৩ জানুয়ারি ২০২২, সোমবার, ৪:০৪

আবারও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন কমিশন

আশিকুল হামিদ : দেশে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রীতিমতো নাটক জমিয়ে তোলা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন বিরোধী দলের নেতারা। সরকার-সমর্থক নন এমন বুদ্ধিজীবীরাও অভিযোগের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, সবকিছুর পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদকে সামনে রেখে সরকারের একটি কৌতূহলোদ্দীপক উদ্যোগ। সরকার নির্বাচন কমিশন গঠন করার জন্য একটি সার্চ কমিটি গঠন করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের রেখে যাওয়া জাতীয় পার্টি এবং বিএনএফ ধরনের নামসর্বস্ব কয়েকটি দল ছাড়া কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলই রাষ্ট্রপতির ডাকে সাড়া দেয়নি। তার আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকেও অংশ নেয়নি। আওয়ামী লীগের অনুগ্রহে মন্ত্রিত্ব পাওয়া নেতা হাসানুল হক ইনুর দল জাসদ পর্যন্ত শর্ত আরোপ করেছে।

ওদিকে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও জনসমর্থিত দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়ে দিয়েছেন, তাদের দল রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশ নেবে না। কঠোর এ সিদ্ধান্তের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ১ জানুয়ারি মির্জা আলমগীর জানিয়েছেন, এর আগের দুটি নির্বাচন কমিশন গঠন করার সময় বিএনপি সুস্পষ্টভাবে লিখিত প্রস্তাব পেশ করেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করার মধ্য দিয়ে একদিকে রাষ্ট্রপতি তার ঘোষিত অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছেন, অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনও তার স্বাধীন অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি।

কমিশন বরং সরকারের সেবাদাসের ভূমিকা পালন করেছে। এই অভিজ্ঞতার কারণে বিএনপি মনে করে, আওয়ামী লীগ সরকার প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রসম্মত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। সুতরাং বর্তমান সরকারের আমলে কোনো স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করাও সম্ভব নয়। সেজন্যই বিএনপি এবং তার জোটভুক্ত দলগুলো রাষ্ট্রপতির আহ্বানে সাড়া দেয়নি। বঙ্গভবনে অনুষ্ঠানরত গোলটেবিল বৈঠকেও অংশ নেয়নি। দলগুলো বরং সোজা না করে দিয়েছে।

ওদিকে প্রকাশিত বিভিন্ন খবরে জানা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করা নিয়ে নির্বাচন কমিশন এরই মধ্যে ‘দিশেহারা’ হয়ে পড়েছে। হত্যা-সংঘাতসহ আইন-শৃংখলা পরিবেশ সামাল দেয়ার ব্যাপারে হিমশিম খাচ্ছে কমিশন। পুলিশ ও প্রশাসন নাকি কমিশনের কথা শুনছে না, নির্দেশও মানছে না। বলা হচ্ছে, কমিশন যদি শুরু থেকেই আইনের প্রশ্নে কঠোর হতো তাহলে পরিস্থিতির এত গুরুতর অবনতি ঘটতে পারতো না। অন্যদিকে কমিশনের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে সেবাদাসের ভূমিকা পালনের অনস্বীকার্য অভিযোগ উঠেছে। আর সে কারণেই বিনাভোটে নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা ক্রমাগত বেড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন পর্যবেক্ষকরা। একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, পাঁচ ধাপের নির্বাচনে তিন হাজার ৭৪৪ জন প্রতিনিধির মধ্যে এক হাজার ৫৫৫ জনই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। একটি প্রধান জাতীয় দৈনিকের শীর্ষ রিপোর্টের শিরোনাম করা হয়েছে, ‘বিনা ভোটেই ৩৪৮ চেয়ারম্যান’!

এভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার কারণেও ইউপি নির্বাচনের ব্যাপারে ভোটার জনগণের আগ্রহ কমে গেছে। এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকÑসুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, দিশেহারা নির্বাচন কমিশন আসলে ‘নির্বাসনে’ রয়েছে। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের প্রাসঙ্গিক মন্তব্যও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। গত ২৮ ডিসেম্বর আইন-শৃংখলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকশেষে একটি বাংলা প্রবাদ স্মরণ করিয়ে দিয়ে চট্টগ্রামে তিনি বলেছেন, যার শেষ ভালো তার সব ভালো। নিজের এ মন্তব্যের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মাহবুব তালুকদার বলেছেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের আয়ুষ্কাল রয়েছে মাত্র ৫৫ দিন। সে কারণেই কমিশনের উচিত চলমান ইউপি নির্বাচনের সুষ্ঠু আয়োজনের ব্যাপারে সচেষ্ট হওয়া।

অন্যদিকে সম্প্রতি রাজধানীতে অনুষ্ঠিত এক গোলটেবিল আলোচনায় দেশের বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, সংবিধানে জনগণকে সকল ক্ষমতার উৎস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলেও বর্তমান সরকারের কণ্ঠরুদ্ধ করার কর্মকান্ডের পরিণতিতে জনগণ তো ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েছেই, দেশও গণহীন গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ‘স্বাধীন’ নামের নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা প্রসঙ্গে বিশিষ্টজনেরা অভিযোগ করেছেন, নির্বাচন কমিশন স্বেচ্ছাচারী সরকারের ‘তোতা পাখির’ ভূমিকা পালন করছে। সে কারণে কমিশনের অভিসন্ধি নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। বলা হচ্ছে, কমিশন হয়তো দলহীন গণতন্ত্র চাচ্ছে!

নিজেদের বক্তব্যের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করা। অন্যদিকে বাস্তব ক্ষেত্রে কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ সেবাদাসের ভূমিকা পালন করে চলেছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনসহ বিভিন্ন ভোটের সময় বারবার অভিযোগ জানানো হলেও কমিশন কোনো ভোটকেন্দ্রেই কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পাশাপাশি সামগ্রিক কার্যক্রমের পরিপ্রেক্ষিতেও বিশিষ্টজনেরা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব, ভূমিকা ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। উদাহরণ হিসেবে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন সংক্রান্ত আইনের উল্লেখ করে বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, কিছুদিন পরপর নতুন নতুন শর্ত চাপিয়ে কঠিন আইন তৈরি করা কমিশনের কাজ হতে পারে না। গণতন্ত্রেও এ ধরনের আইন সমর্থনযোগ্য নয়। ওই সেমিনারে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং কৌতূহলোদ্দীক মন্তব্য করেছেন সরকার সমর্থক একজন প্রবীণ রাজনীতিক। তিনি বলেছেন, নিবন্ধন ছাড়াই পাকিস্তান আমলে তারা জেল খেটেছেন, মামলার শিকার হয়েছেন এবং করেছেন স্বাধীনতাযুদ্ধও। যুদ্ধের ফসল সে একই দেশে নিবন্ধনের নামে রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি রাজনীতিকদেরও ‘খেলো’ তথা অসম্মানিত করা হচ্ছে!

নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন আইন ও কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। সরকারের আজ্ঞাবহ সেবাদাসের ভূমিকা পালন বন্ধ করার পাশাপাশি অন্য কিছু বিষয়েও কমিশনকে তারা নীতি-কৌশল ও কার্যক্রমে পরিবর্তন আনার দাবি জানিয়েছেন। রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন সংক্রান্ত আইন প্রসঙ্গে তারা বলেছেন, এমন ব্যবস্থাই থাকা দরকার যাতে শুধু নির্বাচনের প্রাক্কালে কিংবা বছরের বিশেষ কোনো সময়ে নয় বরং রাজনৈতিক দলগুলো সারা বছরই নিবন্ধন করার সুযোগ পায়।

এক শতাংশ ভোটার বা সমর্থকের নাম-ঠিকানাসহ তালিকা দেয়ার ব্যাপারেও আপত্তি তুলেছেন বিশিষ্টজনেরা। বলেছেন, কোনো দলের জনসমর্থন আছে কি না, থাকলেও কত শতাংশ রয়েছে- এ ধরনের বিষয় দেখার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের নয়। কমিশনের দায়িত্ব অবাধ, সুষ্ঠু ও সরকারের প্রভাবমুক্ত নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা। সে নির্বাচনেই দেখা যাবে, কোন দলের কতটা জনসমর্থন রয়েছে। এটা আগে থেকে নির্ধারণ করার বিষয় হতে পারে না। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন তার আসল কাজে চরম অবহেলা দেখিয়ে সরকারের হুকুম তামিল করার, গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠানোর এবং দেশকে দলহীন করার কর্মকান্ডে ব্যস্ত রয়েছে।

দেশপ্রেমিক ও গণতন্ত্রকামী সাধারণ মানুষও বিশিষ্টজনদের মূলকথাগুলোর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। তারাও মনে করেন, কমিশনের উচিত অনতিবিলম্বে নীতি-কৌশল ও কার্যক্রমে পরিবর্তন ঘটানো এবং রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি গণতন্ত্রের অভিভাবকের দায়িত্ব পালনের প্রধান কাজের ব্যাপারে মনোযোগী হওয়া। এটা এই সময়ে বেশি প্রয়োজন এজন্য যে, ২০২৩ সালে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সে নির্বাচনও যদি সরকার নিয়ন্ত্রিত হয় এবং নির্বাচন কমিশন যদি আরো একবার আজ্ঞাবহ সেবাদাসের ভূমিকাই পালন করে তাহলে গণতন্ত্র তো বাধাগ্রস্ত হবেই, কমিশনের পক্ষেও দায় এড়ানো সম্ভব হবে না।

আমরা আশা করতে চাই, ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা পূরণ করার জন্য এতদিন যা কিছুই করে থাকুক না কেন, নতুন কমিশন তার সব কাজে নিজের আইন মেনে চলবে এবং প্রতিটি নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার লক্ষ্যে সততার সঙ্গে সচেষ্ট হবে। চলমান ইউপি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা কিন্তু অমন কোনো আশাবাদকে শক্তি যোগায় না। কারণ, পঞ্চম ধাপের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পরও নির্বাচন কমিশনের ভাবমর্যাদাকে সমুন্নত করার কোনো চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ক্ষমতাসীনরা বরং কোনোভাবে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। বলা হচ্ছে, এভাবে আরো একটি ‘নূরুল হুদা কমিশন’ গঠন করা হলে হত্যা-সন্ত্রাসমুক্ত এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে যাবে। বড় কথা, তেমন কোনো পদক্ষেপ গণতন্ত্রের জন্য কল্যাণকর হবে না। এজন্যই রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সরকারের উচিত স্বাধীন ও শক্তিশালী একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করার ব্যাপারে সততার সঙ্গে সচেষ্ট হওয়া।

https://dailysangram.info/post/476253