জীবিত আর দেখা হবে না, লাশও মিলবে না। শুধু নিশ্চিত হওয়া, না-ফেরাদের তালিকায় আছেন মা-ও। গতকাল দুপুরে তোলা। ছবি : মীর ফরিদ
১১ জুলাই ২০২১, রবিবার, ৮:০১

কারখানা যেন জেলখানা!

ইমরান আহমেদ কাজ করতেন পাঁচতলায় জুস সেকশনে। চারতলায় ছিলেন তাঁর পরিচিত সহকর্মী ফাহিম। আগুন লাগার পর ফাহিম ফোন করে তাঁকে বলেছিলেন, চারতলা থেকে নিচে নামার গেটে তালা দেওয়া। আবার ছাদে ওঠার সিঁড়ির মুখের গেটেও তালা। চারতলায় ৫০ জনের বেশি কর্মী কাজ করছেন।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কর্ণগোপ এলাকায় সজীব গ্রুপের ‘হাসেম ফুড’ কারখানার শ্রমিক ইমরান এভাবেই বলছিলেন আগুন লাগার পর সেখানে আটকে পড়া অসহায় শ্রমিকদের আকুতির কথা।

বৃহস্পতিবার বিকেলে ওই কারখানায় লাগা আগুনে পুড়ে এখন পর্যন্ত ৫২ শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৪৯টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে চারতলার এক জায়গা থেকে। তাঁদের দেহ এমনভাবে পুড়েছে যে শনাক্ত করা যাচ্ছে না।

ইমরান ও তাঁর আরেক সহকর্মী তিনতলার একটি সেকশনের কর্মী শিউলি খাতুন বলেন, ভবনটির প্রতিটি তলায় তালা দেওয়ার পাশাপাশি কক্ষগুলোর মাঝখানে জালের দেয়াল তুলে রাখা হতো। কর্মকর্তারা বলতেন, খাবারের জিনিস যেন কেউ নিতে না পারে সেই কারণে এই ব্যবস্থা। এর আগেও আগুনের ঘটনা ঘটে। তখনো কাউকে তালা খুলে বের হতে দেওয়া হয়নি।

শুক্রবার আগুন নেভানোর পাশাপাশি উদ্ধারকাজ করা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বলছিলেন, প্রতিটি তলায় কক্ষগুলো খোপ খোপ করে তৈরি করা। বাহিনীর কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, তালা দেওয়া না থাকলে আটকে পড়া লোকজনকে উদ্ধার করতে পারতেন তাঁরা। তা ছাড়া এত বড় একটি ভবনে অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থাসহ দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল না।

কারখানার কর্মীরা বলছিলেন, ভবনটিতে কখনো আগুনের মহড়া দেখেননি তাঁরা।

এর আগেও তাজরীন ফ্যাশন নামের পোশাক কারখানায় আগুনে শতাধিক শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। একটি ফয়েল কারখানায় আগুন লেগে নিহত হয়েছেন ২৪ জন। এমন প্রতিটি দুর্ঘটনার পরই জানা যায়, ভবনে তালা দেওয়া ছিল। বড় প্রাণহানি ঘটেছে এমন দুর্ঘটনা তদন্তে চরম গাফিলতির চিত্রও উঠে আসে। এর পরও কেবল লাইসেন্স দেওয়ার সময় নির্দেশনা জানিয়ে দায়িত্ব শেষ করছে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ। পরবর্তী সময়ে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ চললেও নজরদারি থাকে না অগ্নিনির্বাপণকারী সংস্থাটির। একইভাবে কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সিটি করপোরেশন, এমনকি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি নেই পণ্য উৎপাদনের কারখানায়।

যদিও কারাগারের মতো শ্রমিকদের আটকে রেখে কাজ করানো হচ্ছে দেশের শত শত শিল্প-কারখানায়। রানা প্লাজা, তাজরীন ফ্যাশনসহ কয়েকটি পোশাক কারখানায় দুর্ঘটনায় শত শত শ্রমিকের প্রাণহানির পর তৈরি পোশাক কারখানায় সুরক্ষা ব্যবস্থার বিষয়টি দেশি-বিদেশি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর নজরদারির আওতায় আসে। কিন্তু অন্য শিল্প-কারখানাগুলোর ক্ষেত্রে এমন নজরদারি দেখা যায় না।

ট্রেড ইউনিয়নভিত্তিক সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ছয় বছরে কর্মক্ষেত্রে নিহত হয়েছেন চার হাজার ৭৯৫ জন শ্রমিক। আহত হয়েছেন তিন হাজার ২১৩ জন। ১০ বছরে দেশে আগুন ও বিস্ফোরণে দেড় হাজার মানুষ মারা গেছেন, যার বেশির ভাগই ঘটেছে কারখানায়।

‘হাসেম ফুড’ কারখানা ভবনটিতে জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা বা বিল্ডিং কোড মেনে অগ্নিদুর্ঘটনায় প্রাণহানি এড়াতে প্রয়োজনীয় সিঁড়ি, পানির মজুদসহ আগুন নেভানোর কোনো ব্যবস্থাই ছিল না।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, ভবনটির কক্ষগুলো ছোট ও আবদ্ধ ছিল। মাঝে নেট দিয়ে দেয়ালের মতো ইউনিট তৈরি করা হয়েছে। এতে শ্রমিকরা ধোঁয়া ও আগুনের মধ্যে আটকা পড়েন। বিল্ডিং কোডে ভবনের আয়তন অনুযায়ী কক্ষের আয়তন, সিঁড়ির পরিমাণ ও আয়তন; দরজা-জানালা বা কাচের দেয়ালের আকার-আয়তন নির্ধারিত থাকে। বিল্ডিং কোডেরও ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থা রাখার সুপারিশ আছে। এ ছাড়া অগ্নিনির্বাপণের জন্য পানির উৎস রাখতে বলা হয়। রাখতে বলা হয় জরুরি বহির্গমনের সিঁড়ি।

তবে ‘হাসেম ফুডের’ মালিক মোহাম্মদ আবুল হাসেম শুক্রবার গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘কারখানা ভবনে অগ্নিনির্বাপণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল। আগুন বেশি বেড়ে যাওয়ায় এটি আর নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।’ কর্মীদের আটকে রাখার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তার জন্য গেটে তালা লাগানো থাকে। খাবার তৈরির কারখানায় এমনই নিয়ম। তবে দুর্ঘটনা হলে বা ছুটির সময় বের হওয়ার ব্যবস্থা আছে।’ গতকাল হাসেম গ্রেপ্তার হওয়ার কারণে তদন্তে পাওয়া তথ্যের ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য জানা যায়নি।

হাসেম ফুড কারখানার প্রশাসনিক ইনচার্জ সালাউদ্দিন মিয়াও শুক্রবার কালের কণ্ঠ’র কাছে দাবি করেছিলেন, নির্দেশনা মেনেই ভবন তৈরি করা হয়েছে। তবে অগ্নিনির্বাপণে পানির উৎস তিনি দেখাতে পারেননি।

জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মূলত যারা বড় কারখানা ভবন তৈরি করবে তাদেরই নিশ্চিত করতে হয় যে তারা অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা করবে। আমরা প্রাথমিকভাবে কারখানা তৈরির জন্য লাইসেন্স দিই। আমরা প্রথম দিকে পরিদর্শন করি, তখন তাদের করণীয় নির্দেশনা দিই। এরপর বাস্তবায়ন করা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। অনেকে পরবর্তী সময়ে ভবন বাড়ায়। ভবনের আয়তন বাড়ায়। তারা অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা নেবে এমন লিখিত দিয়েই অনুমোদন নেয়। তারা রাজউক, কারখানা অধিদপ্তরসহ অনেকের অনুমোদন নেয়।’

নজরদারির ব্যাপারে জানতে চাইলে জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আমরা বল প্রয়োগ করে এটি কার্যকর করতে পারি না। তবে কোনো ভবনে ত্রুটি থাকলে ঝুঁকিপর্ণ বলে রিপোর্ট দিই। দুর্ঘটনার পরও কারণ শনাক্ত করে সুপারিশ করি। এখানেও (হাসেম ফুড) অনেক ত্রুটি পেয়েছি। তদন্তে পুরোপুরি উঠে আসবে।’

ফায়ার সার্ভিসের একাধিক সূত্র জানায়, শুধু অগ্নিকাণ্ড নয়, সব দুর্ঘটনায় উদ্ধারের দায়িত্ব ফায়ার সার্ভিসের। ফলে এই অধিদপ্তরের কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা জরুরি হলেও বাস্তবে তা নেই। তারা শুধু তদন্ত ও সুপারিশ করে এবং ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে চিঠি দেয়। নগর ও স্থাপনার অন্য কর্তৃপক্ষের হাতেই তা কার্যকরের ব্যবস্থা। এ কারণে সাধারণত প্রথমে লাইসেন্স দেওয়ার পর আর নজরদারি করে না ফায়ার সার্ভিস। ১০ বছর আগে হাসেম ফুডের কারখানার অধুনিক কমপ্লেক্স গড়ে উঠেছে। তবে লাইসেন্স পাওয়ার পাঁচ বছর পর অগ্নিকাণ্ডের শিকার হওয়া ভবনটি নির্মিত হয়।

জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক ও তদন্ত কমিটির প্রধান জিল্লুর রহমান বলেন, ‘বিল্ডিং কোড অনুযায়ী যেসব ব্যবস্থা থাকার কথা তা এই কারখানায় ছিল না। এখানে কমপক্ষে পাঁচটি সিঁড়ি থাকা প্রয়োজন। আছে মাত্র দুটি। সেই সিঁড়িও কর্মীরা ব্যবহার করতে পারেননি। উপরে তালা ছিল। নিচে মেশিনারিজ ছিল।’ নিরাপত্তাব্যবস্থার ত্রুটি প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘অগ্নিদুর্ঘটনার ক্ষেত্রে প্রথম চার-পাঁচ মিনিটই গুরুত্বপূর্ণ। তখনই নিরাপদে বের হওয়ার ও সুরক্ষার প্রথম পদক্ষেপ নিতে হয়।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনার পর তদন্তে কারখানায় তালাবন্ধ করে আটকে রাখায় বেশি প্রাণহানির প্রমাণ পেয়ে কারখানাকেন্দ্রিক প্রশিক্ষণ বাড়িয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

এর আগে ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সাভারের আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশন লিমিটেড কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১১২ জন শ্রমিক পুড়ে মারা যান। ওই ঘটনার তদন্ত করে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ারসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। তদন্তে প্রমাণ হয় যে কারখানার গেটে তালা লাগিয়ে শ্রমিকদের আটকে রেখে কাজ করানো হচ্ছিল।

২০২০ সাল পর্যন্ত ছয় বছরের পরিসংখ্যান দিয়ে বিলস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই সময়ে কর্মক্ষেত্রে চার হাজার ৭৯৫ জন শ্রমিকের মৃত্যুর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভবন ও কারখানার অবকাঠামোর ত্রুটির অভিযোগ ওঠে।

২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর টঙ্গীতে টাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে এভাবে আটকা পড়ে ২৪ শ্রমিক প্রাণ হারান। ঘটনার দায়ে প্রতিষ্ঠানের মালিক বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মকবুল হোসেনসহ ১০ জনকে আসামি করে দুটি মামলা হয়। ২০১৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুলিশের মামলাটিতে অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।

‘হাসেম ফুড’ কারখানায় যারা মারা গেছে তাদের বেশির ভাগই শিশু। আইনগতভাবে শিশুশ্রমিকদের আটকে কাজ করানোও অপরাধ। এই বিষয়ে অভিযোগ বা তথ্য ছিল না বলে জানান নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম।

সেফটি ম্যানেজমেন্ট ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা ও ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহাম্মেদ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের নজরদারি না থাকায় কারখানায় শ্রমিকদের নিরাপত্তা নেই। ভবন নির্মাণকাজের এবং কারখানা স্থাপন ও পরিচালনা কাজের কর্তৃপক্ষ আলাদা। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে অনেক ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড মানা হয় না। এ ব্যাপারে ফায়ার সার্ভিস আবার ব্যবস্থা নিতে পারে না। ব্যবস্থা নিতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে।’

কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক নাসিরউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘আমাদের পরিদর্শকরা কারখানা সব সময় পরিদর্শন করে রিপোর্ট করেন এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। হাসেম ফুডের ক্ষেত্রে আগে কোনো অবজারভেশন ছিল কি না তা দেখা হচ্ছে। এ ব্যাপারে আমরাও তদন্ত করছি।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2021/07/11/1052207