১ জানুয়ারি ২০২২, শনিবার, ৯:২৯

বিদায়ী বছরেও দেশে ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ছিল ঊর্ধ্বমুখী

নাছির উদ্দিন শোয়েব: করোনা মহামারির মধ্যেও বিদায়ী বছরে ২০২১ সালে দেশে ধর্ষণ-নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ছিল ঊর্ধ্বমুখী। জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজারে বেড়াতে যাওয়া এক নারীকে অপহরণের পর হোটেলে আটকে রেখে ধর্ষণের ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় স্থানীয় কয়েকজন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। রাত দুইটার দিকে ঘটনার শিকার নারীকে ওই গেস্ট হাউজ থেকে উদ্ধার করে র‌্যাব। এ ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। সম্প্রতি রাজধানীর মতিঝিল এলাকার একটি বাসায় ১৩ বছরের স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এছাড়াও যৌন হয়রানির অভিযোগে রাজধানীর হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. সালাউদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা করেন মেডিকেল শিক্ষার্থী। মঙ্গলবার মামলাটি নথিভুক্ত করে পুলিশ।

এদিকে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে পুত্রবধূকে ধর্ষণের অভিযোগে ফয়েজ আলী গাজী (৪৮) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পাবনার ভাঙ্গুড়ায় প্রেমিকার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের ভিডিও ধারণ করে সেই ভিডিও দেখিয়ে টানা দুই বছর ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে এক যুবকের বিরুদ্ধে। এছাড়াও গণপরিবহনে তরুণীকে গণধর্ষণের কয়েকটি ঘটনা সদ্য বিদায়ী বছরে আলোচিত ঘটনা ছিল।

মানবাধিকার সংস্থার জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে-যৌন সহিংসতা-নিপীড়ন বেড়েছে প্রকটভাবে। পথেঘাটে, গণপরিবহনে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা অনলাইনে। পারিবারিক নির্যাতনও কমেনি। ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সারাদেশে ব্যাপক বিক্ষোভ-আন্দোলনের মুখে আইন পরিবর্তন করতে বাধ্য হয় সরকার। সরকারি এক তথ্যে জানা যায়, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ধর্ষণ মামলা ছিল পাঁচ হাজার ৮৪২টি, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে সেটা বেড়ে হয়েছে সাত হাজার ২২২টি। নারী নির্যাতন ১২ হাজার ৬৬০টি থেকে বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৫৬৭টি।

জানা গেছে, সদ্য বিদায়ী ২০২১ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৩২১ জন নারী। আর ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৭ জন। ধর্ষণের শিকার নয়জন আত্মহত্যা করেছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য সংরক্ষণ ইউনিট এসব তথ্য জানিয়েছে। গতকাল শুক্রবার ‘মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০২১’ শীর্ষক পর্যালোচনায় এসব তথ্য তুলে ধরে আসক। বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে সংগঠনটি এসব তথ্য জোগাড় করে। সংস্থাটির সহকারী সমন্বয়কারী অনির্বাণ সাহা লিখিত বক্তব্যে বলেন, ২০২০ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন মোট এক হাজার ৬২৭ নারী। তার আগের বছর ২০১৯ সালে এই সংখ্যাটি ছিল এক হাজার ৪১৩।

নির্যাতন, উত্ত্যক্তকরণ ও যৌন হয়রানির পরিসংখ্যানে বলা হয়, ২০২১ সালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন ১২৮ নারী। এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হন ৭৭ জন পুরুষ। এ বছর উত্ত্যক্তকরণের কারণে আত্মহত্যা করেন ১২ নারী। এ ছাড়া যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে আটজন প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের মধ্যে তিনজন নারী ও পাঁচ পুরুষ। সমাপ্ত বছরে পারিবারিক নির্যাতন ও যৌতুকের পর্যালোচনায় বলা হয়, এ বছর পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ৬৪০ নারী। এর মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা যান ৩৭২ জন এবং আত্মহত্যা করেন ১৪২ জন। আর ২০২০ সালে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ৫৫৪ নারী। অন্যদিকে ২০২১ সালে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ২১০ নারী। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের পর হত্যার শিকার হন ৭২ নারী এবং আত্মহত্যা করেন ১৩ নারী।

আসকের সহকারী সমন্বয়কারী অনির্বাণ সাহা বলেন, ২০২১ সালে সালিশ ও ফতোয়ার মাধ্যমে ১২ নারী নির্যাতনের শিকার হন। এর মধ্যে সালিশে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন তিন নারী এবং নির্যাতন পরবর্তী সময়ে আত্মহত্যা করেন দুই নারী। ২০২০ সালে সালিশ ও ফতোয়ার শিকার হয়েছিলেন মোট আট নারী। বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতন, আইনশৃক্সখলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ ও গুম, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অধিকার পরিস্থিতি, মতপ্রকাশের অধিকার, নারী অধিকার, শিশু অধিকার, শ্রমিক অধিকার রাজনৈতিক সহিংসতা ও আইনশৃক্সখলা পরিস্থিতি, সীমান্তহত্যা ও নির্যাতন ও গণপিটুনিসহ বেশ কয়েকটি বিষয় তুলে ধরা হয় পর্যালোচনায়।

লিখিত বক্তব্যে ১০টি সুপারিশ তুলে ধরে আইন ও সালিশ কেন্দ্র। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মানবাধিকার লক্সঘনের ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্ত করা; গুম, অপহরণ, বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ তদন্তে নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা; নাগরিকদের মতপ্রকাশের অধিকার খর্ব না করাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এসব সুপারিশ রয়েছে। লিখিত বক্তব্যের পর সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী কমিটির মহাসচিব মো. নূর খান। ২০২১ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, এ বছর মানবাধিকার পরিস্থিতি এক কথায় সহ্যক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। কোনো ঘটনারই নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার হয় না।

এদিকে আশকের তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে এক হাজার ৬২৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫৩ জনকে। আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১৪ জন। আর মামলা হয়েছে এক হাজার ১৪৪টি। আর ২০১৯ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৪১৩ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে। আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০ জন। মামলা হয়েছে ৯৯৩টি। আসক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে পরিসংখ্যান তৈরি করে। তবে অনেক ঘটনা সংবাদমাধ্যমে আসে না। আর যেসব খবর সংবাদমাধ্যমে আসে সেসব ঘটনায় ২০-৩০ ভাগ মামলা হয় না। কারণ সেগুলো স্থানীয়ভাবে মিটমাট করে ফেলা হয় বলে জানিয়েছে আসক।

মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেছেন, বাংলাদেশে ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতার যত মামলা হয় তার সর্বোচ্চ চার থেকে পাঁচ ভাগ মামলায় আসামিরা শাস্তি পান। আর শুধু ধর্ষণের হিসাব করলে এই হার আরো অনেক কম হবে। মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী নারী নেত্রী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ধর্ষণ মামলায় সর্বোচ্চ দুই ভাগের বেশি শাস্তি হয় না। তিনি বলেন, আদালতে আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ না হলে ধর্ষণের ঘটনা মিথ্যা হয়ে যায় না। মামলা দায়ের থেকে শুরু করে মামলার তদন্তসহ নানা কারণে আসামীরা বেনিফিট অব ডাউটের সুযোগে ছাড়া পেয়ে যান।

https://dailysangram.com/post/476055