৩ জানুয়ারি ২০২২, সোমবার, ৫:১৩

সাত বছরে আগুনে ৭৫৩ মৃত্যু

দেশে আগুনে পুড়ে সাত বছরে ৭৫৩ জন নিহত হয়েছে। এই সময় এক লাখ ২৪ হাজার ১৭৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। দগ্ধ হয়েছে ৭২ হাজার ৩৮৩ জন। আগুনের এসব ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দুই হাজার ৫৬৭ কোটি ৫২ লাখ ৬৮ হাজার ৪৬৫ টাকা।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় করা প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। আগুন লাগার প্রায় সব ঘটনাই ফায়ার সার্ভিস তদন্ত করে। মূলত বিভিন্ন কারখানা, অফিসের বহুতল ভবন, বাসাবাড়ি, দোকানপাট, মহাসড়কের গাড়িতে লাগা আগুনে এই বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে ফায়ার সার্ভিসের তদন্তে উঠে এসেছে।

kalerkanthoবিদ্যুতের শর্ট সার্কিট, গ্যাসলাইনের ত্রুটি, গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার দুর্ঘটনা (সিএনজি), রান্নার গ্যাস সিলিন্ডার থেকে ঘটা দুর্ঘটনাসহ (এলপিজি) নানা কারণে এসব অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের এপ্রিলে সবচেয়ে বেশি আগুনের ঘটনা ঘটেছে। ওই মাসে দুই হাজার ৮৬১টি আগুনের ঘটনায় মারা যায় ১৫০ জন। আহত হয় এক হাজারের বেশি মানুষ। প্রাণহানি ছাড়াও গত বছর আগুনের ঘটনায় ৩৩০ কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি আগুনের ঘটনা ঘটে ঢাকা বিভাগে। সবচেয়ে কম আগুন লাগে বরিশাল বিভাগে। ঢাকা বিভাগের নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, আশুলিয়া, সাভার এলাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান বেশি থাকায় আগুনের ঘটনা বেশি ঘটছে বলে মনে করছেন তদন্তে যুক্ত কর্মকর্তারা।

ফায়ার সার্ভিস গত বছরের পূর্ণাঙ্গ হিসাব এখনো তৈরি করেনি। তবে মৃত্যুর আনুমানিক হিসাব ১২০ বলে জানিয়েছে। এর মধ্যে বছরের শেষে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী লঞ্চে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় ৪৫ জন মারা যাওয়ার হিসাবও আছে।

বেশির ভাগ আগুনের কারণ বৈদ্যুতিক গোলযোগ : এত বেশি আগুন লাগার কারণ ব্যাখ্যা করে ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ আগুনের কারণ বৈদ্যুতিক গোলযোগ। অর্থাৎ নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহারের কারণে সহজেই শর্ট সার্কিট হয়। এ থেকেই ৮০ শতাংশ অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে আবাসিক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানেও এখন আগুন লাগার প্রধান কারণ নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার।

এর বাইরে আগুন লাগার বিশেষ কারণের মধ্যে রান্নার চুলা ও বিড়ি-সিগারেটের কথা বলা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদনে। রান্নার ক্ষেত্রে সিলিন্ডারের সংযোগের লিকেজ, গ্যাস পাইপলাইনের ত্রুটির কারণে বের হওয়া গ্যাস থেকে ঘটছে অগ্নিদুর্ঘটনা। বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে অনেক গ্যাসপাইপ সংযোগ নেওয়া হয়েছে। কারিগরি ত্রুটি ও লিকেজ থেকে বিস্ফোরণ ঘটে মানুষের হতাহত হওয়ার খবর প্রায়ই পাওয়া যায়।

আগুনে হতাহতের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো অগ্নিদুর্ঘটনার বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার অভাব। এর বাইরে ভবন তৈরিতে আইন অমান্য করাও একটি কারণ। এ ছাড়া ভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল থাকায় দুর্ঘটনার সময় মৃত্যু ও আহতের সংখ্যা বেড়ে যায় বলে মনে করছে ফায়ার সার্ভিস।

আগুন লাগার পর তা ভয়াবহ হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করে ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকা এবং ‘আগুন আর বাড়বে না, আমাদের এখানে ছড়াবে না’—এমন অবহেলার কারণে আগুন সহজেই ছড়িয়ে পড়ে বিপদ ডেকে আনে।

আগুন প্রতিরোধের উপায় : ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সব সময়ই আগুন যাতে না লাগে সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। অফিস-আদালত, শিল্পপ্রতিষ্ঠানে খোলা আগুন ব্যবহার না করা, যেখানে সেখানে জ্বলন্ত সিগারেট ও ম্যাচের কাঠি না ফেলা। অফিস-আদালত, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও আবাসিক ভবনে বৈদ্যুতিক তার এবং সব ধরনের ইলেকট্রিক সরঞ্জাম নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। ত্রুটি পেলে সঙ্গে সঙ্গে মেরামতের ব্যবস্থা করা জরুরি।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, বৈদ্যুতিক আগুন নেভানোর জন্য পানি ব্যবহার করা যাবে না। আগুনের ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গে মেইন সুইচ বন্ধ করে দিতে হবে। আগুন লাগলে দ্রুত নিকটবর্তী ফায়ার সার্ভিস কেন্দ্রে খবর দিতে হবে।

সাম্প্রতিক সময়ে আগুনে মৃত্যু : গত ৬ ডিসেম্বর সকালে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে কুমারপাড়া এলাকায় গ্যাসের চুলা থেকে সৃষ্ট বিস্ফোরণে ৯৫ শতাংশ দগ্ধ হয়ে সোলায়মান (৪৭) নামের একজনের মৃত্যু হয়েছে। রাত ৯টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে মারা যান তিনি। ওই ঘটনায় পরিবারটির আরো তিনজন দগ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নিহত সোলায়মান কাপড় ব্যবসায়ী। গ্যাসের চুলায় আগুন ধরাতে গেলে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে।

এ ঘটনার চার দিন আগে গত ২ ডিসেম্বর ভোরের দিকে মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর এলাকার একটি ভবনে গ্যাসের চুলার আগুনে এক পরিবারের চারজন অগ্নিদগ্ধ হয়। দুই শিশু রাতেই মারা যায়। ৫ ডিসেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তাদের মা শান্তা বেগম এবং ৯ ডিসেম্বর মারা যান বাবা মোহাম্মদ কাউসার।

গত ৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডস লিমিটেড কারখানায় ভয়াবহ আগুনে পুড়ে মারা যান কারখানার ৫২ জন শ্রমিক। এই দুর্ঘটনার মাত্র ১২ দিন আগে রাজধানীর মগবাজারে গ্যাস বিস্ফোরণে মারা যান আরো ১২ জন।

এ ছাড়া গত ১৪ ডিসেম্বর মধ্যরাতে পুরান ঢাকার বংশাল আলুবাজারে তিতাস গ্যাসের লাইন থেকে বিস্ফোরণের ঘটনায় তিনজন দগ্ধ হয়েছেন, দগ্ধ হয়েছেন আরো চারজন। গত ২৫ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে গ্যাসলাইন লিকেজ বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়েছেন তিনজন।

গত ৮ নভেম্বর ভোরে দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীতে একটি গ্যারেজে আগুন লাগার কারণ ছিল অটোরিকশার (সিএনজি) গ্যাস সিলিন্ডার। ওই আগুনে ১৪টি সিএনজি চালিত অটোরিকশা পুড়ে যায়।

শীতে অগ্নিদুর্ঘটনা বাড়ছে : শীত শুরুর সঙ্গে সঙ্গে অগ্নিদুর্ঘটনার পাশাপাশি বাড়ছে পোড়া রোগীর সংখ্যা। রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে বর্তমানে গড়ে দৈনিক চিকিৎসা নিতে আসছে অর্ধশত দগ্ধ রোগী।

হাসপাতালটির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর এপ্রিল-মে মাসে (গ্রীষ্মকাল) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে এসেছে এক হাজার ৪০৭ জন রোগী। এর মধ্যে ভর্তি হতে হয়েছে ৪৬৭ জনকে। আর শীত মৌসুমে গত ২১ নভেম্বর থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক মাসে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে এসেছে দুই হাজার ১১১ জন রোগী। এর মধ্যে ভর্তি হয়েছে ৬৭৬ জন; গ্রীষ্মের তুলনায় যা প্রায় দ্বিগুণ।

হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, শীত মৌসুমের রোগীদের বেশির ভাগ গরম পানি, গরম খাবার ও আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হচ্ছে। তবে এ ধরনের দগ্ধদের হিসাব ফায়ার সার্ভিসের খাতায় থাকে না।

সিলিন্ডারের আগুনের কারণ : ফায়ার সার্ভিসের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, বেশির ভাগ আগুনের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অনেক গাফিলতি থাকে। এটা হতে পারে বাড়িতে, প্রতিষ্ঠানে বা অন্যান্য ক্ষেত্রে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সিলিন্ডারের সংযোগে ত্রুটির কারণে আগুনের ঘটনা ফায়ার সার্ভিসকে ভাবিয়ে তুলেছে।

এলপি গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত সিলিন্ডারের মুখে নিম্নমানের রেগুলেটর, পাইপসহ উপকরণ ব্যবহারের কারণে লিকেজ হয়ে জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। তাই ব্যবহারকারীদের আরো সচেতন হতে হবে। একই সঙ্গে উন্নতমানের চুলা, রেগুলেটরসহ উপকরণ ব্যবহার করতে হবে।

জানতে চাইলে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশে এখন পর্যন্ত কোনো কম্পানির সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়নি। বিস্ফোরণ হচ্ছে সিলিন্ডারের মুখে থাকা রেগুলেটর, হোসপাইপসহ এক্সসেরিজ।’

আবুল কালাম আজাদ বলেন, সিলিন্ডারের মুখে থাকা রেগুলেটর, হোসপাইপসহ বাকি উপকরণগুলোর মানের বিষয়ে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। চাহিদা থাকায় যে যার মতো উৎপাদন করে বাজারে ছাড়ছে। দাম কম থাকায় নিম্নমানের এসব উপকরণ মানুষ বেশি কিনছে। তাই মাননিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকে বাজারে নজর বাড়াতে হবে।

সম্প্রতি জ্বালানি বিভাগ গ্যাস সিলিন্ডার দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করে একটি পরিপত্র জারি করেছে। ওই পরিপত্রে তিনটি ধাপে সতর্কতা অবলম্বনের উপায় বলে দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো—১. নিরাপদ জায়গায় সিলিন্ডার রাখা। ২. রান্না শুরুর আগে ও শেষ হওয়ার পরে সতর্কতা ৩. রেগুলেটরসহ সিলিন্ডারের খুঁটিনাটি সব পরীক্ষা করে রান্নাঘরে যথাযথভাবে বাতাস প্রবাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ম. তামিম কালের কণ্ঠকে বলেন, মূলত মানুষের অসচেতনতা ও নিম্নমানের সরঞ্জাম ব্যবহারের কারণে সিলিন্ডার লিকেজ থেকে আগুনের ঘটনা ঘটছে। নির্দিষ্ট সময় পর পর সিলিন্ডার মেরামত করতে হবে সরবরাহকারী কম্পানিগুলোকে।

দেশের সার্বিক অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, অগ্নিনির্বাপণের চেয়ে আগুন যাতে না লাগে সেদিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। আইন মেনে ভবন নির্মাণ করলে ও যথাযথ অগ্নিপ্রতিরোধের ব্যবস্থা থাকলে দুর্ঘটনা কমে আসবে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসকে আধুনিকায়নে সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সাধারণ মানুষকেও এ বিষয়ে আরো সচেতন হতে হবে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2022/01/03/1107311