৩ জানুয়ারি ২০২২, সোমবার, ৪:৪৬

জলবায়ু বিপর্যয়ে হুমকিতে সাতক্ষীরাসহ উপকূলের খাদ্য নিরাপত্তা

আবু সাইদ বিশ্বাস : জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায় হুমকিতে পড়েছে খাদ্য নিরাপত্তা। পানিবদ্ধতা ও লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, নদী তীরবর্তী এলাকার বেড়িবাঁধ ভাঙন, সুপেয় পানির সমস্যা, শিশু মৃত্যু, নারীর প্রজনন, খাদ্য সংকট, অসংখ্য প্রাণী বিলুপ্তসহ সমাজের সকল ক্ষেত্রে এর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ বাস করেন উপকূল অঞ্চলে, যাদের জীবিকার প্রধান উপাদান কৃষি। শুধু সাতক্ষীরা জেলাতে ২৩ লক্ষ মানুষের বসবাস। কঠোর পরিশ্রম ও কৃষি সাধনার পরও জেলা বাসির ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না। বরঞ্চ পেশা পরিবর্তস সহ উদ্বাস্তু হচ্ছে অসংখ্য কৃষক।

সাতক্ষীরা অঞ্চলে ষাটের দশকে ওয়াপদার বেড়িবাঁধ নির্মাণের ফলে গোটা এলাকায় কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব ঘটে। সবুজ গাছপালায় উপকূলীয় এলাকা পরিণত হয় মিনি অরণ্যে। ওই সময় প্রতিটি বাড়িতে ছিল গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ, গোলা ভরা ধান। এলাকার চাহিদা পূরণ করে উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হতো।

একপর্যায়ে আশির দশকে এ অঞ্চলে শুরু হয় পরিবেশ বিধ্বংসী লবণ পানির চিংড়ি চাষ। বর্তমানে শ্যামনগর, কালিগঞ্জ, দেবহাটা, আশাশুনি, সদর ও তালা উপজেলায় প্রায় অর্ধলক্ষাধিক হেক্টর জমিতে সাদা সোনা খ্যাত লবণাক্ত পানির চিংড়ি চাষ হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ বিপর্যয় ও লবণ পানির আগ্রাসনে এ অঞ্চলে হ্রাস পেয়েছে কৃষিজমি। গত দুই দশক ধরে ধরে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। ষাটের দশকে নির্মিত বাঁধগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে প্রতিনিয়ত জোয়ারের উপচেপড়া পানিতে প্লাাবিত হচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকা। অসংখ্য নদ-নদী শুকিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা।এখনো জেলা নিম্নাঞ্চল পানির তলে।

লবণাক্ততা বাড়ায় কারণে উপকূলের প্রায় তিন কোটি ৫০ লাখ মানুষ তীব্র খাবার পানি সংকটে ভুগছেন। এখানে একজন মানুষ প্রতিদিন গড়ে মাত্র দুই লিটার খাবার পানির মাধ্যমে ১৬ গ্রাম লবণ গ্রহণ করেন। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার সুপারিশ দিনে পাঁচ গ্রাম। চরম আকারে হ্রাস পেয়েছে কৃষি উৎপাদন, গাছপালা নেই বললে চলে। বিলুপ্ত হয়েছে ৬০ প্রজাতির মাছ ও অসংখ্য প্রজাতির পশুপাখি। বর্তমানে জলবায় পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত প্রথম ১০ দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে বিবেচনা করা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সমদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১০০ সেন্টিমিটার বাড়লে পানির নিচে তলিয়ে যাবে ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ উপকূলীয় অঞ্চল, পরিবেশ শরণার্থী হবেন দুই কোটি মানুষ। শতকরা ২৯ শতাংশ নিচু এলাকায় বন্যার ঝুঁকি বাড়বে। এ হিসেবে প্রতি বছর গড়ে ৬৫ হাজার হেক্টর আবাদি জমি কমছে। এ হারে কমতে থাকলে আগামী ২০ বছর পর দেশে কৃষিজমির পরিমাণ দাঁড়াাবে ৫০ হাজার হেক্টরে।

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে উপকূলীয় অঞ্চলের অর্থনীতির সুরতহাল রিপোর্ট পর্যালোচনা করলে এটা প্রতিভাত হয়ে ওঠে যে, জাতীয় অর্থনীতির আন্তঃসলিলা শক্তির উদ্বোধন যার হাতে সেই সবচেয়ে বেদনায় বিবর্ণ। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরো অর্থনীতির অনেক প্রবণতার সূচক সন্ধানে কালাতিপাত করে কিন্তু উপকূলীয় জেলা অথচ তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন নেই বললেই চলে।

উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষিঅর্থনীতি ও বিশে^র বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের সুরক্ষা নিয়ে কার্যকরী পরিকল্পনা গ্রহণ করা দাবি উঠেছে। পাশাপাশি আগামী দিনে বঙ্গোপসাগর কেন্দ্রিক সমুদ্রঅর্থনীতি বা ‘নীল অর্থনীতি’ বিকাশের কেন্দ্র হিসেবে উপকূলীয় অঞ্চলকে গড়ে তুলতে প্রয়োজন বিশেষ পরিকল্পনা। এসব লক্ষ্য পূরণে জাতীয় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দসহ একটি ‘উপকূলীয় উন্নয়ন বোর্ড’ গঠন করে বিশদ জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি।

সংশ্লিষ্টরা বলছে, মোদ্দা কথায় সময়ের প্রেক্ষাপটে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে তার গতিপ্রকৃতি বিচার-বিশ্লেষণ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যথাসময়ে যথাযত ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব না হলে, উষ্ণায়নের প্রভাবক ক্ষয়ক্ষতিকে যথা নিয়ন্ত্রণ ও মোকাবিলা করা সম্ভব না হলে সমূহ সম্ভাবনাময় একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের অবদান থেকে অদূর ভবিষ্যতে জাতীয় অর্থনীতি শুধু বঞ্চিতই হবে না, সময়ের অবসরে জলবায়ুর পরিবর্তন প্রভাবে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এটি গোটা দেশ ও অর্থনীতির জন্য দুর্ভাবনা-দুর্গতির কারণও হয়ে দাঁড়াতে পারে।

https://dailysangram.info/post/476227