৩ জানুয়ারি ২০২২, সোমবার, ৫:০৭

ভারী হচ্ছে ঋণের বোঝা

বাজেটের ঘাটতি পূরণে বরাবরই বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীল হতে হয় বাংলাদেশকে। তুলনামূলক রাজস্ব আয় ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ অর্জন কম হওয়ায় এবং দেশের বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নসহ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্যই মূলত বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকে সরকার। একইভাবে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালীন বেশকিছু বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে দফায় দফায় বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছে সরকার। তবে, বিগত দিনের তুলনায় এই বৈদেশিক ঋণ নেয়ার প্রবণতা অনেকাংশে বেড়ে গেছে। প্রতিবছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে ঋণের স্থিতি। ফলে দিন যত যাচ্ছে, ততই বিদেশি ঋণের বোঝা যেন আরও ভারী হচ্ছে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারের ঋণ বৃদ্ধির হার তুলনামূলক অনেক বেশি। বাংলাদেশের সূচনালগ্ন থেকে বিগত ৩৯ বছরে যে পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ নেয়া হয়েছে, গত ১০ বছরেই তা বেড়ে আড়াই গুণে দাঁড়িয়েছে।

বর্তমানে ঋণের হার যেভাবে বাড়ছে তাতে ভাবিষ্যতে ঋণের বোঝা আরও বড় হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। বিদেশি ঋণের ওপর এতটা নির্ভরশীলতা উচিত নয় জানিয়ে তারা বলছেন, ভবিষ্যতে এই ঋণ দেশের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

১০ বছরে বেড়েছে আড়াই গুণ: বিশ্বব্যাংকের ‘ইন্টারন্যাশনাল ডেট স্ট্যাটিসটিক্স-২০২২’ শীর্ষক এক হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ২ হাজার ৬৫৭ কোটি ২০ লাখ ডলার। এরপর ২০১৬ সাল শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮৪৮ কোটি ১০ লাখ ডলার, একইভাবে বেড়ে ২০১৭ সালে ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৪ হাজার ৬৮১ কোটি ৯০ লাখে। ২০১৮ সালে ৫ হাজার ২১৩ কোটি ৮০ লাখ, ২০১৯ সালে ৫ হাজার ৭০৯ কোটি ৪০ লাখ এবং সর্বশেষ ২০২০ সাল শেষে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৭৭৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার। নতুন ঋণের সঙ্গে আগের ঋণের সুদমুক্ত হওয়ায় বছর বছর স্থিতি বেড়েই চলছে।

ওদিকে, শুধু চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের পাঁচ মাসেই বিদেশি ঋণ সহায়তা নেয়া হয়েছে ৩০৮ কোটি ৯৪ লাখ ডলার। সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) বৈদেশিক সহায়তা বিষয়ক মাসিক রিপোর্টে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত) বৈদেশিক ঋণ নেয়া হয়েছে ৩০৮ কোটি ৯৪ লাখ ডলার। এরমধ্যে অনুদান রয়েছে ৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার, আর ঋণ রয়েছে ৩০১ কোটি ৩২ লাখ ডলার। অন্যদিকে গত অর্থবছর একই সময়ে অনুদানসহ ঋণের পরিমাণ ছিল ২০৬ কোটি ৭৪ লাখ ডলার। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এ বছর ঋণের পরিমাণ আরও বেড়েছে।

এ ছাড়া এই মাসিক রিপোর্ট প্রকাশের কয়েকদিন পরেই আরও দুইটি ঋণ চুক্তির তথ্য জানিয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ। গত ২০শে ডিসেম্বর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ইআরডি জানায়, ‘প্রোগ্রাম লোন ফর সাসটেইনেবল ইকোনমিক রিকভারি প্রোগ্রাম (সাব-প্রোগ্রাম-১) শীর্ষক ঋণ চুক্তির আওতায় দক্ষিণ কোরিয়া বাংলাদেশকে বাজেট সাপোর্ট হিসেবে ১০০.০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা প্রদান করবে। এ ছাড়া গত ২৩শে ডিসেম্বর ইআরডির আরেক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ‘ইরিগেশন ম্যানেজমেন্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট-এডিশনাল ফাইন্যান্সিং’ শীর্ষক ঋণ চুক্তির আওতায় ১৩.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ দেবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এ ছাড়াও, রাশিয়া, চীন ও ভারত সহ কয়েকটি দেশের বড় ঋণ প্রস্তাব রয়েছে। এগুলো গৃহীত হলে সামনের দিনগুলোয় বৈদেশিক ঋণ আরও বাড়বে।

১০ বছরে মাথাপিছু ঋণ বেড়েছে প্রায় ছয়গুণ: সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বরে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছিলেন, বর্তমানে দেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ৪ হাজার ৯৪৫ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার। এই হিসাবেই বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৯২ দশমিক ১১ মার্কিন ডলার। প্রতি ডলার ৮৫.২১ টাকা হিসাবে বাংলাদেশি টাকায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৪ হাজার ৮৯০ টাকা ৬৯ পয়সা। সেই হিসাবে গত এক দশকে মাথাপিছু বিদেশি ঋণ বেড়েছে ছয় গুণেরও বেশি। আর এক বছরেই বেড়েছে সাড়ে ৭ হাজার টাকারও বেশি। গত বছর মাথাপিছু ঋণ ছিল ১৭ হাজার ১৩৬ টাকা।

কী বলছেন অর্থনীতিবিদরা: বিদেশি ঋণের ওপর এতটা নির্ভরশীলতা, ঋণের স্থিতি এত বেশি হওয়া উচিত নয় বলে মনে করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি মানবজমিনকে বলেন, বৈদেশিক ঋণ এত বৃদ্ধি হওয়া উচিত নয়। কারণ এই ঋণের বোঝা সাধারণ মানুষের ওপর পড়ে। আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর বর্তায়। যতটুকু সম্ভব এটা সীমিত করে রাখা দরকার। তিনি বলেন, বেশ কয়েক বছর ধরে আমরা দেখছি যে, তারা বলছে যে, আমরা বাজেটের বেশির ভাগ নিজেরাই পূরণ করি, আমরা ঋণ আনি না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যেটা হচ্ছে, উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য প্রচুর লোন নিয়ে আসা হচ্ছে। আর সাম্প্রতিক কয়েক বছর ধরে মেগা প্রকল্পগুলোর জন্যও লোন আসছে। এই ঋণের বোঝাটা বাড়তে থাকবে। এটা ডিপেন্ড করে সুদের হার কেমন, এর গ্রেস পিরিয়ড কেমন তার ওপর। মাল্টিন্যাশনাল, এডিবি, বিশ্বব্যাংক সহ এগুলোর গ্রেস পিরিয়ড ১.৫ শতাংশের বেশি থাকে না। কিন্তু অন্যগুলোতে থাকে ৫-৬ শতাংশ। অতএব, সেটার বোঝাটা একটু বেশি।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে বড় একটা কন্ডিশন হলো- ঋণের টাকাটা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে হবে। সময়মতো কাজে লাগাতে হবে। কিন্তু আমাদের একটা প্রজেক্ট ২ বছরের জায়গায় ৫ বছর চলে যাচ্ছে। এক হাজার কোটি টাকার প্রজেক্ট ৫ হাজার কোটি টাকা হয়ে যায়। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। অর্থাৎ এই ঋণ অনেকটা অপচয়।

তবে ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড হিসাবে ধরলে এই ঋণ সেরকম ভয়াবহ আকারের নয় বলেও মত দেন তিনি। বাংলাদেশের যে সামর্থ্য আছে, বাংলাদেশের লোকজনের যে ক্রয়ক্ষমতা, মানুষের যে ইনকাম সেই তুলনায় এটা খুব কম না। ড. সালেহউদ্দিন আহমদ বলেন, বাজেটের ঘাটতি পূরণে ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে সেটাও ভালো না। আবার বিদেশ থেকে আনছে এটাও যে খুব ভালো তা নয়। এবং এটার যে কার্যকারিতা সেটাও অনেকটা ব্যাহত হয়েছে। তাই ঋণ নেয়ার চেয়ে দেশীয় সম্পদ অর্জনের দিকে নজর দেয়ার তাগিদ দেন এই অর্থনীতিবিদ। বিশেষ করে রাজস্ব আদায়ে এনবিআরের দুর্বলতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, দেশীয় সম্পদ বাড়াতে হবে। রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। মূলত প্রত্যক্ষ করের ওপর জোর দিতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক যে, বাংলাদেশ ভ্যাটের ওপর বেশি নির্ভরশীল, ইনকাম ট্যাক্সে নয়। অথচ পৃথিবীর সব দেশেই প্রত্যক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন জিডিপির অনুপাতে ধরলে অন্যান্য দেশের তুলনায় এই ঋণ খুব বেশি নয়। তবে দেখার বিষয় হলো এটা স্থিতিশীল থাকবে কিনা, নাকি শুধু বাড়তেই থাকবে। একইসঙ্গে এই ঋণের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে কিনা সেটা দেখতে হবে। তিনি বলেন, আমরা সব সময়ই দেখেছি যেসব প্রকল্পের জন্য ঋণ নেয়া হয়, বিশেষ করে এডিবি’র প্রকল্প- এগুলো সময়মতো শেষ হয় না। ৫ বছরের প্রকল্প ৮ বছরে শেষ হলেও ধরে নেয়া হয় যে, এটা ভালোই হয়েছে। তবে সাধারণত ৫ বছরের জায়গায় ১০ বছরের বেশি লেগে যায়। আর দেখা যায়, বাজেট বাড়তে বাড়তে ১ টাকার জায়গায় ৩-৪ টাকা খরচ হয়ে যায়। এটা একদিকে যেমন সময়ের অপচয়, অপরদিকে অর্থের অপচয় হয়। এটাই সমস্যা। এখন এই অপচয় সত্ত্বেও কেন জিডিপি রেশিও সহনীয় পর্যায়ে আছে? সেটার মূল কারণ হলো আমরা যে ঋণগুলো পাচ্ছি সেটা এখনো সহজ শর্তে পাচ্ছি। এই কারণে অর্থের অপচয় সত্ত্বেও ঋণের বোঝা ততটা বাড়েনি। তবে এভাবে চললে ভবিষ্যতে সেটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

জাহিদ হোসেন বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার ছাড়াও অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের যে মূলধন ঘাটতি; এরপর সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন লোনে যে গ্যারান্টি দেয়া হয়, এগুলোর অনেক কিন্তু সরকারি ব্যাংকেরই দেয়া। আবার কিছু আছে রাষ্ট্রায়ত্ত লোকসানি প্রতিষ্ঠান। এখন এই গ্যারান্টির ঋণগুলোও যদি তারা ফেরত দিতে না পারে, তাহলে এটাও দুশ্চিন্তার বিষয়।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=309624&cat=2