৩ জানুয়ারি ২০২২, সোমবার, ৫:১০

বিমানবন্দর যেন সদরঘাট

শাহজালালে বেড়েই চলছে ভোগান্তি ও হয়রানি বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে রয়েছে : এ এইচ এম তৌহিদ-উল আহসান

‘উপরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট’ প্রবাদটির সাথে পরিচিত নয় দেশে এমন মানুষ হয়তো পাওয়া যাবে না। বাইরে থেকে সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলেও ভেতরে চরম অরাজকতা-বিশৃঙ্খলা বোঝানো হয় এই প্রবাদের মাধ্যমে। হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হলো বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার। বিদেশি বিনিয়োগকারী ও টুরিস্টরা বিমান থেকে নেমেই বিমানবন্দরের পরিবেশ দেখে বুঝে নেন দেশের চিত্র। ফলে বিমানবন্দর পরিচ্ছন্ন এবং যাত্রীবান্ধব হওয়ার কথা। অথচ হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর যেন বিশৃঙ্খলা-অব্যবস্থাপনা-অপরিচ্ছন্নতা হয়রানির প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। দেশের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রাজধানীর দক্ষিণ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা নদীর তীরের লঞ্চ টার্মিনাল সদরঘাটের মতোই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে।

জানতে চাইলে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রæপ ক্যাপ্টেন এ এইচ এম তৌহিদ-উল আহসান ইনকিলাবকে বলেন, বিমানবন্দরে যাত্রীর চাপ রয়েছে। তবে আগের চেয়ে বর্তমানে যাত্রীর চাপ এখন নিয়ন্ত্রণে আছে। যাত্রী হয়রানি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যাত্রীরা যেন হয়রানি বা ভোগান্তির শিকার না হয় সেই বিষয়ে এপিবিএনের দায়িত্বরত সদস্যদের কঠোর নির্দেশনা দেয়া আছে। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে রয়েছে। পরে বিষয়টি জানতে হয়রত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্মরত এপিবিএনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জিয়াউল হকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেনি।

যাত্রী হয়রানি ও অব্যবস্থাপনা বিমানবন্দরের স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে গেছে। ভিভিআইপি এবং ভিআইপি যাত্রী ছাড়া সাধারণ কোনো যাত্রী হয়রানি ছাড়া বিমানবন্দর থেকে ফিরে এসেছেন এমন ঘটনা বিরল। দীর্ঘদিন ধরেই চলছে অব্যবস্থাপনা। মশা নিধন থেকে শুরু করে যাত্রী হয়রানি বন্ধ ও পরিচ্ছন্নতা রক্ষায় দায়িত্বশীলরা বহুবার বৈঠক করেছেন। দফায় দফায় কমিটি করেছেন। কিন্তু হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পরিবেশ পরিস্থিতি উন্নত হয়নি। বিমানবন্দরে বিদেশগামী এবং বিদেশ থেকে এলেই যাত্রীদের গাড়ি চালকদের টানাটানি, যাত্রীদের তাড়াহুড়ো, ফ্লাইট শিডিউল বিপর্যয়, যাত্রী হয়রানি, করোনা টেস্টের জন্য দীর্ঘ লাইন, স্বল্পসময়ে অধিক ফ্লাইট ওঠানামা, অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ, যাত্রীদের স্ক্যান করার পরও কাস্টমস ও ইমিগ্রেশনে আলাদাভাবে তল্লাশি, লাগেজ পেতে বিড়ম্বনা, পার্কিং বিড়ম্বনা, ট্রলির অভাবে যাত্রীদের চরম ভোগান্তি, দালালের উৎপাতে পড়তেই হয়। যাত্রী ও স্বজনদের অভিযোগ, বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে সদরঘাটে প্রতিদিন যে অব্যবস্থাপনার চিত্র দেখা যায়, বর্তমানে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও একই চিত্র বিরাজ করছে। এতে দিন দিন আন্তর্জাতিক মান নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। বিদেশ থেকে দেশে এসেছেন এমন একাধিক যাত্রীর সঙ্গে কথা বললে তারা বিমানবন্দরের পরিবেশ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা বলেন, আমেরিকা, চীন, ইউরোপের দেশগুলো বিমানবন্দরের মানের দূরের কথা নেপালের বিমানবন্দরের সেবার মানের চেয়ে শাহজালাল বিমানবন্দরের সেবার মান খারাপ।

গত দু’দিন সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, যাত্রী ও তাদের স্বজনরা বিমানবন্দর এলাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অবস্থান করছেন। অনেকেই বিদেশ যাত্রা করার জন্য আবার অনেকেই বিদেশ ফেরত যাত্রীদের বাড়ি নিতে বিমানবন্দরে এসেছেন। কিন্তু সহজ-সরল হাজারো মানুষ গাড়ি ব্যবসায়ী ও চোরাচালান সিন্ডিকেটের কারণে প্রতিদিন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। কথিত কঠোর নিরাপত্তার মধ্যেও থেমে নেই এদের উৎপাত। উল্টো যাত্রী ও স্বজনরা নিরাপত্তা কর্মীদের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে মশা মারার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। একাধিক কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু বিমানবন্দর যেন মশার খনি। ক্ষুদ্র প্রাণী মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ যাত্রী ও তাদের স্বজনরা।

গত শনিবার দুপুরে টার্মিনাল-২ এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, দুইজন এপিবিএন সদস্য দায়িত্বে রয়েছেন। এসময় মহেশ্বর নামের এক এপিবিএন সদস্যের যাত্রী ও তাদের স্বজনদের সাথে দুর্ব্যবহার করতে দেখা গেছে। প্রবাসী শ্রমিকরা বিদেশ থেকে দেশে ফিরলেই তাদের হয়রানি করা যেন দায়িত্বশীলদের প্রধান রুটিন ওয়ার্ক হয়ে গেছে। এক পর্যায়ে এমন ব্যবহারের কারণ জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

একাধিত যাত্রী দুঃখ করে এই প্রতিবেদককে বলেন, বিদেশে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশে রেমিটেন্স পাঠাই; অথচ ছুটিতে দেশে এলে বিমানবন্দরেই দুর্ব্যবহার করা হয়। প্রবাসে শ্রমিকের কাজ করি বলে আমাদের যাত্রী হিসেবে গুরুত্ব দেয়া হয় না। বিমানবন্দরের নিচ তলায় ১ নম্বর ও ২ নম্বর টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেছে, বিদেশ ফেরত যাত্রীরা বিমানবন্দর থেকে বের হচ্ছেন। তাদের জন্য বাইরে অপেক্ষা করছেন স্বজনরা।

কিন্তু ট্রলি কম থাকায় অনেক যাত্রী তাদের লাগেজ মাথায় করে নিয়ে আসছেন। লাগেজ নিয়ে বাইরে বের হওয়ার পরে চালক সিন্ডিকেট সদস্যদের খপ্পরে পড়ছেন অনেক যাত্রী। এ সময় অনেক যাত্রী ও তাদের মালামাল নিয়ে টানাটানির ঘটনাও ঘটছে।

জেদ্দা থেকে আসা সামছু মিয়া নামের এক যাত্রী ইনকিলাবকে বলেন, বিমানবন্দরে আসার পর ইমিগ্রেশনে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। এরপর ট্রলি না পেয়ে লাগেজ মাথায় করে নিয়ে বাইরে আসি। সেখানে আসার পর মাইক্রোবাসের চালকরা আমাকে নিয়ে টানাটানি শুরু করে। এক পর্যায়ে অনেক কষ্টে তাদের কাছ থেকে রক্ষা পাই। পরে লাগেজটি মাথায় করে বিমানবন্দর এলাকা ত্যাগ করি।

আব্দুর রহমান নামের আরেক ব্যক্তি ইনকিলাবকে বলেন, আমার ভাই দুবাই থেকে এসেছেন। কিন্তু নির্ধারিত সময় থেকে প্রায় তিন ঘণ্টা দেরিতে এসেছেন। ফ্লাইট সিডিউল বিপর্যয়ের কারণে দেরি হয়েছে বলে জানান তিনি।

বিমানবন্দর দ্বিতীয় তলায় গিয়ে দেখা গেছে, বিমানবন্দরে প্রবেশের জন্য যাত্রীরা তাড়াহুড়া করছেন। প্রতিটি গেটে দীর্ঘ লাইন রয়েছে। উন্নয়ন কাজের জন্য বিমান উঠানামা ৮ ঘণ্টা বন্ধ থাকায় যাত্রীর চাপে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

যাত্রীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিমান যাত্রীদের স্বজনদের গাড়ি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। এছাড়া যাত্রীদের নিয়ে যেসব যানবাহন ভেতরে প্রবেশ করে সেগুলো এক ঘণ্টার বেশি সময় রাখতে দেয়া হয় না। এক ঘণ্টার বেশি সময় রাখতে হলে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয়। তবে ভাড়ায় চালিত ট্যাক্সিক্যাব, মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কার পুরো এলাকায় সারাদিন দখল করে রাখলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয় না। কারণ এসব গাড়ির ব্যবসায় জড়িত সিন্ডিকেটের সাথে গোপন লেনদেনের ও মাসোয়ারা পরিশোধের অলিখিত চুক্তি রয়েছে জানিয়েছে একটি সূত্র।

সিলেট থেকে আসা রফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি ইনকিলাবকে বলেন, তার খালা রহিমা বেগমকে ইংল্যান্ড থেকে এসেছেন। তবে তাকে নিতে এসে অনেক বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন তিনি। তিনি জানান, প্রবেশপথেই তাকে গাড়িসহ আটকিয়ে দেয়া হয়। পরবর্তীতে একজন ইজারাদার কর্মীর মাধ্যমে গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করেন।

শুধু রফিকুল ইসলাম নয়, দূর-দূরান্ত থেকে আসা যাত্রী ও তাদের স্বজনরা প্রতিদিনই হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ইজারাদার নামধারী ওই বাহিনীর মাধ্যমে বিমানবন্দরে কার পার্কিংয়ে যাত্রী হয়রানি বেড়েই চলেছে। দখলদার বাহিনী নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী আদায় করছে টাকা। কথিত ইজারাদার বাহিনী আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। গাড়ি প্রতি ৫০ টাকার স্থলে ১০০ টাকা এবং প্রবেশপথে অবৈধভাবে আদায় করছে ৩০০ টাকা। এ নিয়ে অভিযোগ করারও সুযোগ নেই যাত্রী ও তাদের স্বজনদের।

https://www.dailyinqilab.com/article/449778