২ জানুয়ারি ২০২২, রবিবার, ১:২৩

ফিরে দেখা-২০২১

শ্রমবাজার ও উড়োজাহাজ ব্যবসা এগিয়ে গেলেও শ্রমিক ভোগান্তি বছরজুড়ে

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বাংলাদেশের শ্রমবাজার ও উড়োজাহাজ (অ্যাভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিজ) ব্যবসা একেবারে খাদের কিনারে পড়েছিল ২০২০ সালে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এই দুই সেক্টরসহ দেশের সব পেশার বেশির ভাগ মানুষ ছিলেন আতঙ্কিত। কিন্তু ২০২১ সাল শুরুর পরই সেই মহাসঙ্কট কাটিয়ে আবারো শ্রমবাজার এবং অ্যাভিয়েশন সেক্টর গতি পেতে শুরু করে। শুধু তাই নয় বিদেশে শ্রমিক প্রেরণে এক মাসে (নভেম্বর-২০২১) লক্ষাধিক শ্রমিক যাওয়ার রেকর্ডও স্পর্শ করে। অপরদিকে বন্ধ থাকা অ্যাভিয়েশন খাতের সব দেশের সাথে ফ্লাইট চলাচল শুরু হয়ে যায়। তবে এই দুই খাতে ভোগান্তি ছিল বছরজুড়ে। আর বছরের শেষ দিকে এসে করোনাভাইরাসের নতুন রূপ ওমিক্রমের প্রভাব বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশে পড়লেও এখনো এর হার অনেকই কম। তবে অ্যাভিয়েশন ও অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যদি কোনো কারণে ওমিক্রন নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়, তাহলে আবারো শ্রমিক পাঠানো এবং উড়োজাহাজ ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
জানা গেছে, ২০২০ সালের ১২ মাসে যেখানে মাত্র পৌনে ২ লাখ শ্রমিক সৌদি আরবসহ হাতেগোনা কয়েকটি দেশে গিয়েছিল সেখানে এক বছরের ব্যবধানে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় পৌনে ৬ লাখ শ্রমিক বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। এর মধ্যে গত বছরের নভেম্বর মাসে এক লাখ দুই হাজার শ্রমিক বিদেশে পাঠিয়ে রেকর্ড করেছে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো। তবে এই সময়ের মধ্যে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদেশগামীদের র্যাপিড পিসিআর টেস্ট করানো, বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের টিকিটের দাম দ্বিগুণের বেশি হওয়াসহ নানাবিধ কারণে বিদেশগামীদের সীমাহীন ভোগান্তি ছিল বছরজুড়ে। অপর দিকে করোনায় বন্ধ থাকা সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, দুবাই, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, লন্ডনসহ বিভিন্ন দেশের সাথে ফ্লাইট চলাচল ২০২১ সালের জুনের পর থেকে পুরোদমে শুরু হওয়ায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউএস-বাংলাসহ অন্যান্য এয়ারলাইন্সের ব্যবসায় চাঙ্গাভাব আসে। যদিও করোনায় বিমানসহ অন্যান্য এয়ারলাইন্স স্পেশাল ফ্লাইট পরিচালনা করেছিল।
২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত এই তিন মাসে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতারসহ বিভিন্ন দেশে এক লাখ ৯১ হাজার শ্রমিক পাড়ি জমিয়েছিল। এরপরই শুরু হয় ভয়াবহ করোনার প্রভাব। যার পরিপ্রেক্ষিতে এপ্রিল, মে ও জুন মাসে উড়োজাহাজ চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার কারণে বিদেশে শ্রমিক পাঠানো বন্ধ ছাড়াও সারা দেশে লকডাউন শুরু হয়। এরপর জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর মাসে বিদেশে শ্রমিক যাওয়া প্রায় বন্ধ থাকলেও (৩ মাসে ২৯৬ জন) সেটি আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে দুই লাখ ১৭ হাজার ৬৬৯ জন শ্রমিক যেতে পারে। এর মধ্যে এক লাখ ৬১ হাজারের মতো শ্রমিক গিয়েছিল শুধু সৌদি আরবেই।
২০২১ সাল শুরুর পর থেকেই করোনার প্রভাব কাটতে শুরু করে। যদিও জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত গতি ছিল কিছুটা কম। পরে সেটি আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করে। ডিসেম্বর নাগাদ সেটি বেড়ে ২০২০ সালের তুলনায় প্রায় তিন গুণ শ্রমিক বিদেশে কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়। এর মধ্যে ৭০ হাজার নারী শ্রমিক সৌদি আরব, জর্ডানসহ বিভিন্ন দেশে যান।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ব্যুরোর পরিসংখ্যান সূত্র মোতাবেক ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে বিদেশে শ্রমিক যাওয়ার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ হাজারে। এভাবে বাড়তে থাকলেও মে, জুলাই ও আগস্ট মাসে পিসিআর টেস্ট পরীক্ষা, বিমানের টিকিট কিনতে অতিরিক্ত টাকা দেয়া, দেশ-বিদেশে কোয়ারেনটিন করা, ভিসা জটিলতাসহ নানাবিধ সমস্যার কারণে ফের কমতে শুরু করে কর্মী যাওয়ার গতি। যা ১২ হাজারে গিয়ে ঠেকে। এরপর পররাষ্ট্র, প্রবাসী কল্যাণ ও বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের যৌথ সমন্বয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার কারণে বিদেশে কর্মী যাওয়ার হার আবারো বেড়ে যায়। এর মধ্যে সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটি ঢাকা-লন্ডন-ঢাকা ও ঢাকা ম্যানচেস্টার ঢাকা, সৌদি আরব, কুয়েত কাতার, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশের সাথে ফ্লাইট চলাচল শুরুর ঘোষণা দেয়। এর ফলে সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদেশে শ্রমিক যাওয়ার গতি বেড়ে যায়। এর মধ্যে নভেম্বর এবং ডিসেম্বর মাসে লক্ষাধিক শ্রমিক বিদেশ গেছেন বলে জানিয়েছেন জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক মো: শহীদুল আলম এনডিসি। তবে এই সময়ের মধ্যে পিসিআর টেস্ট না হওয়ার কারণে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদেশগামীরা ভোগান্তি কমাতে আন্দোলন শুরু করে। একপর্যায়ে তাদের দাবি অনুযায়ী বিমানবন্দরে করোনা পরীক্ষার র্যাপিড টেস্টের মেশিন স্থাপন করা হয়। যদিও এই সময়ের মধ্যে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে পিসিআর ল্যাব স্থাপন করার কথা থাকলেও তা হয়নি। এ নিয়ে শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত ভোগান্তির মধ্যে রয়েছেন।
গতকাল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একাধিক কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ২০২১ সালের শুরুর দিকে বিমান লোকসান দিলেও পরবর্তীতে সেটি কাটিয়ে উঠেছে। বিমানের লন্ডন এবং ব্যাংককের যে দু’টি রুট বন্ধ ছিল সেটিও সম্প্রতি খুলে দেয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তারা বলেন, বিমানের টিকিটের দাম দ্বিগুণ করা হয়েছিল ২০২০ সালের করোনার তিন মাসে পুরোপুরি ফ্লাইট চলাচল বন্ধ থাকায় লোকসান পুষিয়ে নিতে। তবে সেটি বিমান কর্তৃপক্ষ মনে হয় ২০২১ সালে এসে অনেকটা রিকভারি করতে পেরেছে। তাদের মতে, উড়োজাহাজ ব্যবসায় যে ক্ষতি হয়েছিল সেটির ৭০ ভাগ পুষিয়ে গেছে। এখনো ৩০ ভাগ পোষানো যায়নি। তারা বলেন, এতে বিমান কর্তৃপক্ষ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তেমনি বিদেশগামী শ্রমিকরাও দ্বিগুণ দামে টিকিট কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০২২ সালে সেটি কিভাবে রিকভার করা যেতে পারে সেটি ম্যানেজমেন্ট ভালো বলতে পারবেন। ইতোমধ্যে টিকিটের দাম কমানোর দাবিতে অভিবাসন খাতের সব সেক্টরের লোকজন ফুসে উঠছেন। প্রতিনিয়ত প্রতিবাদ ক্ষোভ বিক্ষোভ করছেন কোথাও না কোথাও। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ সবাইকে ভেবে দেখার পরামর্শ দেন অভিবাসন ও অ্যাভিয়েশন খাতের অভিজ্ঞ মহল। তারা আশা প্রকাশ করে বলছেন, ওমিক্রন আবারো তাদের ব্যবসায় আতঙ্ক হয়ে দাঁড়ায় কি না তা সময়ই বলে দেবে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/633688/