২ জানুয়ারি ২০২২, রবিবার, ১:২৪

কক্সবাজার পর্যটনে নৈরাজ্য ॥ বহুমুখী সংকটে লাইফগার্ড কার্যক্রম

দেশের বৃহৎ পর্যটন অঞ্চল কক্সবাজারে পর্যটক ও পর্যটন শিল্পকে ঘিরে নৈরাজ্য থেমে নেই। হোটেল মোটেল জোনে দালাল সিন্ডিকেটের অত্যাচার আর দর্শণীয় স্থানগুলোতে মনোরঞ্জনের নামে অনিরাপদ বেশকিছু ইভেন্ট মাথাছাড়া দিয়ে উঠেছে। এসব ইভেন্টে বিনোদন নিতে গিয়ে হতাহতের ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত। পর্যটন সংশ্লিষ্টদের অভিমত- প্রশাসন ঝুঁকি সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই এসব ইভেন্ট চালু করার সুযোগ দিয়েছে। অন্যদিকে সমুদ্রস্নানে আগ্রহী পর্যটকদের নিরাপত্তায় সরকারি ভাবে কোনো উদ্যোগও এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। উপরন্তু যেসকল বেসরকারি লাইফগার্ড কিংবা ডুবুরি সংস্থা সাগরে নামা পর্যটকদের নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারাও আর্থিক যোগানের অভাবে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হচ্ছে বলে প্রতিবেদককে জানিয়েছেন। ফলে একদিকে যেমন নাম খারাপ হচ্ছে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পের অন্যদিকে লাইফগার্ড কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে আরও বেশি অনিরাপদ হয়ে উঠবে কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতে গোসল করতে নামা পর্যটকদের জীবন।
লক্ষ্য করা গেছে- বয়সে তরুণ এবং অনভিজ্ঞ পর্যটকরাই এসব ঝুঁকিপূর্ণ ইভেন্টে বিনোদন নিতে পছন্দ করেন। যাদের সংখ্যা খুবই অল্প। বেশিরভাগ পর্যটকের অভিমত তারা কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, পাহাড় এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক পর্যটন কেন্দ্রগুলোই দেখতে আসেন। সাগরে গোসল করেন। পাহাড়ের চূড়ায় চড়ে দীর্ঘ সমুদ্রের নীল জলরাশি এবং বালিয়াড়ি অবলোকন করেন। পর্যটকদের মতে- কৃত্রিম রাইড কিংবা ইভেন্টগুলো দেশের বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রে পাওয়া যায়। এসব রাইড কক্সবাজারেও উপভোগ করতে হবে এমন কোনো কথা নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কক্সবাজার পর্যটন অঞ্চলের বেশকিছু ভ্রমণস্পটে ঝুঁকিপূর্ণ এবং অবৈধ ইভেন্ট চালু করার অনুমোদন দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কক্সবাজার বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটিকে টাকা দিয়ে এসব ইভেন্ট চালু করেছে কতিপয় মুনাফালোভী ব্যবসায়ী। কালের পরিক্রমায় এসব ব্যবসায় এখন তীব্র প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে প্রতিযোগীতা মূলক বাজারে যার যার অবস্থান সৃষ্টি করতে বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি এবং স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের কাছে মোটা অংকের টাকা নিয়ে দ্বারস্থ হচ্ছে এসব ব্যবসায়ী। এই সুযোগে মধ্যসত্ত্বভোগীরা পর্যটন কেন্দ্রিক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। কক্সবাজারের পর্যটনে সক্রিয় থাকা ইভেন্টগুলোর মধ্যে রয়েছে- সমুদ্র সৈকতের লাবনী, সুগন্ধা, কলাতলী, হিমছড়ি, ইনানী পয়েন্টে সহস্রাধিক বীচ বাইক, সুগন্ধা, লাবনী ও কলাতলী পয়েন্টে সাগরে চলমান জেটস্কি, দরিয়ানগর, দরিয়ানগর ব্লক এবং হিমছড়িতে প্যারাসেইলিং, রেজুখালে কায়াকিং এবং অতিসম্প্রতি সুগন্ধা পয়েন্টে চালু করা হয়েছে ফ্লাই ডাইনিং বা উড়ন্ত রেস্টুরেন্ট।
সর্বশেষ গত ২১ ডিসেম্বর সাগরে গোসল করতে নামা একদল পর্যটককে সজোরে ধাক্কা দেয় জেট স্কি। এতে ওই পর্যটক দলের ফাহিম নামে একজন গুরুত্বর আহত হয়। এমনকি অতিরিক্ত ক্ষরণের ফলে তাকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। এঘটনায় প্রশাসন তড়িঘড়ি করে জেট স্কি’র চলাচল নিষিদ্ধ করে। তবে এবিষয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে এটি সাময়িক ভাবে বন্ধ করা হয়েছে। পরে আবার সুযোগ বুঝে চালু করে দেওয়া হবে। এভাবে মাস খানেক আগে রামুর দরিয়ানগর সমুদ্রচর এলাকায় প্যারাসেইলিং করতে গিয়ে আহত হয় একাধিক পর্যটক। তারা প্যারাসেইলিং করতে গিয়ে উপর থেকে নীচে পড়ে গিয়ে আহত হয়েছিলেন। এই এলাকায় প্রথম প্যারাসেইলিং ইভেন্ট চালু করেন সরওয়ার নামে একজন। ঝুঁকির বিষয়ে কথা হলে তিনি প্রতিবেদককে বলেন- সামান্য ঝুঁকি তো অবশ্যই আছে। এছাড়াও অনভিজ্ঞ কর্মকৌশলীদের দ্বারা প্যারাসেইলিং পরিচালনা করলে বড় ধরণের দুর্ঘটনাও ঘটে যেতে পারে বলে স্বীকার করেন। পাশাপাশি দুর্ঘটনা কবলিত প্যারাসেইলিংটি তার নয়। ফরিদ কোম্পানী নামে একজন ওই ত্রুটিপূর্ণ প্যারাসেইলিং পরিচালনা করছেন বলে তিনি স্বীকার করেন।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়- সুগন্ধা পয়েন্টে কোনো ধরণের ঝুঁকি সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই ফ্লাই ডাইনিংটি চালু করা হয়েছে। কোনো ধরণের পরিবেশ ছাড়পত্র না নিয়েই নিজেদের মতো করে চালু করে দিয়েছে এই ইভেন্ট। স্থানীয় নেতা এবং প্রশাসনের উর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তাকে হাত করে একটি ট্যুরিজম প্রতিষ্ঠান উড়ন্ত সেতু নামে এই ঝুঁকিপূর্ণ আয়োজন পর্যটকদের সামনে এনেছে। উপভোগ করতে চাইলে দামও দিতে হচ্ছে চড়া। এই রেস্টুরেন্টে বসে খাবার গ্রহণ করতে প্রতিজন নূন্যতম ৬হাজার থেকে ১২হাজার টাকা পর্যন্ত গুনতে হয়। এক্ষেত্রেও ক্ষুন্ন করা হচ্ছে ভোক্তা অধিকার। প্রতিষ্ঠানটির অবৈধ তৎপরতার বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের কক্সবাজারের পরিচালক শেখ নাজমুল বলেন- উড়ন্ত রেস্টুরেন্ট নামে যে কার্যক্রম সুগন্ধা পয়েন্টে চালু করা হয়েছে তাদের ব্যাপারে শুনেছি। তারা এখনও পর্যন্ত কোনো পরিবেশ ছাড়পত্র নেয়নি। এছাড়াও ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনিরাপদ ইভেন্ট হিসেবে আমরাও তাদের অনুমোদন দেওয়া না দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে ভাবছি।
এদিকে ২০১৪ সাল থেকে বিদেশী ২টি এনজিও’র অর্থায়নে চলছিলো সমুদ্রে জীবন রক্ষায় তৎপর সী সেইফ লাইফগার্ড নামে একটি প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি বিদেশী এনজিওগুলো তাদের আর্থিক যোগান বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে শীঘ্রই মুখ থুবড়ে পড়তে যাচ্ছে পর্যটকদের সাগরে ঝুঁকি মোকাবেলায় তৎপর বেসরকারী এই প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমও। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ইমতিয়াজ আহমেদ জানিয়েছেন- তারা দীর্ঘদিন ধরে ৩২জন প্রশিক্ষিত ডুবুরি এবং ১০জন স্বেচ্ছাসেবী সাগরে পর্যটকদের ঝুঁকি মোকাবেলায় কাজ চালিয়ে আসছিলো। উপকরণ সংকট থাকা সত্বেও তারা নানা ভাবে কর্মদক্ষতার মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ২২৪জন পর্যটককে সাগরে ভেসে যাওয়া থেকে জীবিত উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। ৩৭৭ জন স্থানীয় দর্শনার্থীকে উদ্ধার করেছে। ৬৭জনকে প্রাথমিক সেবা দিয়েছে এবং ২১ লক্ষ মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিদিন বেড়াতে আসা পর্যটকদের মাঝে জোয়ার ভাটা ঘোষণা দেওয়া এবং নিরাপদ গোসলের দিক নির্দেশনা দিয়ে আসছে তারা। ইমতিয়াজ আরও বলেন- যদি পর্যাপ্ত রেসকিউ টিউব এবং রেসকিউ বোর্ড সরবরাহ করা হয় তাহলে কার্যক্রম আরও বেগবান করা সম্ভব হবে। আর্থিক যোগান তো অবশ্যই দরকার।
পর্যটনে ঝুঁকিপূর্ণ ইভেন্ট এবং নিরাপদ পর্যটন গড়ে তুলতে ঝুঁকি মোকাবেলায় তৎপর প্রতিষ্ঠানগুলোকে কীভাবে সুনজরে আনা যায় জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবু সুফিয়ান বলেন- লাইফগার্ডের বিষয়টি আমাদের নজরে রয়েছে। কোনো ভাবেই এই কার্যক্রম বন্ধ হতে দেওয়া যাবে না। এছাড়াও ঝুঁকিপূর্ণ ইভেন্টগুলোর ব্যাপারে বলেন- এগুলো তাৎক্ষণিক বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে ঝুঁকি সম্ভাব্যতা যাচাই করে যেটি নিরাপদ মনে হবে চালু রাখা হবে। আর যেটি অনিরাপদ প্রাণহানীকর সেটি বন্ধ করে দেওয়া হবে।

https://dailysangram.com/post/476149