৩ জানুয়ারি ২০২২, সোমবার, ৪:৪১

‘টিকটক-লাইকি’র আড়ালে সক্রিয় ছিল অপহরণ ও মানব পাচারকারীচক্র

নাছির উদ্দিন শোয়েব : বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল অনলাইন বিনোদন ভিত্তিক অ্যাপ ‘টিকটক’ ‘লাইকি’। অনলাইনের এই ফাঁদে ফেলে নারী ও শিশু পাচার ও ধর্ষণের ঘটনায় উদ্বেগ ছিল। টিকটক, লাইকি, ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন অ্যাপের আড়ালে পাচারকারীচক্রের ওত পেতে থাকার বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ভারতে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া এক নারীর নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর বিষয়টি আলোচনায় আসে। এরপর এ ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে ভয়ঙ্কর তথ্য। ‘টিকটক’ ‘লাইকি’র আড়ালে নারী-শিশু পাচারসহ নানা কিশোর অপরাধের বহু তথ্য পায় পুলিশ।

এই অ্যাপগুলো বন্ধ বা নিষিদ্ধের জোরালো দাবি উঠে বিভিন্ন পর্যায় থেকে। খোদ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায় থেকেও অ্যাপগুলো নিষিদ্ধের দাবি উঠে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান জানান, ‘এসব অ্যাপ সহজলভ্য হওয়ায় যুবসমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তারা কী সব অশ্লীল ও উদ্ভট ভিডিও বানাচ্ছে, যেগুলো আরো অনেককে খারাপ পথে টেনে নিচ্ছে। বিষয়টি ব্যাপক আলোচনায় আসায় বাংলাদেশে তিন মাসের জন্য টিকটক লাইকি বন্ধ করে দেয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, গত ১১ মাসে দেড়শ জনের বেশি কথিত টিকটক অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যারা বিতর্কিত এই সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে অল্পবয়সী কিশোরী থেকে তরুণী ও মধ্যবয়সী নারীদের ফাঁদে ফেলে অনৈতিক সম্পর্ক করে আসছিল। এসব নারীর অনেককে পাচারও করা হয়েছে উন্নত জীবন যাপনের প্রলোভন দেখিয়ে। পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশে ‘জনপ্রিয়’ টিকটকারদের বেশির ভাগই অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত। কেউ সেলুনে কাজ করে, কেউ দিনমজুরের কাজ করে। কেউবা কোনো দোকানের বিক্রয়কর্মী। এর বাইরে স্কুল, কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও কেউ কেউ টিকটকে নিজেদের বিলিয়ে দিচ্ছে। কম গতির ইন্টারনেটেও টিকটক-লাইকি অ্যাপ চালানো ও ভিডিও আপলোড করার সুযোগ থাকায় ঢাকার বাইরে এমনকি গ্রাম পর্যন্ত এদের ব্যবহারকারী বেড়ে চলেছে।

গত মে মাসে ভারতের বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশি ২২ বছরের এক তরুণীকে বিবস্ত্র করে যৌন নির্যাতনের ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয়। এ ঘটনায় দু’জন নারীসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে ভারতের পুলিশ। তাদের সবাই ছিল বাংলাদেশি। তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানায় এই চক্রের মূলহোতা রিফাতুল ইসলাম হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় বাবু। ওই তরুণীকে এরাই ভারতে নিয়ে যায়। এরপরই টিকটকের মাধ্যমে অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও মানব পাচারের মতো চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসে।

টিকটক হৃদয় মূলত নির্যাতনের শিকার তরুণীকে টিকটকের ফাঁদে ফেলে ভারতে নিয়ে যায়। এরপর সেখানে উচ্চ বেতনে চাকরি দেবার কথা বলে অন্যত্র বিক্রি করে দেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু ওই তরুণী তাতে রাজি না হওয়ায় তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে সেই ভিডিও ভাইরাল করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে এসব ঘটনায় রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় পৃথক দুটি মামলা হয়। এই মামলায় প্রায় ডজনখানেক টিকটকারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। যাদের সবাই টিকটকের আড়ালে পাশের দেশে নারী পাচার ও অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পৃথক অভিযানে গ্রেপ্তার টিকটকারদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দেখা গেছে, দেশে টিকটকের আড়ালে মানবপাচার ও অনৈতিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মূলহোতা টিকটক হৃদয়, নদী আক্তার, বস রাফি, ম্যাডাম সাহিদা। এদের মধ্যে ২৮ মে ভারতে হৃদয় গ্রেপ্তার হয় এবং ২২ জুন নদী আক্তার ও ৩১ মে রাফি ও ম্যাডাম সাহিদা গ্রেপ্তার হন র‌্যাবের হাতে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, সারা দেশ থেকে টিকটকের আড়ালে এসব চক্রের মাধ্যমে এরই মধ্যে কয়েক হাজার মেয়ে পাচার হয়েছে। রাফির মাধ্যমে পাঁচ শতাধিক নারীকে পাচার করা হয়েছে। আর ম্যাডাম সাহিদার দুই মেয়ে সোনিয়া ও তানিয়া পাচারচক্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও সক্রিয়ভাবে জড়িত। সাহিদা দেশে একটি সেফ হাউস পরিচালনা করত, আর তার দুই মেয়ের ভারতে রয়েছে সেফ হাউস।

এ ঘটনায় র‌্যাবের পক্ষ থেকে সাংবাদিক সম্মেলনে জানানো হয়, মূলত টিকটক ভিডিও তৈরি করতে গিয়ে তরুণ-তরুণীরা একটি ফেইসবুক গ্রুপে যুক্ত হয়। গ্রুপটির মূল পৃষ্টপোষক আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রটি। এই গ্রুপের অ্যাডমিনের তত্ত্বাবধানে গত বছরের শেষের দিকে ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলার একটি রিসোর্টে ৭০০/৮০০ জন তরুণ-তরুণী পুল পার্টিতে অংশ নেয়। ওই পার্টির অন্যতম সমন্বয়কারী ছিল রিফাতুল ইসলাম ওরফে টিকটক হৃদয় বাবু। পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, এই গ্রুপে সুনির্দিষ্ট কিছু সদস্য আছে, যারা গ্রুপের নারী সদস্যদের ভারতের বিভিন্ন মার্কেট, সুপার শপ, বিউটি পার্লারে ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দিয়ে পাচার করে। আরো বলা হয়, এই চক্রের মূল আস্তানা ব্যাঙ্গালুরুর আনন্দপুর এলাকায়। মূলত যৌনবৃত্তিতে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যেই বিভিন্ন বয়সের মেয়েদেরকে ভারতে পাচার করা হয়। চক্রটি ভারতের কয়েকটি রাজ্যের কিছু হোটেলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। যে হোটেলগুলোতে চাহিদা মাফিক বিভিন্ন বয়সের মেয়েদেরকে পাঠানোর তথ্য পেয়েছে পুলিশ। পুলিশ সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্য পেয়েছে দাবি করে কর্মকর্তারা বলেন, পাচার হওয়া মেয়েদের আনন্দপুরে নিয়ে যাওয়ার পর কৌশলে নেশাজাতীয় বা মাদকদ্রব্য সেবন করিয়ে বা জোর পূর্বক বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারন করে। ভাইরাল হওয়া ওই ভিডিওটি দেখার পর প্রথম পদক্ষেপ নেয় আসাম পুলিশ। ওই ভিডিও থেকে পাঁচ নিপীড়কের ছবি প্রকাশ করে তাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য টুইটারে পুরস্কারের ঘোষণা দেয় তারা। হিন্দুস্থান টাইমসের খবরে বলা হয়, ওই ভিডিওর উৎস খুঁজতে গিয়ে আসাম পুলিশ জানতে পারে, নির্যাতনে জড়িতরা আছে বেঙ্গালুরুতে। তারপর সেই তথ্য কর্ণাটক পুলিশকে সরবরাহ করে তারা। পরে বেঙ্গালুরু পুলিশ ওই ভিডিওর সূত্র ধরে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে।

এদিকে গত ১৫ নবেম্বর রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে টিকটক রাজ ওরফে আব্দুর রাকিব ওরফে খোকন (২৬) নামে এক টিকটকারকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তার কাছ থেকে র‌্যাবের ইউনিফর্ম, প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত মোবাইল, সিম ও বাঁশি জব্দ করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভুয়া পরিচয়ে টিকটক করে প্রতারণা ও শতাধিক নারীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করে ব্ল্যাকমেইল ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার রাজ বিজিবির ল্যান্স নায়েক হিসেবে র‌্যাবে প্রেষণে বদলি হন বলে পরিচয় দিতেন। র‌্যাবের ইউনিফর্ম পরে টিকটক ভিডিও তৈরি করে প্রতারণা করে বিয়ে করেন চারটি ও শতাধিক মেয়ের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক করে প্রতারণা করেছেন।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে টিকটক সেলিব্রিটি বানানোর নামে বিভিন্ন দেশে নারীপাচার চক্রের মূলহোতা আশরাফুল মন্ডল ওরফে বস রাফি, ম্যাডাম সাহিদা ও টিকটক হৃদয় বাবুর সহযোগী অনিকসহ বেশ কয়েকটি নারীপাচার চক্রের ৬৬ জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল সোমবার র‌্যাব-২ ও ৫ এর যৌথ অভিযানে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে টিকটকার রাজকে গ্রেফতার করা। টিকটকে নিজেকে র‌্যাবের সদস্য পরিচয়ে শতাধিক নারীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক তৈরি, ছবি ও ভিডিও ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেইল ও অর্থ আত্মসাতের বহু অভিযোগ রয়েছে। কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, টিকটকার রাজ পেশায় বগুড়ার একটি আবাসিক হোটেলের নিরাপত্তা কর্মী। কিন্তু র‌্যাবের ইউনিফর্ম পরে নিজেকে র‌্যাব-৫ এ কর্মরত হিসেবে পরিচয় দিয়ে আসছিল।

গত দুবছর ধরে সে টিকটক, ফেসবুক, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন মাধ্যমে র‌্যাবের পরিচয় দিত। টিকটকে রাজের প্রায় ২ মিলিয়নের অধিক ভিউ ও প্রায় দেড় মিলিয়ন ফলোওয়ার রয়েছে। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও নিজেকে উচ্চবিত্ত পরিচয় দিত। এ পরিচয় ফুটিয়ে তুলতে বিভিন্ন আলিশান বাড়ির সামনে ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অফিসের সামনে যেয়ে ভিডিও তৈরি করতো। কমান্ডার মঈন আরও বলেন, রাজ টিকটকে বিভিন্ন মেয়ের মধ্য থেকে যারা দামি অলংকার পরিধান করত ও যেসব মেয়ের অবস্থা ভালো তাদের টার্গেট করত। এরপর তাদের বিভিন্ন প্রলোভনে প্রলুব্ধ করে তাদের সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে হার, অলংকার ও অর্থ আত্মসাৎ করত।

https://dailysangram.info/post/476279