৩ জানুয়ারি ২০২২, সোমবার, ৪:৫৯

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন

ডেঙ্গু ও পরিবহন খাতের দুর্নীতি অনিয়ম ছিল আলোচনায়

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন গত বছর নানা উদ্যোগ নিলেও ডেঙ্গুর ভয়াবহতা এবং পরিবহন খাতের দুর্নীতি-অনিয়ম তাদের সাফল্য ম্লান করে দিয়েছে। এ ছাড়া জলাবদ্ধতা সমস্যা এখনো নিরসন করতে পারেনি দুই সিটি করপোরেশন। তবে বছর শেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ঢাকা পরিবহন চালু হওয়ায় আরেকটি কৃতিত্ব যোগ হয়েছে। নাগরিকসেবা বৃদ্ধি করতে ২০১১ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে উত্তর ও দক্ষিণ সিটি নামে দু’টি ভাগে ভাগ করা হয়। সে সময় মূল ঢাকাকে ভাগ করা হলেও পরে আশপাশের ইউনিয়নগুলোকেও দুই সিটির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফলে এখন দু’টি সিটিরই পরিধি আগের মূল ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রায় সমান। তবে ইউনিয়নগুলো সিটির আওতায় এলেও সেখানে এখনো সব নাগরিক সেবা পৌঁছেনি। এমনকি বিভক্তির ১০ বছর পরও মূল ঢাকাতেই এখনো নানা সমস্যা নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে সিটি করপোরেশন। গত বছর নাগরিকসেবা বাড়াতে দুই সিটি বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও নানা সমস্যায় ভুগতে হয়েছে নগরবাসীকে।

ডেঙ্গুতে শতাধিক প্রাণহানি : করোনার পাশাপাশি নাগরিকদের মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হতে হয়েছে। গত এক বছরে ডেঙ্গুতে ২৮ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে শতাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। এসব রোগীর বেশির ভাগই ছিল ঢাকার বাসিন্দা। করোনা মহামারীর মধ্যে ডেঙ্গু হওয়ায় মানুষকে ভীষণভাবে ভুগতে হয়েছে।

বর্ষায় ভুগিয়েছে জলাবদ্ধতা : অন্যান্য বছরের মতো গত বর্ষায়ও জলাবদ্ধতার ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে নগরবাসীকে। বৃষ্টি হলেই নগরের বিভিন্ন স্থানে কোথাও হাঁটুপানি আবার কোথাও কোমর পানির চিত্র দেখা গেছে। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি করপোরেশনের এখতিয়ারে নেয়া হয়। প্রতিষ্ঠান দু’টি জলাবদ্ধতা নিরসনের আশাও জাগিয়েছিল। নগরবাসী ভেবেছিল, এবার মনে হয় জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মিলবে। কিন্তু কথা রাখতে পারেনি দুই সিটি করপোরেশন। বিভিন্ন খাল থেকে কঠিন বর্জ্য পরিষ্কার করা হলেও তা এখনো কাক্সিক্ষত মানে যায়নি। এমনকি আবর্জনা পরিষ্কারের পরও এখনো অনেক খালে ময়লা আবর্জনা নতুন করে জমা হয়েছে। এর পেছনের কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠান দু’টি বলছে, খালগুলো অবৈধ দখলে থাকায় পানির প্রবাহ ঠিক নেই। ফলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানে আরো সময় লাগবে। আগামীতে জলাবদ্ধতা অনেকাংশে কমে আসবে এমন দাবি দুই সিটি করপোরেশনের।

পরিবহন খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি : দুই সিটি করপোরেশনের পরিবহন খাত অনিয়ম আর দুর্নীতিতে ঠাসা। সম্প্রতি তাদের গাড়ির চালকরা একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটালে বিষয়টি জনসম্মুখে আসে। গত ২৪ নভেম্বর ডিএসসিসির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ হারায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান (১৭)। নাঈম নিহত হওয়ার পরের দিনই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ হারান আহসান কবির খান। তিনি একটি জাতীয় দৈনিকের সাবেক কর্মী ছিলেন। এরপর ২ ডিসেম্বর উত্তর সিটি করপোরেশনেরই এক ময়লার গাড়ি যাত্রীবাহী বাসে ধাক্কা দিলে আরজু বেগম নামের (৬৫) এক বৃদ্ধা আহত হন। গত ২৩ ডিসেম্বর রাজধানীর ওয়ারী এলাকায় ডিএসসিসির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নিহত হন স্বপন কুমার সরকার (৬২) নামে আরো এক ব্যক্তি। এতে ঢাকার রাজপথে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তুমুল আকার ধারণ করে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) তাৎক্ষণিক তদন্ত কমিটি গঠন করে, শুরু হয় তদন্ত। তাতে সামনে উঠে আসে ডিএসসিসির অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার নানা চিত্র। সূত্রে জানা গেছে, ডিএসসিসির মোট যানবাহন ৫১৩টি হলেও নিবন্ধিত চালক মাত্র ১৪৭ জন।

এ ছাড়া ২০০ গাড়ি চলে মাস্টাররোলে নিয়োগপ্রাপ্ত চালক দিয়ে। তাদের অধিকাংশই ক্লিনার। এসব চালকের নেই প্রশিক্ষণ বা লাইসেন্স। ১৬৬টি গাড়ি কিভাবে চলে তার সঠিক তথ্য নেই ডিএসসিসির কাছে। বাকি গাড়িগুলো চলে অদক্ষ ও অনিবন্ধিত চালক দিয়ে। ফলে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। তদন্ত কমিটি জানতে পারে শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় হারুন মিয়া নামে যে চালককে কর্মচ্যুত করা হয় তিনি ডিএসসিসির নিয়োগপ্রাপ্ত গাড়ি চালক নয়। ১৮ মাস ধরে ময়লাবাহী গাড়ি চালাত সে। এ জন্য পরিবহন বিভাগকে খুশি করে চলতে হতো তাকে। জানা গেছে, তদন্ত কমিটির কাছে ডিএসসিসি পরিবহন শাখার মহাব্যবস্থাপক ময়লার গাড়ির বিপরীতে চালকদের যে তালিকা দিয়েছেন তাতে হারুনের নামে কোনো গাড়ি বরাদ্দ ছিল না। তবে তেলের টোকেন সংগ্রহ, পাম্প থেকে তেল নেয়া, গাড়ি মেরামত সব স্থানেই হারুনের স্বাক্ষর রয়েছে।

এ দিকে পরিবহন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক গত এপ্রিল মাসে ৮৮টি ময়লাবাহী ভারী গাড়ি পরিচালনার জন্য দায়িত্ব বণ্টন করেছেন। এর মধ্যে ভারী গাড়িচালক ছিলেন ২২ জন। পাশাপাশি হালকা গাড়িচালক ছিলেন ২২ জন আর পরিচ্ছন্নতাকর্মী, মশক নিধনকর্মী, ওষুধ সরবরাহকারী এবং বহিরাগত মিলে মোট আরো ৪৪ জনকে দায়িত্ব দেয়া হয়, যা ছিল আইনবহির্ভূত। নানান দুর্নীতি অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার কারণে এমনটা হয়েছে। উত্তর সিটি করপোরেশনেও একইভাবে পরিবহন বিভাগে অনিয়ম-দুর্নীতি চলে আসছে। এসব সমস্যা সমাধানে দুই সিটি করপোরেশন বেশ কিছু গাড়ি চালককে চাকরিচ্যুত করেছে। এ ছাড়া নতুন করে গাড়িচালক নিয়োগে ইতোমধ্যে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে।

সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি : রাজধানীতে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি নিত্যসমস্যা। প্রতি বছরই নানা উন্নয়ন কাজের অজুহাতে এক সড়ক একাধিকবার খোঁড়া হচ্ছে। বর্তমানেও বিভিন্ন সড়ক খুঁড়ে রাখা হয়েছে। এতে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে নগরবাসীকে।

ঢাকা নগর পরিবহন চালু : ঢাকা উত্তর সিটির সাবেক মেয়র মরহুম আনিসুল হক রুটভিত্তিক কোম্পানির অধীনে বাস চালানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন ২০১৫ সালে। আনিসুল হক রাজধানীকে যানজটমুক্ত করতে ঢাকা মহানগরীতে বর্তমানে থাকা ২৯১টি রুট কমিয়ে মাত্র পাঁচ-ছয়টি রুটে নিয়ে আসা এবং সেগুলোকে আলাদা আলাদা রঙ বিশিষ্ট করার পরিকল্পনা নেন। এতে ঢাকায় চলাচলরত ৯ হাজারেরথও বেশি বাস-মিনিবাসের মধ্যে প্রতিযোগিতা এবং যানজট কমবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন। তবে পরিকল্পনার দীর্ঘ ছয় বছর পর গত ২৬ ডিসেম্বর থেকে রাজধানীতে কোম্পানিভিত্তিক বাস পরিচালনার অংশ হিসেবে পরীক্ষামূলকভাবে মাত্র একটি রুটে বাস চলাচল শুরু হয়েছে। কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর পর্যন্ত এ বাস চলছে। প্রথমদিকে এ রুটে ১২০টি বাস চলাচল করবে বলা হলেও তার অর্ধেকেরও কম মাত্র ৫০টি বাস চলছে এ রুটে। এর মধ্যে ৩০টি বাসই সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআরটিসির দ্বিতল বাস। বাকি ২০টি বাস ব্যক্তি মালিকানাধীন ট্রান্সসিলভা।

বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির আহ্বায়ক ও ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ২০২৩ সালের মধ্যে পুরো ঢাকায় এ নগর পরিবহন চালু করার আশা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু দীর্ঘ ছয় বছর পর এসে মাত্র একটি রুটে তাও আবার অর্ধেকেরও কম বাস নিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে কোম্পানিভিত্তিক বাস চলাচল। ফলে রাজধানীর সব এলাকায় একসাথে এ পদ্ধতিতে বাস চলাচল কত দিনে চালু হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তারপরও এটি নগরবাসীর জন্য একটি সুখবর। এখন যদি দুই সিটি ২০২৩ সালের মধ্যে পুরো ঢাকায় কোম্পানিভিত্তিক বাস চলাচল চালু করতে পারে তাহলে সেটা হবে একটি মাইলফলক। যদিও মেয়র আনিসুল হক এবং পরে দায়িত্ব পাওয়া ডিএসসিসি মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন, ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস এবং ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম সব সময়ই বলেছেন মূলত বাস মালিকদের অসহযোগিতার কারণে এ পদ্ধতিতে বাস চালু করা যাচ্ছে না। তবে বাস মালিকরা সব সময়ই এ অভিযোগ এড়িয়ে গেছেন।

 

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/633925