২ জানুয়ারি ২০২২, রবিবার, ১:২৯

‘কদম’ ও ‘কুঞ্জলতা’ ফেরি নির্মাণে দুর্নীতি

আয়ুষ্কাল ও গতি কমছে দ্রুত

চুক্তির আগেই চারটি মেইন ইঞ্জিন ও গিয়ারবক্স আমদানির এলসি সম্পন্ন

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) দুটি মাঝারি ফেরি নির্মাণে গুরুতর অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গেছে। কদম ও কুঞ্জলতা নামের ফেরি দুটিতে ৫০০ (এইচপি) হর্স পাওয়ার ক্ষমতার চারটি মেইন ইঞ্জিন (প্রতি ফেরিতে দুটি মেইন ইঞ্জিন) স্থাপনের চুক্তি ছিল নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। চুক্তির শর্ত ভেঙে প্রতিটিতে স্থাপন করা হয়েছে ৪৫০ হর্স পাওয়ার (অশ্বশক্তি) ক্ষমতার ইঞ্জিন। এতে দুটি ফেরির মেইন ইঞ্জিনের ১০০ হর্স পাওয়ার করে ক্ষমতা কমেছে। ইঞ্জিনের সঙ্গে লাগানোর কথা ছিল জেডএফ ৫০০ মডেলের জার্মানির তৈরি গিয়ারবক্স। সেখানে স্থাপন করা হয়েছে সুইডেনের তৈরি জেডএফ ৩৫০-১ মডেলের (আকারে ছোট) গিয়ারবক্স। ফলে ফেরির গতি কমেছে। সেই সঙ্গে কমছে আয়ুষ্কালও। এছাড়া কম হর্স পাওয়ারের ইঞ্জিন হওয়ার কারণে মাওয়া-কাঁঠালবাড়ী রুটে প্রবল স্রোতের সময় গাড়িবোঝাই ফেরি দুটির নিয়ন্ত্রণ রাখাও কঠিন হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিআইডব্লিউটিসির সাত সদস্যের পরিদর্শন কমিটির প্রতিবেদন, মেশিন আমদানি সংক্রান্ত কাগজপত্রের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ এবং যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে উল্লিখিত সব তথ্য।

ইঞ্জিন স্থাপনের আগেই পরিদর্শন কমিটির সদস্যরা নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের কাছে চুক্তির চেয়ে দুর্বল ইঞ্জিন আনার ব্যাপারে ব্যাখ্যা চাওয়ার সুপারিশ করে প্রতিবেদন জমা দেন। এরপরও শর্তসাপেক্ষে ইঞ্জিনগুলো স্থাপনের অনুমতি দেন প্রকল্প পরিচালক ও বিআইডব্লিউটিসির প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল গফুর সরকার। এখানেই শেষ নয়, ফেরি দুটির ডিজাইন পরিবর্তন না করে দুটি বাড়তি কক্ষ তৈরির নামে ৩ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে।

জানা যায়, বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি যখন তুঙ্গে, তখন এই ইঞ্জিনগুলোর (পিএসআই) জাহাজীকরণ-পূর্ব পরিদর্শন বাতিল করা হয়। এই সুযোগে ফেরি নির্মাণ প্রকল্পের কর্মকর্তাদের ‘মোটা টাকায় ম্যানেজ’ করে ইঞ্জিনগুলো এনে স্থাপন করা হয়। সবচেয়ে অবাক করার মতো তথ্য হচ্ছে, কাজ পাওয়ার আগেই চারটি মেইন ইঞ্জিন ও গিয়ারবক্স আমদানির এলসি করে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান হাইস্পিড শিপবিল্ডিং অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড। এতে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ও সরকারি সংস্থা বিআইডব্লিউটিসির অসৎ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে দুর্নীতির বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ইঞ্জিন ও গিয়ারবক্স পরিদর্শন কমিটির সদস্য প্রকৌশলী স্বদেশ প্রসাদ মণ্ডল যুগান্তরকে বলেন, ‘পরিদর্শনে ইঞ্জিন ও গিয়ারবক্সের কিছু অসামঞ্জস্য পাওয়া গিয়েছিল। চুক্তির চেয়ে কম হর্স পাওয়ারের ইঞ্জিন এবং আকারে ছোট গিয়ারবক্সের বিষয়টি আমরা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলাম। কিন্তু পরে কর্তৃপক্ষ আলাদা একটি কমিটির মাধ্যমে ট্রায়াল রিপোর্ট তৈরি করে ইঞ্জিন ও গিয়ারবক্স গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করে।’ কমিটি কীভাবে বেঞ্চ টেস্ট ছাড়া ইঞ্জিনের গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করল এবং তাদের প্রতিবেদনে ‘ট্রায়ালে প্রাপ্ত ফলাফল বেঞ্চ টেস্ট রিপোর্টের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ’ বলে উল্লেখ করলেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওই কমিটিতে আমি ছিলাম না। তবে যে প্রক্রিয়ায় গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করা হয়েছে তাতে বেঞ্চ টেস্টের সমতুল্য বলে প্রতিবেদন দেওয়াটা সমীচীন হয়নি।’

ফেরি নির্মাণ প্রকল্পের কাগজপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর বিআইডব্লিউটিসির সঙ্গে বেসরকারি সংস্থা হাইস্পিড শিপবিল্ডিং অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে ফেরি নির্মাণের লিখিত চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী মেইন ইঞ্জিন লাগানোর কথা সুইডেনের তৈরি স্ক্যানিয়া, ডি১১৩ ০৭০এম, এইচপি-৫০০, আরপিএম-১৮০০ মডেলের। আর জার্মানির তৈরি জেডএফ-৫০০ মডেলের গিয়ারবক্স লাগানোর কথা। অথচ চুক্তির আগের দিন ১৮ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটি চারটি মেইন ইঞ্জিন ও গিয়ারবক্স আমদানির এলসি করে। কাজ পাওয়ার আগেই খোলা এলসির কাগজপত্রেও লুটপাটের পরিকল্পনার বিষয়টি স্পষ্ট। ইনভয়েসে দেখা যায়, সুইডেনের স্ক্যানিয়া কোম্পানি থেকে ডি১১৩ ০৭০এম, ৩৩১কেডব্লিউ (কিলোওয়াট)/৫০০ এইচপি (হর্স পাওয়ার), ১৮০০ আরপিএম (রেভুলেশন পার মিনিট) মডেলের চারটি মেইন ইঞ্জিন ও জেডএফ-ডব্লিউ৩৫০-১ মডেলের গিয়ারবক্স অর্ডার করা হয়। পরিবহণ ব্যয়সহ এগুলোর আমদানি মূল্য ৩ লাখ ১০ হাজার ইউরো। ১ ইউরো ৯৭ টাকা (বর্তমান দর) হিসাবে মোট মূল্য দাঁড়ায় ৩ কোটি ৭০ হাজার টাকা। ইঞ্জিনগুলো সরবরাহের আগে করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়লে পিএসআই করতে পারেনি বিআইডব্লিটিসি। পিএসআই ছাড়াই ইঞ্জিন ও গিয়ারবক্স দেশে আনে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। এ অবস্থায় গত বছরের ৬ আগস্ট ইঞ্জিন ও গিয়ারবক্সগুলো স্থাপনের আগে পরিদর্শনপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গঠনের অফিস আদেশে সই করেন বিআইডব্লিউটিসির প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল গফুর সরকার। তিনি নিজেও কমিটির সদস্য।

পরিদর্শন কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের ১৯ আগস্ট কমিটির সদস্যরা নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের শিপইয়ার্ডে গিয়ে চারটি মেইন ইঞ্জিন ও গিয়ারবক্স পরিদর্শন করেন। ২৭ আগস্ট তারা আমদানি সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্ট পর্যালোচনা করেন। সাউথ ইস্ট ব্যাংকের এলসি ডকুমেন্ট ও প্যাকেজিং লিস্ট সংগ্রহ করে কমিটি। তদন্তে বেরিয়ে আসে ডি১১৩ ০৭০এম, ৩৩১ কেডব্লিউ/৫০০ এইচপি (হর্স পাওয়ার), ১৮০০ আরপিএম মডেলের ইঞ্জিন আমদানি করা হয়েছে। কিন্তু ইঞ্জিনের গায়ে জালিয়াতির মাধ্যমে ৩৬৮ কেডব্লিউ (কিলোওয়াট) স্টিকার লাগানো হয়েছে। কারণ ৩৬৮ কিলোওয়াট ৫০০ হর্স পাওয়ারের সমান। আর আমদানি করা হয়েছে ৩৩১ কিলোওয়াট অর্থাৎ ৪৫০ হর্স পাওয়ার। তদন্তে এই দুর্নীতি উঠে এলে প্রতিবেদনে নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়ার সুপারিশ করা হয়। প্রতিবেদনে আব্দুল গফুর সরকারও সই করেন। তখন তিনি প্রধান প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) ছিলেন। এই গফুর সরকারই সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব পাওয়ার পর গত বছরের ১৫ অক্টোবর এক আদেশে শর্তসাপেক্ষে ইঞ্জিন ও গিয়ারবক্সগুলো লাগানোর অনুমতি দেন। শর্তে বলা হয়, চারটি ইঞ্জিন দুটি ফেরিতে স্থাপনের পর টেস্ট ও ট্রায়ালে বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃক কমিটির উপস্থিতিতে ইঞ্জিন ক্যাপাসিটি ৫০০ হর্স পাওয়ার প্রমাণ করতে হবে। ব্যর্থতায় চারটি ইঞ্জিন পরিবর্তন করে দিতে হবে। ৫০০ হর্স পাওয়ার প্রমাণ করার আগ পর্যন্ত ইঞ্জিনের চুক্তিমূল্য পরিশোধ করা হবে না।

অভিযোগ উঠেছে, মোটা টাকার চুক্তিতে ইঞ্জিনগুলো ফেরিতে স্থাপনের সুযোগ করে দেন আব্দুল গফুর সরকার। এরপর টেস্ট ট্রায়ালের নামে সাত সদস্যের আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটির সদস্য সচিবও হন তিনি নিজেই। এই কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘চুক্তি অনুযায়ী ইঞ্জিনের হর্স পাওয়ার ৫০০ বা ৩৬৮ কিলোওয়াট। ট্রায়ালে ইঞ্জিন আউটপুট পাওয়ার ৩৬৩ কিলোওয়াট পাওয়া গেছে, যা চুক্তি থেকে ১.৫৩ শতাংশ কম। যা গিয়ার ও অন্যান্য মুভিং পার্টসের ফ্রিকশন এবং ফুয়েলের গুণগত মানের ওপর নির্ভরশীল। ট্রায়ালে পাওয়া ফলাফল বেঞ্চ টেস্ট রিপোর্টের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।’ এভাবে গোঁজামিল দিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের বিল পরিশোধ করা হয়।

ইঞ্জিনের সক্ষমতা যাচাইয়ে গঠিত পরিদর্শন কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, চুক্তির চেয়ে কম হর্স পাওয়ারের ইঞ্জিন আমদানির বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পরও শর্তসাপেক্ষে ইঞ্জিনগুলো ফেরিতে লাগানোর অনুমতির বিষয়টি ভাউতাবাজি ছাড়া আর কিছুই না। কমিটির সদস্য হিসাবে যিনি (আব্দুল গফুর সরকার) সব ডকুমেন্টে ৩৩১ কিলোওয়াট বা ৪৫০ হর্স পাওয়ারের ইঞ্জিন আমদানির তথ্য নিশ্চিত হলেন, তিনি কীভাবে পরবর্তী সময়ে ইঞ্জিনগুলো ৫০০ হর্স পাওয়ার বলে মেনে নিয়ে বিল পরিশোধে সম্মতি দিলেন। তাছাড়া ইঞ্জিনের হর্স পাওয়ার নির্ণয়ের একমাত্র স্বীকৃত পদ্ধতি হচ্ছে ‘বেঞ্চ টেস্ট’। বেঞ্চ টেস্ট ছাড়া কীভাবে ট্রায়াল কমিটি রিপোর্ট দিল এবং তাতে উল্লেখ করল প্রাপ্ত ফলাফল বেঞ্চ টেস্ট রিপোর্টের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কমিটির ওই সদস্যের মতে, গোঁজামিলের মাধ্যমে নির্মাণ প্রতিষ্ঠানকে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে প্রকল্প পরিচালক আব্দুল গফুর সরকার দুটি ফেরি নির্মাণ প্রকল্প থেকে অন্তত ৫ কোটি টাকা পকেটে তুলেছেন।

জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিসির প্রধান প্রকৌশলী এবং ফেরি কদম ও কুঞ্জলতা নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক আব্দুল গফুর সরকার যুগান্তরকে বলেন, ফেরি নির্মাণে কোনো অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়নি। একটি মহল মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করতে চাইছে। যারা এ কথা বলছে, তারা কিছু বুঝে না। অভিযোগের সপক্ষে কোনো প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবে না।’ পরিদর্শন কমিটির সদস্য হিসাবে আপনি প্রতিবেদনে চুক্তির চেয়ে কম হর্স পাওয়ারের ইঞ্জিন আমদানির কথা উল্লেখ করেছেন. অথচ ট্রায়াল কমিটির সদস্য হিসাবে আপনি কীভাবে বলেছেন ইঞ্জিনের হর্স পাওয়ার ঠিক আছে-এমন প্রশ্ন করলে উত্তেজিত হয়ে তিনি বলেন, কমিটিতে বুয়েট শিক্ষকও ছিলেন। তারা বলেছেন ঠিক আছে। কমিটিতে যারা ছিলেন তারা তো ঘাস খেয়ে ইঞ্জিনিয়ার হননি।’ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত বেঞ্চ টেস্ট ছাড়া কীভাবে ইঞ্জিনের সক্ষমতা সম্পর্কে ট্রায়ালে প্রাপ্ত ফলাফলকে বেঞ্চ টেস্টের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করলেন-এমন প্রশ্ন করতেই অকথ্য ভাষা প্রয়োগ করে তিনি বলেন, ‘আপনি কি ইঞ্জিনিয়ার যে ইঞ্জিনিয়ারদের সব ভাষা বুঝবেন।’ মোটা টাকায় ম্যানেজ হয়ে কম হর্স পাওয়ারে ইঞ্জিন স্থাপনে নির্মাণ প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ করে দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি। প্রসঙ্গত, গত বছরের মাঝামাঝি ফেরি দুটি চলাচল শুরু করে। বর্তমানে মাওয়া-কাঁঠালবাড়ী রুটে ফেরি দুটি চলছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/504157