈধ-অবৈধ পন্থায় অজস্র অর্থ উপার্জন করেছেন তারা ক্ষমতাসীন দলের ও তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী। তাদের সাথে যোগসাজশ করে যারা উচ্ছিষ্ট পেয়েছেন তারা স্বল্পসংখ্যক সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তা মাত্র। এদের মধ্যে আছেন ব্যাংক-বীমা কোম্পানির কর্মকর্তা, মন্ত্রণালয় বিভাগ ও অধিদফতরের সচিব অধিকর্তা প্রমুখ।

বেগমপাড়া কখন গঠিত হয়েছে অথবা তার ভিত্তি কখন কে স্থাপন করেছেন তা এখনো রহস্যাবৃত। কানাডা থেকে যতদূর খোঁজ-খবর পাওয়া গেছে বেগমপাড়া বলে সেই দেশে সুনির্দিষ্ট কোন এলাকা নেই। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদ ও আমলাদের কেউ কেউ স্বনামে সম্পদ স্থানান্তর না করে বেগমদের নামে কানাডায় সম্পদ স্থানান্তর করেছেন এবং স্থায়ীভাবে সেখানে বসবাস করার উদ্দেশে তাদের পছন্দের শহরগুলোতে বাড়ি কিনেছেন অথবা তৈরি করেছেন। এমন নয় যে, Cluster আকারে তারা তা করেছেন। দেশ হিসেবে কানাডা বিশাল; আমাদের দেশে যেখানে প্রতি বর্গমাইলে সহস্রাধিক লোক বাস করে, কানাডায় সেখানে প্রতি বর্গমাইলে ৩/৪ জন বসবাস করে এমন শহরও সেখানে প্রচুর। বিভিন্ন দেশ থেকে সেখানে অভিবাসী আসছে। এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ থেকে সেই দেশে কেউ যদি মাইগ্রেন্ট করে থাকেন, করতে পারেন। এই প্রক্রিয়া সারা দুনিয়ায় আছে। প্রত্যেকটি মানুষই নিজের বা পরিবারের, সন্তান-সন্ততির ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের ন্যায় জনবহুল একটি দেশ থেকে কেউ যদি বিদেশে পরিভ্রমণ করেন তাতে দোষের কিছু নেই। বরং সরকারিভাবে তা উৎসাহিত করা উচিত। তবে তা কোন মতেই দেশকে বঞ্চিত করে অবৈধভাবে নয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে হাইকোর্ট বেঞ্চের স্বপ্রণোদিত রুল অভিনন্দনযোগ্য।

অবশ্য কানাডার বেগমপাড়া এখন শুধু কানাডার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তা এখন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াতেও সম্প্রসারিত হয়েছে।

উইকিপেডিয়ায় প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ব্যাপক আকারে বাংলাদেশীদের কানাডা পরিভ্রমণ প্রথম শুরু হয়েছিল ২০০৬ সালে। এই বছর ৪০১২ জন বাংলাদেশী নাগরিক বসবাসের উদ্দেশে কানাডা যান। ২০০৯ সালে এই সংখ্যা ২১০৬ জনে নেমে আসে। ২০১০ সালে এই সংখ্যা ৪৭২১ জনে উন্নীত হয়। এরপর থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পরিভ্রমণকারীদের সংখ্যা প্রতি বছর ২১০০ থেকে ৩৭০০ এর মধ্যে সীমিত থাকে। ফলে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কানাডায় বাংলাদেশী অভিবাসীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০,৯৫৬-তে। এরা সবাই সে দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেছে। এত্থেকে ধারণা করা যায় যে, বেগমপাড়ার ধারণাটি এই সময় কাঠামোর মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী অভিবাসীগণ কর্তৃক বাড়ি তৈরির জন্য কানাডীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার যে তথ্য দিয়েছেন তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ কর্তৃক অর্থপাচার বা মানি লন্ডারিংয়ের সম্ভাবনাকে দুর্বল করে দেয়। অর্থনৈতিক গোয়েন্দা রিপোর্টের সাথে তার পর্যবেক্ষণের মিল নেই। আগেই বলেছি বাংলাদেশ থেকে এক দশক সময়ের মধ্যে প্রায় ছয় লক্ষ কোটি টাকা পাচার হয়ে যাবার তথ্য প্রকাশিত হবার পরও সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা, তাদের শাস্তি প্রদান এবং এর সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি। এত্থেকে বোঝা যায় যে, সরকার এই দুর্নীতি ও অনিয়মের ব্যাপারে সহনশীল এবং এতে তাদের কোনো স্বার্থ রয়েছে। এ ব্যাপারে আমি আর কোনো মন্তব্য করতে চাই না। সরকারই তা ভালো জানেন। এ গেল কানাডার কথা। হাইকোর্ট এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য জানতে চেয়েছেন এবং সরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান ও এজেন্সির নিষ্ক্রিয়তাকে কেন তাদের অকার্যকারিতা ও অদক্ষতা হিসেবে বে আইনি ঘোষণা করা হবে না তার কারণ দর্শাতে বলেছেন, সরকার যেখানে নিষ্ক্রিয় উচ্চ আদালত সেখানে সক্রিয় হলে দেশবাসী আশার আলো দেখতে পাবে। মানি লন্ডারিং একটি অপরাধ ও বে আইনি কাজ। এর সাথে যারা জড়িত তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। এ কাজটি যাতে না হতে পারে তাও নিশ্চিত করা দরকার এবং এ জন্য বহু সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা অর্থপাচার প্রতিরোধের সাথে জড়িত তারা যদি তাদের দায়িত্ব পালন না করেন তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে না।

কানাডা ছাড়াও বাংলাদেশের মানিলন্ডারিং এর আরো কিছু গন্তব্য আছে এগুলো হচ্ছে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর। মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম এবং সিঙ্গাপুর বহু আগে থেকেই বাংলাদেশীদের আকৃষ্ট করেছে। সেখানে একটা নির্দিষ্ট অংকের বিনিয়োগের বিনিময়ে নাগরিকত্ব পাওয়া যায় এবং এই সুযোগে বহু বাংলাদেশি, রাজনৈতিক নেতাকর্মী সেই দেশে সেকেন্ড হোম করেছে। তারা টাকা পাচারের বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছে শুধু ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্থানান্তর নয়। হুন্ডি, আন্ডার ইনভয়েস, ওভার ইনভয়েসিং প্রভৃতি হচ্ছে মানি লন্ডারিং-এর সহজ পন্থা। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী এদের চিহ্নিত করা সহজ না হলেও অসম্ভব নয় বলে আমার বিশ্বাস। সন্দেহভাজন ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বিদেশ গমনের রেকর্ড সঠিকভাবে বের করতে পারলে এদের ক্রিয়াকলাপ উন্মুক্ত হয়ে যেতে পারে। হাইকোর্টের রুল প্রাপ্ত সরকারি বিভাগ ও এজেন্সিগুলো চেষ্টা করলে যে পাচারকারী এবং পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ বের করা যাবে না তা নয় বরং তা তারা করবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশ ব্যাংকের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। দেশের অর্থখাত পরিচালনায় এই ব্যাংকের কার্যকারিতার গুরুত্ব অপরিসীম।

সম্প্রতি আইএমএফ ‘Financial Sector Stability’র ওপর এক সমীক্ষায় কতগুলো পর্যবেক্ষণ দিয়েছে যা গুরুতর। আইএমএফ বলেছে, দেশের ব্যাংকিং খাতের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের ফলপ্রসূ তদারকি বলতে কিছু নেই। তার অধীন বেশ কয়টি ব্যাংকই দুর্বল ও অকার্যকর। ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহীতা অনেকেই মনে করেন যে, ঋণের টাকা শোধ করতে হবে না, অর্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ অত্যন্ত বেশি এবং মূলধন ভিত্তি খুবই দুর্বল। বড় বড় ঋণ খেলাপিরা অর্থ-খাতের সিদ্ধান্তকারী পদগুলো দখল করে আছেন। নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক অমান্যকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে শাস্তি প্রদানে আগ্রহী নয়। এগুলো হচ্ছে আইএমএফ-এর সাধারণ পর্যবেক্ষণ। এই পর্যবেক্ষণসমূহের আলোকে দেশের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক এই ব্যাংককে কার্যকর বলা যায় না। এর কার্যকারিতা ফিরিয়ে না আনলে অর্থনীতির কোনো শৃঙ্খলাই কার্যকর করা যেতে পারে না বলে আমার বিশ্বাস।

https://dailysangram.info/post/476388