২৩ আগস্ট ২০২১, সোমবার, ১২:৫০

ষড়যন্ত্রের রাজনীতি এবং ইতিহাসের এক বিচিত্র ‘বিচার’

বাংলাদেশের জনগণকে প্রায় নিয়মিতভাবেই ইতিহাসে ফিরে যেতে হয়। কিছু উপলক্ষে ইতিহাস তাদের স্মরণও করিয়ে দেয়া হয়। আজকের নিবন্ধেও ইতিহাসের বিশেষ একটি অধ্যায়ের আলোচনা করা হবে, যার মধ্য দিয়ে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি সম্পর্কে শুধু নয়, দেশ থেকে গণতন্ত্র বিতাড়িত হওয়ার কারণ সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যাবে।
সেদিকে যাওয়ার আগে একটি তথ্য জানিয়ে রাখা দরকার। সে তথ্যটি হলো, বাংলাদেশসহ এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের শুধু ‘জেলের ভাত’ খেতে হয়নি, কোনো কোনো নেতাকে বিচারের সম্মুখীনও হতে হয়েছিল। বাংলাদেশের অবস্থান থেকে উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলে প্রায় ৩০ বছর কারাগারে কাটিয়েছিলেন। ১৯৭৬ সালের নভেম্বরে ইন্তিকালের সময়ও তিনি গৃহবন্দী অবস্থায় ছিলেন।
আওয়ামী লীগের প্রাণপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমানকে বছরের পর বছর ধরে ‘জেলের ভাত’ তো খাওয়ানো হয়েছেই, আগরতলা নামের ষড়যন্ত্র মামলাসহ বেশ কিছু মামলায় তাকে বিচারের সম্মুখীনও করা হয়েছিল। এসব বিষয়ে জানার জন্য পাঠকরা তার লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’ নামের গ্রন্থ দুটি পড়ে দেখতে পারেন।
আজকের নিবন্ধ অবশ্য জেলের ভাত খাওয়া বিষয়ক নয়, একটি বিচিত্র বিচার সম্পর্কিত। বিচিত্র বলার কারণ, সেটা প্রচলিত অর্থের বিচার ছিল না। ছিল এমন এক বিচার, যে ধরনের বিচার সম্পর্কে সাধারণত শোনা যায় না। বিচার করা এবং ঘোষিত রায়ের ভিত্তিতে কথিত ‘আসামীর’ বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হলেও আদালতে কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি। ১৯৫৪ সালের সে মামলায় একমাত্র ‘আসামী’ ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় নেতা এবং ব্রিটিশ আমলে অবিভক্ত বঙ্গ প্রদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক। তাকে যখন আসামী করা হয়, তিনি তখন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বা চিফ মিনিস্টার। উল্লেখ্য, বর্তমান বাংলাদেশের নাম তখন পর্যন্তও পূর্ব বাংলা ছিল। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে এর নাম করা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান।
ওই বিচার ও তার রায় সম্পর্কে জানতে হলে সেকালের ইতিহাস স্মরণ করতে হবে। ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের শুরু থেকেই পূর্ব বাংলা তথা বাঙালিদের বিরুদ্ধে দমন, বঞ্চনা ও শোষণের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। টাঙ্গাইলের একটি আসনের উপনির্বাচনে প্রথমে মওলানা ভাসানীর কাছে এবং তারপর আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের কাছে ক্ষমতাসীন দলের একই প্রার্থী করোটিয়ার জমিদার খুররম খান পন্নী পরাজিত হওয়ার পর মুসলিম লীগ সরকার এই প্রদেশে আর কোনো নির্বাচন করতে দেয়নি। ফলে ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট নির্বাচিত পাকিস্তান গণপরিষদে পূর্ব বাংলা সত্যিকার অর্থে প্রতিনিধিত্বহীন অবস্থায় ছিল। কারণ, ৭৯ সদস্যের গণপরিষদে জনসংখ্যার ভিত্তিতে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধির সংখ্যা ৪৪ জন নির্ধারিত থাকলেও প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের মতো কয়েকজন ‘মোহাজের’ নেতা প্রতিনিধিত্ব করে আসছিলেন- যারা পূর্ব বাংলা বা বাঙালীর পক্ষে কোনো ভূমিকা রাখেননি।
এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের চার প্রদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও পূর্ব বাংলায় প্রথমবারের মতো নির্বাচনের আয়োজন করা হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। সে নির্বাচন উপলক্ষেই ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছিল যুক্তফ্রন্ট। এর নেতৃত্বে ছিল ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত প্রদেশের প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগ। সঙ্গে ছিল ‘শেরে বাংলা’ ফজলুল হকের নেতৃত্বে ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই গঠিত দল কৃষক-শ্রমিক পার্টি। পরবর্তীকালে হাজী মোহাম্মদ দানেশ ও মাহমুদ আলীর নেতৃত্বাধীন গণতন্ত্রী দল (প্রতিষ্ঠা: জানুয়ারি, ১৯৫৩) এবং পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট্রে যোগ দিয়েছিল। অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগ সেক্রেটারি আবুল হাশিমের খেলাফতে রব্বানী পার্টিও (প্রতিষ্ঠা: সেপ্টেম্বর, ১৯৫৩) যুক্তফ্রন্টের মিত্র সংগঠন হিসেবে ভ’মিকা পালন করেছে। অন্যদিকে মওলানা আতাহার আলীর নেজামে ইসলাম পার্টি (প্রতিষ্ঠা: ১৯৫৩) কৃষক-শ্রমিক পার্টির সঙ্গে পৃথকভাবে স্বাক্ষরিত ‘১০ দফা’ চুক্তির ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্টে যোগ দিয়েছিল। সব দলের লক্ষ্য ছিল ক্ষমতা থেকে মুসলিম লীগকে উৎখাত করা। সেটা দলগুলো করেছিলও।
যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী কর্মসূচি হিসেবে ১৯৫৪ সালের জানুয়ারিতে ঘোষিত ২১ দফায় প্রধানত পূর্ব বাংলার জনগণের বিভিন্ন দাবি ও অধিকার আদায়ের অঙ্গিকার করা হয়েছিল। স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে ২১ দফার ১৯ নম্বর দফায় বলা হয়েছিল, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলাকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেয়া ও সার্বভৌমিক করা হবে এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত সকল বিষয়কে প্রদেশের কর্তৃত্বে আনা হবে। দেশরক্ষা বিভাগের স্থল বাহিনীর সদর দফতর পশ্চিম পাকিস্তানে ও নৌ বাহিনীর সদর দফতর পূর্ব বাংলায় স্থাপিত হবে, পূর্ব বাংলাকে আত্মরক্ষায় স্বয়ংসস্পূর্ণ করার জন্য প্রদেশে অস্ত্র নির্মাণের কারখানা স্থাপন করা হবে। আনসার বাহিনীকে সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা হবে।
ঐতিহাসিক এই ২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচার অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান এবং পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের আহবায়ক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এই তিনজনের পাশাপাশি ছিলেন ‘শেরে বাংলা’ ফজলুল হক। ‘হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী’র নেতৃত্বেই যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। অন্যদিকে ছিল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী বা চিফ মিনিস্টার নূরুল আমীনের নেতৃত্বে তৎপর ক্ষমতাসীন দল মুসলিম লীগ।
১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ অনুষ্ঠিত পূর্ব বাংলার প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট বিশাল ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছিল। ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট জিতেছিল ২২৩টিতে। এর মধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৪৩, কৃষক-শ্রমিক পার্টি ৪৮, নেজামে ইসলাম পার্টি ১৯ এবং গণতন্ত্রী দল ১৩টি আসন পেয়েছিল। অমুসলিমদের জন্য সংরক্ষিত ৭২টি আসনের মধ্যে গণতন্ত্রী দল তিনটি ও কমিউনিস্ট পার্টি চারটি আসন পাওয়ায় এবং দল দুটি যুক্তফ্রন্টের অঙ্গ সংগঠন হওয়ায় যুক্তফ্রন্টের সর্বমোট সদস্য সংখ্যা হয়েছিল ২৩০। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ পেয়েছিল মাত্র ১০টি আসন। উল্লেখ্য, আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রধান দুই নেতা মওলানা ভাসানী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নির্বাচনে প্রার্থী হননি।
বিজয়ের পর ১৯৫৪ সালের ২ এপ্রিল মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত যুক্তফ্রন্টের যৌথ সভায় ‘শেরে বাংলা’ আবুল কাশেম ফজলুল হককে সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত করা হয়েছিল। পরদিন ৩ এপ্রিল ফজলুল হক যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রধান বা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। কোন দল থেকে কতজনকে মন্ত্রী করা হবে- সে প্রশ্নে মতপার্থক্য সৃষ্টি হওয়ায় আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রথমে মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়া থেকে বিরত থেকেছে। ফলে ৩ এপ্রিল ফজলূল হক মাত্র তিনজনকে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করেন। তারা ছিলেন কৃষক-শ্রমিক পার্টির আবু হোসেন সরকার ও সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়া এবং নেজামে ইসলাম পার্টির আশরাফউদ্দিন চৌধুরী।
আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মন্ত্রী নেয়া হয়েছিল ১৫ মে। মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, আবদুস সালাম খান, হাশিমউদ্দিন আহমদ এবং শেখ মুজিবুর রহমান। কেএসপির নেতা হলেও কফিলউদ্দিন চৌধুরীকেও আওয়ামী মুসলিম লীগের কোটা থেকে মন্ত্রী করা হয়েছিল। সব মিলিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক ছাড়া মোট ১২ জনকে নিয়ে গঠিত হয়েছিল যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা। এই মন্ত্রিসভা অবশ্য বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। আর এখানেই রয়েছে সেই ‘বিচার’ প্রসঙ্গ।
মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগ যোগ দেয়ার তিন দিন আগে, ১১ মে (১৯৫৪) স্বাক্ষরিত হয়েছিল পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি। আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবাজদের কাছে ‘মাতৃভূমিকে বন্ধক রাখার’ তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে চুক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানসহ বিভিন্ন দলের ১৬৭ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যও এক বিবৃতিতে ওই চুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন।
পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির প্রথম ‘শিকার’ হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলা। মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হকের মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগ যোগ দেয়ার দিনটিতেই আদমজীর শিল্পাঞ্চলে বাঙ্গালি ও অবাঙ্গালি শ্রমিকদের মধ্যে দাঙ্গা বাঁধানো হয়েছিল। তারও আগে ২৩ মার্চ সংঘটিত হয়েছিল চন্দ্রঘোনা কাগজ কলের দাঙ্গা। পাকিস্তান সরকার আদমজীর দাঙ্গাকে ‘কমিউনিস্টদের প্ররোচনায় সংঘটিত’ বলে চিহ্নিত করে আওয়ামী লীগের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা চালায়। জবাবে মওলানা ভাসানী নির্বাচনে পরাজিত মুসলিম লীগের ‘গভীর ষড়যন্ত্রকে’ দায়ী করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হকও ‘কমিউনিস্টদের যোগসাজশের’ কথা অস্বীকার করেন এবং পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির বিরুদ্ধে ‘আন্দোলনকারী কমিউনিস্টদের’ দমন ও গ্রেফতার করার জন্য প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর দেয়া ‘পরামর্শ’ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে অস্বীকৃতি জানান। এর পরিণতি মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হকের জন্য শুভ হয়নি। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর ১৯৫৪ সালের ২৩ মে সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে ফজলুল হকের উক্তি হিসেবে বলা হয়, তিনি নাকি বলেছেন, ‘যুক্তফ্রন্ট সরকার পূর্ব বাংলা স্বাধীনতার কথা চিন্তা করছে এবং স্বাধীনতার বিষয়টি কার্যকর করাই হবে আমার মন্ত্রিসভার অন্যতম প্রাথমিক কার্যক্রম।’
পরদিনই ফজলুল হক ওই রিপোর্টের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা’ নয়, তিনি ‘পূর্ব বাংলার স্বয়ত্তশাসনের’ কথা বলেছেন। কিন্তু লাভ হয়নি, মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হককে তথা সমগ্র পূর্ব বাংলা প্রদেশকে অসম্মানিত করে প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মোহাম্মদ আলী মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হকের ‘বিচারের’ ব্যবস্থা করেন। ওই বিচারের ‘বিচারক’ ছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আর একমাত্র ‘সাক্ষী’ হিসেবে নেয়া হয়েছিল ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর সেই রিপোর্টার জন ক্যালাহানকে। ফজলুল হক অভিযোগ অস্বীকার করলেও ক্যালাহান দাবি করেন, তিনি সঠিক উক্তিই উল্লেখ করেছেন। ‘রায়ে’ পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে ‘দোষী’ সাব্যস্ত করা হয়!
এই অশ্রুতপূর্ব বিচারের পর মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হককে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ আখ্যায়িত করে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ পূর্ব বাংলায় ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ৯২-ক ধারা জারি করেন (২১ মে, ১৯৫৪)। এর ফলে যুক্তফ্রন্ট সরকার বাতিল হয়ে যায় এবং প্রদেশের ওপর কেন্দ্রের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ ও যুক্তফ্রন্ট কার্যালয়ে তালা ঝোলানোর পাশাপাশি ‘কমিউনিস্ট’ দলনের নামে শত শত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হতে থাকে। প্রদেশের নতুন গভর্নর মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা দেশে ফিরলেই মওলানা ভাসানীকে গুলি হত্যা করা হবে বলে ঘোষণা দেন। উল্লেখ্য, মওলানা ভাসানী সে সময় বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে অংশ নিতে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে অবস্থান করছিলেন। মওলানা ভাসানীর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে করাচীকেন্দ্রিক ক্ষমতাসীন চক্র ও ষড়যন্ত্রকারীরা সাফল্যের সঙ্গে যুক্তফ্রন্টে ভাঙন সৃষ্টি করেছিল। ১৯৫৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি যুক্তফ্রন্টের সংসদীয় দলের সভায় ‘শেরে বাংলা’ ফজলুল হকের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় এবং তার ফলে যুক্তফ্রন্টে ভাঙন ঘটে। উল্লেখ্য, কলকাতা থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে মওলানা ভাসানী যুক্তফ্রন্টের ঐক্য টিকিয়ে রাখার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানত শেখ মুজিব অনমনীয় থাকায় যুক্তফ্রন্ট ভেঙে গিয়েছিল।
যুক্তফ্রন্টের এই ভাঙনে দলগতভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আওয়ামী লীগ। এর কারণ, ৯২-ক ধারা প্রত্যাহারের পর ১৯৫৫ সালের ৬ জুন আবু হোসেন সরকারের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলায় গঠিত মন্ত্রিসভা ‘যুক্তফ্রন্ট’ নাম নিয়েই শপথ নিয়েছিল। অর্থাৎ নামে যুক্তফ্রন্ট সরকারই ক্ষমতায় ফিরে এসেছিল। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের প্রধান শরিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগ এতে সুযোগ পায়নি। এরই পাশাপাশি দলত্যাগ করেছিলেন আওয়ামী লীগের ৩৯ জন সদস্য, যার ফলে দলটির পরিষদ সদস্য সংখ্যা কমে হয়েছিল ১০৪। ওদিকে গণপরিষদের ৩১টি মুসলিম আসনের নির্বাচনে ‘যুক্তফ্রন্ট’ পেয়েছিল ১৬টি। কিন্তু বড় ও প্রধান দল হলেও আওয়ামী লীগের ভাগে এসেছিল মাত্র ১২টি আসন। পরবর্তীকালে উপনির্বাচনের মাধ্যমে একটি আসন পাওয়ায় দলটির সদস্য সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল ১৩।
সেই সাথে কিছুদিনের মধ্যে ৯২-ক ধারা প্রত্যাহার করা হলেও ভাসানী-মুজিবের আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে দেয়া হয়নি। ১৯৫৫ সালের ৬ জুন আবু হোসেন সরকারের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলায় গঠিত মন্ত্রিসভা ‘যুক্তফ্রন্ট’ নাম নিয়েই শপথ নিয়েছিল। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের প্রধান শরিক দল আওয়ামী লীগ এতে সুযোগ পায়নি।
পাকিস্তানে এভাবেই শুরু হয়েছিল ষড়যন্ত্রের রাজনীতির বাস্তবায়ন। পরিণতিতে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করার অজুহাত পেয়েছিলেন (অক্টোবর, ১৯৫৮)। প্রচন্ড গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতন ঘটেছিল ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
এই সময়কালের মধ্যে একাধিকবার সাজানো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও দেশটিতে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটতে দেয়া হয়নি। গণতন্ত্রবিরোধী একই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে দেয়া হয়নি। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার বরং গণহত্যার ভয়ংকর পথে বাংলাদেশের জনগণকেই নির্মূল করতে চেয়েছিল। এরই প্রতিবাদে শুরু হয়েছিল প্রতিরোধ যুদ্ধ আর সে যুদ্ধের মাধ্যমেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছিল।
সেটা অবশ্য ইতিহাসের অন্য এক বিচিত্র অধ্যায়। এ বিষয়ে পরবর্তীকালে লেখার ইচ্ছা রইল।

https://dailysangram.com/post/462525